কক্সবাজারে নতুন করে মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। রাঘব বোয়ালদের আড়াল করার জন্য কিছু চুনোপুঁটিকে তালিকাভূক্ত কারায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বিভিন্ন মহলে। পাশাপাশি এক শ্রেণীর ধান্ধাবাজ মিডিয়া কর্মী ওই তালিকার সূত্র ধরে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েছে যাদের নিয়ে এই আজগুবি মাদকের তালিকা প্রচার হয়েছে তাদের পেশাদারিত্ব, ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক অবস্থানের সাথে এই তালিকা কোন অবস্থাতেই যায়না। মূলত একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ইশারায় রাঘব বোয়ালদের আড়াল করতে এই তালিকার জন্ম হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। এই তালিকা এখনো পর্যন্ত সরকারি কোন সংস্থা সনাক্ত করতে পারেনি। তালিকায় ৩৭৬ জনের নাম থাকলেও দুই গনমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে একটিতে বলা হয়েছে ২৫৫ জন। আরেকটিতে বলা হয়েছে ৯৩ জন। এছাড়া তালিকাটি কক্সবাজারে কর্মরত সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের মুঠোফোনে দীর্ঘ ৭/৮ মাস ধরে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
লেটার হেড কিংবা স্মারক নাম্বার ছাড়াই প্রণীত এই তালিকা দেখলেই যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবে এটি উদ্দ্যেশমূলক। গুটি কয়েক ইয়াবা ব্যবসায়িদের নামের সাথে ডুকানো হয়েছে সামাজিক অবস্থান সম্পন্ন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা ও কয়েকজন মূলধারার গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকের নাম। নানা ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এই তালিকার সূত্র ধরে এখন পর্যন্ত দুটি পত্রিকা দুইভাবে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। তবে দুই পত্রিকায় তাদের ছাপানো সংবাদে স্পষ্ট করতে পারেনি এই তালিকার সত্যতা ও সূত্র।
এব্যাপারে সবচাইতে বড় প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে,গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে ১৫ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বক্তব্য। এপ্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে জানতে চান কীসের তালিকা। পরে উপস্থিত সাংবাদিকরা ইয়াবার তালিকা বলে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, তালিকা হলেই যে কেউ মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। নানা মাধ্যমে অনেক তালিকা বা ইনফরমেশন আমাদের কাছে জমা হয়। যাচাই বাছাই করে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে এই আজগুবি তালিকা ঘিরে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও হয়রানী করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠে এসেছে নানা মহল থেকে। কেউ কেউ বলছেন- ভুয়া তালিকা তৈরি করে নাগরিকদের আর্থিক হয়রানির পাশাপাশি চরম সম্মানহানি করা হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন- এই উদ্ভট তালিকা প্রণয়ন পরবর্তী মাঠে ছেড়ে দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কোনো দুরভিসন্ধিও থাকতে পারে। কারণ- তালিকায় বেশিরভাগই নাম এসেছে রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ ও সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের। এই তালিকা নিয়ে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় একটি মহল জেলায় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় বলেও মনে করছেন অনেকেই।
জেলায় কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানান, এই তালিকা ঠিক কিভাবে, কারা প্রণয়ন করেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। তাদের মতে, তালিকাটিতে উল্লেখিত লেখার ভাষা ও গঠন দেখে মনে হয়নি এটি প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত। ধারণা করা হচ্ছে- কোনো একটি স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের ফায়দা লুটতে অতীতের তালিকা কম্পিউটারে কম্পোস করে শুরুতে এবং মাঝে মাঝে সমাজের সম্মানিত নানা পেশার মানুষের নাম সংযুক্ত করে দিয়েছে। এই তালিকার প্রাশাসনিক কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করেন না অনেকেই।
তালিকায় লেটার হেড, স্মারক নাম্বার কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তালিকাটি পত্রিকায় প্রকাশের ৭/৮ মাস পূর্বে থেকেই কক্সবাজারের গনমাধ্যমকর্মী ও চিহ্নিত কিছু মানুষের মোবাইলে পিডিএফ ফাইল আকারে পৌঁছানো হয়েছে। পাশাপাশি ৬ জানুয়ারি তালিকাটি সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলা নামের একটি পত্রিকার মাধ্যমে ফলাওভাবে প্রচার হয়। এমনকি উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখিত মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহা পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম তার দেওয়া বক্তব্যে জানিয়েছেন- ২৫৫ জনের যে তালিকার কথা সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছেন সেটি তার জানা নেই। এই তালিকা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
এছাড়া তালিকায় তিন নাম্বারে উল্লেখিত ব্যাক্তির ব্যাপারে লেখা হয়েছে-‘পুলিশের উদ্ধার করা ইয়াবার একটি অংশ পুলিশ তার মাধ্যমে বিক্রি করে সোর্সদের টাকা প্রেরণ করে থাকে।’এক্ষেত্রে উক্ত তালিকায় কোথাও ওইসব ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের নাম তুলে ধরা হয়নি। পাশাপাশি আরো উল্লেখ করা হয়েছে তাকে গোপনে রিমান্ডে নিয়ে গেলে পুরো জেলার ইয়াবা ব্যবসায়িদের তালিকা পাওয়া যাবে। এতে করে একটি সিন্ডিকেট উদ্দেশ্যমূলকভাবে তার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উস্কানোর কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অনেকের প্রশ্ন তাকে গোপনে রিমান্ডে নিলে যদি পুরো জেলার তালিকা পাওয়া যায় তাহলে এত কষ্ট ও সময় নষ্ট করে লম্বা তালিকা বানানোর কি দরকার ছিল? ফলে এধরণের তালিকা নিয়ে বিব্রত প্রশাসনও। একই ভাবে তালিকায় ৭ নাম্বারে উল্লেখিত ব্যাক্তির ব্যাপারে মন্তব্যের ঘরে লেখা হয়েছে-”১০ বছর পূর্বেও ভিখারীর মতো বসবাস করলেও বর্তমানে ইয়াবা ব্যবসার মাধ্যমে বাড়ী, গাড়ী ও কয়েকটি ট্রলারের মালিক হয়েছেন। সমস্ত পরিবারের ছেলে, মেয়ের জামাই সবাই সন্ত্রাসী এবং চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী।” এই ব্যাক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধানে জানা যায়- তিনি দীর্ঘদিনের পুরোনো ইয়াবা ব্যবসায়ী। কখনোই তিনি হতদরিদ্র বা ভিখারীর মতো ছিলেন না। তিনি মাদক সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকও হয়েছিলেন। অথচ উক্ত তালিকায় কোথাও তার ব্যপারে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ করা হয়নি অর্ধ-ডজন মাদকের মামলা থাকার বিষয়টিও।
এছাড়াও তালিকায় উল্লেখিত বেশিরভাগ নামের বিপরীতে মন্তব্যের ঘরে কিছুই লেখা হয়নি। যাদের নাম কখনো ইয়াবার তালিকায় ছিলনা কিন্তু নতুন করে এই তালিকায় নাম আনা হয়েছে তাদের কারো নামের বানান ও ঠিকানা শুদ্ধ নেই। পাশাপাশি পিতার নাম কিংবা ঠিকানাও নেই।
এব্যাপারে মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দারা বলছেন- যদি এটি সত্যিকারের প্রশাসন কর্তৃক প্রণীত কোনো তালিকা হতো তাহলে মন্তব্যের ঘর কখনোই খালি থাকতো না।
পাশাপাশি সবার পেশা, নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা শুদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ থাকত। তাছাড়া তালিকা পিডিএফ আকারে সাংবাদিক কিংবা গণমানুষের মোবাইলে যাওয়ার বা পাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা। এটি হাস্যকর ও সরকারী সংস্থার জন্যও বিব্রতকর। এছাড়াও তালিকায় এমন সব সামাজিক ব্যাক্তিবর্গের নাম আনা হয়েছে যাদের ব্যাপারে কখনওই মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা শাখার(ডিবি) অফিসার ইনচার্জ আহমেদ নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ সাংবাদিকদের জানান, ২৫৫ জন কিংবা সম্প্রতির কোন প্রকার ইয়াবা ব্যবসায়ির তালিকা প্রকাশের সংবাদ তাদের কাছে জানা নেই। বর্তমানে কক্সবাজারে যে তালিকা নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে তার সত্যতাও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছেনা।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন