১৯৪৭ সালে আমরা আমাদের দেশ থেকে ব্রিটিশ শাসকদের বিতাড়িত করেছিলাম। ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেল। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের দেশ প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করলো। তখন ভেবেছিলাম ঘাড়ের উপর থেকে বুঝি জগদ্দল পাথর বিদায় হলো। তারা বিদায় নিল বটে, তবে তাদের প্রণীত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চিন্তাকাঠামো এদেশে রেখে গেল। তারা চলে গেলেও রয়ে গেল তাদের ধর্ম-দর্শন ও জাতি গঠনের আদর্শিক চেতনা। ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশরা যে কাঠামোর উপর রাষ্ট্রটি দাঁড় করিয়েছিল সেটিও অবিকল রয়ে গেল। তাদের বিদায়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই টের পাওয়া গেল যে, তারা চলে যেয়েও যায়নি। নতুন করে স্বাধীন যে রাষ্ট্রটি আমরা পেয়েছিলাম তার নাম ছিল পাকিস্তান। আয়তনে দেশটি ছিল ছোটো, কিন্তু এর শাসকদের চরিত্র ছিল ব্রিটিশদের থেকেও খারাপ। শাসন, শোষণ আর বিমাতাসুলভ আচরণে দেশটি ছিল জর্জরিত। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে রাষ্ট্র ছিল পুরোপুরি ঔপনিবেশিক। তারা ছিল ভিন দেশি শোষক ও ঔপনিবেশিক। আর স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রীয় শাসনটা দাঁড়াল ছদ্ম ঔপনিবেশিক তথা দেশি ঔপনিবেশিক, যাকে নব্য ঔপনিবেশিকও বলা যেতে পারে। ব্রিটিশদের প্রণীত আইন-কানুন ও শাসনপ্রণালীতে কোনো পরিবর্তন হলো না। রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য সকল বাহিনী ব্রিটিশ আইন দ্বারাই পরিচালিত হতে লাগলো। রাষ্ট্রের ভেতরকার সকল অফিস ও আইন-আদালতে কোনো পরিবর্তন এলো না। দেশীয় যন্ত্রপাতি ও কারখানা সব কিছুই আগের মতো রয়ে গেল। ব্রিটিশের দ্বারা প্রশিক্ষিত বেসামরিক ও সামরিক আমলারা আগের মতোই কর্তৃত্ব করতে লাগলো। বিশেষভাবে দুরন্ত হয়ে উঠল সামরিক বাহিনী। ব্রিটিশ রাষ্ট্রে পেশীশক্তির প্রধান উৎস ছিল এই সেনাবাহিনী। তাদের হাতে গড়া প্রশিক্ষিত সেই সেনাবাহিনীও অবিকল রয়ে গেলো। এক কথায়, দেশের সবখানেই আইন, শাসন ও শোষণ চলতে থাকলো আগের মতই। এসব দেখে মনে হলো, শাসন ও শোষণ যেন পূর্বের ঔপনিবেশিকতার ধারাবাহিক উত্তরাধিকার। ঔপনিবেশিক এ উত্তরাধিকারের দাপট ছিল ব্রিটিশদের চেয়েও ভয়ানক। বিশেষভাবে রাজনীতির ক্ষেত্রে এটি প্রকট হতে প্রকট আকার ধারণ করতে লাগলো।
পূর্বেই বলা হয়েছে ব্রিটিশ শাসকরা ছিল বিদেশি। স্বাধীন পাকিস্তানের শাসকবর্গকে আমরা দেশি ও আপন মনে করেছিলাম। কিন্তু তারা নামেই শুধু ছিল আপন। আচরণে বিদেশির চেয়েও ভিন্ন। অনতিবিলম্বেই টের পাওয়া গেল যে, তারা নামেই শুধু আপন। অত্যাচার ও নির্মমতায় তারা ব্রিটিশদেরকেও পেছনে ফেল দিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি ৭ কোটি বাঙালিকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করতে থাকলো। বাঙালিদের শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করলো। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর তারা আক্রমণ করে বসলো। নিজেদের দেশে তারা আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর জাতিতে পরিণত করলো। অতঃপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, পাকিস্তানি শাসকদের তাড়াবো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদের আমরা তাড়িয়েই ছাড়লাম। স্বাধীন বাংলাদেশ নামে একটি রাষ্ট্র তৈরি হলো। স্বাধীন বাংলাদেশে বিদেশি দুর্বৃত্ত আর রইলো না। রইলাম শুধু আমরাই। নিজেদের দেশ, নিজেদের রাজত্ব, নিজেরাই সর্বেসর্বা। নিজেদের রাজত্বে নিজেরাই রাজত্ব করতে থাকলাম। দেশের ক্ষমতায় আসীন হলো পাকিস্তানিদের তাড়ানো বীর বাঙালি। ভ্রুকুঞ্চিত নয়নে অবাক বিস্ময়ে বাংলার দিকে তাকিয়ে গোটা বিশ^। বাংলাদেশ, ছোট্টো একটি দেশ, ক্ষুদ্র একটি ভূখন্ড। কিন্তু নেতৃত্বের আসনে সমাসীন এক বিশ^মানের নেতা।
সদ্য স্বাধীন দেশটি তখনও শিশু। হাঁটি হাঁটি পায়ে যাত্রা শুরু করলো শিশু দেশটি। কিন্তু অল্প দিনেই থমকে গেল শিশুটির পথচলা। স্বাধীনতার তখন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ সময় আমরাই খুন করলাম জাতির পিতাকে। তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যকেও পরে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, হত্যা করা হলো জাতীয় নেতাদের। দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যে চলা শুরু করলো। দেশ থেকে গণতন্ত্র ছিটকে গেলো। সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হতে থাকলো। অভ্যুত্থানজনিত ঘটনায় অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা নিহত হলো। অভ্যুত্থানের পালা বদলের ভিতরেই দেশে সৃষ্টি হলো লুটেরা ধনিক শ্রেণি। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের আদলে দেশে গড়ে উঠলো একটি শোষক শ্রেণি। এ শোষক শ্রেণি লুটতন্ত্রে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলে জোর কদমে এগিয়ে চললো। দেশীয় এসব শোষকদের কাতারে নতুন করে সংযোজন হলো ভূমিদস্যু। এসব দস্যু পাহাড়, বন, নদী ও জলাশয় দখল করলো। যদিও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানিদের সময় দেশে এসব ভূমিদস্যুর অস্তিত্ব ছিল না। দেশীয় এসব দস্যু দেশের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে লাগলো। দেশীয় সম্পদ ইচ্ছেমত বিদেশে পাচারও করতে থাকলো। তারা নিঃসঙ্কোচে লুণ্ঠন ও অত্যাচার চালাতে লাগলো। এসব শাসক এ দেশেরই সন্তান, কিন্তু তারা ক্রমাগত আমাদের চোখের সামনে বিদেশি হয়ে উঠলো।
আমরা আশা করেছিলাম, স্বাধীন রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু সেটা অধরাই রয়ে গেলো। বিপরীতে পাওয়া গেলো ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে ভিন্ন ভিন্ন জুলুমতন্ত্র, যাকে স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র বলা যেতে পারে। জুলুমতন্ত্রের সে ধারাবাহিকতা স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও চলমান রয়েছে। ছোট্টো এদেশে একবার নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে সে আর ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। সে ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে জটিল ও কুটিল পথে হাঁটতে থাকে। নির্বাচিতরা সরকার গঠন করার পর তাদের কেউই বিন্দুমাত্র জবাবদিহির তোয়াক্কা করে না। সাধারণ জনগণের কোনো ইচ্ছার ধারও তারা ধারে না। জনগণ তাদের মতামত পেশ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পেশীশক্তি ব্যবহার করে তারা প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়। ব্রিটিশের রেখে-যাওয়া রাষ্ট্রটি ছিল সম্পূর্ণভাবে আমলাতান্ত্রিক। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতেও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটলো না। স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও আমলাতন্ত্রের সেই লালফিতার দৌরাত্ম্য চলমান রয়েছে। এ তন্ত্রটি কখনও জবাবদিহির ধার ধারে নি, এখনও ধারে না। আমাদের শাসকরাও আমলাদের মতো একই রকমের প্রতাপশালী। তারা যা ইচ্ছা তাই করে। দেশটি স্বাধীন হয়েছিল সশস্ত্র জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। সে সময় কেউ কল্পনাও করেনি যে, এই রাষ্ট্রে আবার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি প্রেতাত্মার জন্ম হবে। আর তাদের মতো কুশাসন ও অপশাসন আবার ফিরে আসবে। অথচ সেটাই ঘটেছে। একবার নয় বরং বার বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।
অত্যন্ত কঠিন মূল্য দিয়ে আমরা দুই দুইবার স্বাধীনতা আর্জন করেছি। তারপরও জাতিগতভাবে আমাদের ন্যূনতম সম্মান বৃদ্ধি পায়নি। সম্মানের সেই কাঠামোতে তেমন কোনো পরিবর্তনও আসেনি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা এ দেশের নাগরিকদের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়নি। একইভাবে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকরাও জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়নি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারেরাও একই পথে হেঁটেছে এবং এখনও হাঁটছে। তারাও জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যেসব অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা আছে বাস্তবে সেসবের কোনো ছিঁটেফোটাও দেশে কার্যকর নেই। বরঞ্চ সত্যটা হলো, অধিকারগুলো শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনদের জন্যই নিশ্চিত করা হয়েছে। বিপরীতে বিরোধী পক্ষকে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অধিকন্তু তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রটি ক্রমান্বয়ে বেশিমাত্রায় নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর এ নিপীড়নের সকল মাত্রাই ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানকে হার মানিয়েছে।
বর্তমানে স্বাধীনতা বলতে যা প্রচলিত আছে তাকে স্বাধীনতা বলা যায় না। তৃতীয় বিশে^র অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোর স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। যা আছে তাহলো একটি পতাকা এবং একটি ভূখন্ড। আছে তল্লীবাহক একটি সরকার ও প্রশ্নবিদ্ধ আইন-কানুন। বর্তমানে তৃতীয় বিশে^র প্রত্যেকটি ছোটো স্বাধীন দেশ বড়ো একটি স্বাধীন দেশকে পদলেহন করে চলে। একইভাবে প্রত্যেকটি দুর্বল দেশ শক্তিশালী দেশের আনুগত্য করে চলে। ধনী দেশকে গরিব দেশের তেল মারা লাগে। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর একটি উক্তি এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ছিল এককেন্দ্রিক এবং দূরের প্রভুদের দ্বারা শাসিত। স্থানীয় শাসকরা ছিল সরকারি আমলা। আদত প্রভুরা থাকত বিলেতে। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্র এককেন্দ্রিকই রইল। পূর্ববঙ্গের বেলায় স্থানীয় শাসকরা ছিল আমলা গোমস্তা, প্রভুরা থাকত করাচিতে, নয়তো রাওয়ালপিন্ডিতে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আগের দুটির তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু একই রকমের এককেন্দ্রিক। কেবল এককেন্দ্রিক নয়, ক্ষমতার চাবিকাঠি এই রাষ্ট্রেও রয়ে গেছে একব্যক্তির হাতে; তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তিনি প্রধানমন্ত্রী, সামরিক আধা-সামরিক ব্যবস্থায় তিনি রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রের দৃশ্যমান শাসকরা স্থানীয়, কিন্তু তাদের অদৃশ্য মুরব্বিরা থাকে বিদেশে, বিশেষভাবে ওয়াশিংটন ও দিল্লিতে। স্থানীয় শাসকরা বিদেশি মুরব্বিদের রাগ-অনুরাগের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখনকার শাসকরা দেশে থাকলেও আচরণ করে বিদেশিদের মতো। সন্তানসন্ততি এবং আহরিত ও লুণ্ঠিত সম্পদ বিদেশে রাখতেই পছন্দ করে। তারা ঘরবাড়িও বিদেশে তৈরি করছে, ক্রমাগত বর্ধিত হারে। ঔপনিবেশিক আমলে জাতি সমস্যার সমাধান ঘটেনি। আজও সে সমস্যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ আমলের ৫১ বছরেও সে সমস্যা রয়েই গেছে’। (ভোরের কাগজ, ১৪ মার্চ ২০২২)
এমতাবস্থায় সচেতন মহলের প্রশ্ন, এখন কী হবে? দেশে আজ গণতন্ত্র নেই, ভোটাধিকার নেই। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় বিচার নেই। বিচারের বাণী নিভৃতে ঢুকরে কাঁদছে। গুটিকতক মানুষ স্বধীনতার সুফল ভোগ করছে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকতে বিভিন্ন কূটনীতিকের আঁচলের তলে আশ্রয় নিচ্ছে। একইভাবে বিরোধীপক্ষ ক্ষমতায় যেতে কূটনীতিকের দয়া-দাক্ষিণ্য ভিক্ষা চাচ্ছে। দুই দলের প্রতিযোগিতায় তাদের সমর্থক গোষ্ঠির সকলেই কখনও বা আনন্দ আবার কখনও বা হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। ভুক্তভোগী জনগণের কথা কেউই ভাবছে না। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। রাষ্ট্রের সকল সুযোগ-সুবিধা সরকারি দলের লোকেরা ভোগ করছে। সরকারি দলের লোকজন ফুলে-ফেফে মোটাতাজা হচ্ছে। বিরোধী মতের লোকেরা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও উপেক্ষিত থাকছে। নিপীড়িতরা বোবা কান্নায় মুক্তির প্রহর গুনছে। সাধারণ জনগণ মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছে।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
dr.knzaman@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন