গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল : এক. ‘মারাত্মক ক্ষতি ও বিড়ম্বনা প্রসঙ্গ’ : উক্তরূপে একে-অন্যের দায়িত্ব পালন না করে, যৌথভাবে বা মিলেমিশে থাকার ক্ষেত্রে নজরে আসা অন্যতম মারাত্মক ক্ষতির একটি দিক হল, যারা বড় বা আয়-উপার্জনে সক্ষম তাঁরা নিজেদের উপার্জিত সম্পদ, বাসা-বাড়ি-দোকানপাট ইত্যাদি নিজেদের নামে করে নিচ্ছেন এবং তাতেই ব্যস্ত ও সচেতন রয়েছেন। কিন্তু পারিবারিক যৌথ সম্পদের দলীলপত্র/মিউটেশন/রেকর্ড-খতিয়ান/খাজনা আদায় ইত্যাদি প্রশ্নে বে-খবর! যার কারণে যৌথ সম্পদে বেশ জটিলতার জন্ম হচ্ছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা এক পর্যায়ে বে-হাত ও বে-দখল হয়ে যাচ্ছে!
পক্ষান্তরে যেসব সদস্য ছোট বা নারী, তারা অনেকটা বুঝেনও না বা তাদের তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণের মত আর্থিক সক্ষমতাও থাকে না। আবার পৈতৃক বা নানা-দাদা সূত্রে প্রাপ্য জমিজমা নিয়ে কোন ঝামেলা বা জটিলতা থাকলে, যা গোছানো দরকার এবং তাতে খরচপাতি দরকার; কিংবা অন্যরা তা বুঝিয়ে দিতে না চাইলে, সেক্ষেত্রে ছোটরা বা নারী সদস্যরা Ñযাদের প্রয়োজনীয় খরচ বহনে আর্থিক সঙ্গতিও নেইÑ এমন কেউ সংশ্লিষ্ট (যারা পূর্ব থেকে সম্পদ ভোগ করে আসছে বা যাদের দখলে রয়েছে) দাতা/দায়িত্বশীলদের স্মরণাপন্ন হলে, তারা একেতো অনিচ্ছুক দ্বিতীয়ত এমন প্রশ্ন উঠায় যে, “আপনার বড় ভাইয়েরা কোথায়? বোনেরা কোথায়? যান, সকলকে একসঙ্গে নিয়ে আসুন”! ইত্যাদি। অথচ বড় সদস্যদের নিজ অর্জিত বা বিভিন্নসূত্রে প্রাপ্ত বেশ সহায়-সম্পদ থাকায়, তাঁরাও সেই যৌথ সম্পদ উদ্ধারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না বা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর এভাবেই এক পর্যায়ে ওই যৌথ সম্পদ বে-হাত হয়ে যায় এবং তাতেও মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই অসহায় ও দূর্বলরা। কেননা সচ্ছলদের তো তা না পেলেও বড় কোন ক্ষতি নেই!
দুই. বহুমুখী জটিলতা : দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় নজরে আসা আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, এমন প্রকৃতির যৌথ সম্পদ যা আপনার নিজের হোক বা পৈতৃক সময়কার হোক বা দাদার আমলের হোকÑ তা তাৎক্ষণিক বা নিজ নিজ সময়কালে সংশ্লিষ্টরা দান-হেবা সূত্রে বা ফারাইয আইন সূত্রে হোকÑ ভাগ-বন্টন না করার ফলে, কাগজপত্র যথা সময়ে স্বচ্ছ ও পৃথক পৃথক না করার ফলে, অনেক জটিলতার জন্ম হয়; ভুল ওয়ারিস সনদ গ্রহণ করা হয়; বিধি মোতাবেক ন্যায্য প্রাপককে গোপন করা হয় এবং যিনি বিধি মোতাবেক পাবেন না, তাঁকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ইত্যাদি।
সার-সংক্ষেপ : ১. স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের একজন মালিক তাঁর মিরাসসূত্রে প্রাপ্ত, বৈধভাবে অর্জিত ও দান-হেবা ইত্যাদি সূত্রে বিধি মোতাবেক প্রাপ্ত সমূহ সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক।
২. এমন একজন মালিক জীবদ্দশায় তাঁর সম্পদ যাকে ইচ্ছা, যতটুকু ইচ্ছা, বৈধ যে-কোন খাতে ইচ্ছা দান-হেবা করতে পারেন। এমনকি মৃত্যুর পূর্বেই নিজ স্ত্রী-সন্তানদেরকেও দান-হেবা করতে পারেন।
৩. মৃত্যুর পূর্বে দান-হেবার ক্ষেত্রে পুত্রসন্তান ও কন্যাসন্তানকে সমানহারে প্রদান করা চাই; কেননা তা উত্তম ও মুস্তাহাব।
৪. মৃত্যুর পূর্বে দান-হেবার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় স্ত্রী-সন্তানদেরকে ‘ফারাইয আইন’ এর হিসাব না করে, কমবেশীও প্রদান করতে পারেন।
৫. বিশেষ বিবেচনায় ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কাউকে কমবেশীও প্রদান করতে পারেন। যেমন একজন অসহায় বা প্রতিবন্ধী, আরেকজন স্বাবলম্বী অথবা একজন অশিক্ষিত ও উপার্জনহীন এবং অন্যজন শিক্ষিত ও সম্পদশালী।
৬. একইভাবে মেয়েদের বেলায়ও বিশেষ বিবেচনায় কমবেশী প্রদান করতে পারেন।
৭. কিন্তু বিশেষ বিবেচনা বা ন্যায্য বিবেচনার বাইরে ‘অন্যায় বা অহেতুক বা অপ্রয়োজনে জিদ’ করে কাউকে ঠকালে পাপ হবে, সেটি হল ভিন্ন কথা। অবশ্য বাস্তবতার নিরীখে এটিও সত্য যে, একজন পিতা বা মাতা’র স্বভাবজাত ও সৃষ্টিগত বিবেচনায়, তাদের একটি সন্তান ভালো হোক বা মন্দ হোক Ñতার প্রতি রক্তসম্পর্ক ও নাড়ির টান থাকবেই। একান্ত সীমাহীন ও চরম পর্যায়ের বাড়াবাড়ি ব্যতীত তাঁরা কোন সন্তানকে ত্যাজ্য বা বঞ্চিত করতে যান না বা যাবেন নাÑ এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এমতাবস্থায় বিষয়টিকে ‘অন্যায় বা অহেতুক জিদ’ বলা যাবে না।
৮. পিতা-মাতার অধিক সেবা-যত্নের কারণে বা ধর্ম-কর্ম ও দীনের কাজে অগ্রগামী হওয়ার বিবেচনায় কোন সন্তানকে একটু বেশিও প্রদান করতে পারেন।
৯. পিতা-মাতাকে কষ্টদান বা নির্যাতনের কারণে কোন সন্তানকে কম যেমন দিতে পারেন, একেবারে বঞ্চিতও করতে পারেন।
১০. এমনকি সম্পদ বেশি হলে, বিধি মোতাবেক আরও যারা তাঁর মৃত্যুর পর ওয়ারিস হবেন না; যেমন অসহায় ভাই-ভাতিজা, বোন-ভাগিনা ও মসজিদ-মাদরাসা-এতিমখানা ইত্যাদি সওয়াব ও কল্যাণকাজেও দান-হেবা করে যেতে পারেন, ইত্যাদি।
উপসংহার: সুতরাং উপরিউক্ত বিস্তারিত আলোচনাকে সামনে রেখে, একজন মুফতী বা ইমাম-খতীবকেও এ যুগের মুসলিম উম্মাহকে এমনই যুগোপযোগী পরামর্শ বা নির্দেশনাদানের বিকল্প নেই।
মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে জড়তামুক্তি ও শুভ জাগ্রত বিবেক নসীব করুন। আমীন!
লেখক : মুফতী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বায়তুল মোকাররম, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন