একথা সবারই জানা প্রয়োজন যে, আরবি ‘আজান’ শব্দে চারটি বর্ণ রয়েছে। যথা : আলিফ, জাল, আলিফ, নুন। এই বর্ণ চারটির অন্তরনিহিত মর্ম হচ্ছে যাতে ইলাহী তথা আল্লাহপাকের সত্তা ও গুণাবলীর সপ্রশংস ধ্বনি উচ্চকিত করা এবং নূরে ইলাহী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালাতের শুভ সংবাদ বিশ্বময় ঘোষণা করা। এই উভয় দিকের সমন্বিত রূপ রেখা চ‚ড়ান্তভাবে ফুটে উঠে সালাত বা নামাজ আদায়ের মাধ্যমে।
তাই, নামাজের দিকে আহŸান করার একান্ত প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রেখেই আজানের প্রবর্তন করা হয়েছে। যদিও আজান স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত নিদর্শন কিন্তু তবুও এতদসংক্রান্ত সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা মহান আল্লাহপাক কুরআনুল কারীমে বিবৃত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : আপনি তিলাওয়াত করুন কিতাব থেকে যা আপনার প্রতি ওহী করা হয়। এবং সালাত কায়েম করুন। নিশ্চয় সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে। আর আল্লাহর জিকির তথা স্মরণইতো সর্বশ্রেষ্ঠ। অবশ্যই তোমরা যা কর, আল্লাহ তা জানেন। (সূরা আল আনকাবুত : ৪৫)।
এই আয়াতে কারীমায় আপাত দৃষ্টিতে প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করা হলেও আসলে সমস্ত ঈমানদারকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এতে দু’টি অংশ আছে। কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা ও সালাত কায়েম করা। কারণ এ দু’টি জিনিসই মুমিনকে এমন পবিত্র চরিত্র ও উন্নততর যোগ্যতার অধিকারী করে যার সাহায্যে সে যাবতীয় বাতিলের প্রবল বন্যা এবং দুষ্কৃতির ভয়াবহ তুফানের মোকাবিলায় সঠিক পথে অবিচল থাকতে পারে। (ফাতহুল কাদীর; আত্তাহরীর ওয়াত তানভীর)।
বস্তুত: কুরআন তিলাওয়াতের এই শক্তি ঈমানদারগণ তখনই অর্জন করতে পারে যখন সে আল কুরআনের শুধু মাত্র শব্দগুলো পাঠ করেই ক্ষান্ত হয় না, বরং এর শিক্ষাগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করে হৃদয়ের প্রতিটি তন্দ্রীতে সেগুলোকে সঞ্চারিত করতে থাকে। আসলে যে তিলাওয়াতের পরে মানুষের মন-মানস, চিন্তা-চেতনা, চরিত্র ও কর্মনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসে না, বরং কুরআন পড়ার পরও কুরআন যা নিষেধ করে মানুষ তা করে যেতে থাকে, তা একজন মুমিনের তিলাওয়াত হতেই পারে না। আসলে সে কুরআনের প্রতি ঈমানই আনেনি। এ অবস্থাটিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি ছোট বাক্যের মধ্যদিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন : কুরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ। (সহীহ মুসলিম : ২২৩)।
তারপর এই আয়াতে কারীমায় যে কাজটির প্রতি উম্মতকে অনুবর্তী করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা হলো সালাত। সালাতকে অন্যান্য ফরজ কর্ম থেকে পৃথক করার এই রহস্য ও বর্ণিত হয়েছে যে সালাত স্বকীয়ভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং দ্বীন ইসলামের স্তম্ভ। এর উপকারিতা এই যে, যে ব্যক্তি সালাত কায়েম করে সালাত তাকে গর্হিত ও অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত রাখে। (ইবনে কাসীর)।
আর এই সালাতই হচ্ছে মুক্তি, নিষ্কৃতি ও কামিয়াবী লাভের প্রধান সিঁড়ি। যা অতিক্রম করার জন্যই আজানের মাধ্যমে আহŸান জানানো হয়। শুধু তা-ই নয়, মহান আল্লাহপাক পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করে আল কুরআনে ইরশাদ করেছেন : ‘ওয়া কাব্বিরহু তাকবীরা’ অর্থাৎ আপনি সসম্ভ্রমে তাঁর (আল্লাহর) মাহাত্ম ঘোষণা করুন। (সূরা বাণী ইস্রাঈল : আয়াত-১১১-এর শেষাংশ)।
এখানে তাওহীদের ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় তাওহীদের নির্দেশ সম্বলিত আয়াতসমূহ এসেছে। যেমন (ক) সূরা ইখলাসে, (খ) সূরা আল জ্বিন্ন-এর ৩নং আয়াতে, (গ) সূরা আল মুমিনুনের ৯১ নং আয়াতে, (ঘ) সূরা আল আন আমের ১০১ নং আয়াতে, (ঙ) সূরা আল বাকারাহ-এর ১১৬ নং আয়াতে, (চ) সূরা ইউনুসের ৬৮ নং আয়াতে, (ছ) সূরা আল কাহফ-এর ৪নং আয়াতে, (জ) সূরা মারয়াম-এর ৮৮-৯২ নং আয়াতে, (ঝ) সূরা আল আম্বিয়া-এর ২৬নং আয়াতে, (ঞ) সূরা আল ফুরকানের ২নং আয়াতে।
এ সমস্ত আয়াতে যে সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে, তাহলো, দয়াময় আল্লাহতায়ালা যাবতীয় উপায়-উপকরণ ও সমস্ত বস্তুনিচয় হতে সম্পূর্ণ পবিত্র ও বিমুক্ত। তিনি সর্বদা আছেন ও থাকবেন। তাঁর কোনো অভাব নেই। সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। তাওহীদের এই ঘোষণা আজানের ধ্বনিতে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠে বলেই তা কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। তাইতো কবি কালির অক্ষরে আজানের মাহাত্ম এভাবে তুলে ধরেছেন : ‘কে ওই শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সূর, বাজিল কি সুমধুর, আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন