দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে কোনো স্থায়ী রাষ্ট্রদূত নেই ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। জো বাইডেনের প্রশাসন এই দু‘বছরে ছয়জন কূটনীতিককে অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব দিয়েছে ভারতের দূতাবাস সামলানোর জন্য। কিন্তু পূর্ণ সময়ের রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে বারে বারেই স্পষ্ট করে বলেছে যে ভারত তাদের রণকৌশলের সহযোগী।
বিশ্লেষকরাও মনে করেন যে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় শক্তি-বিন্যাসের ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের যে রেষারেষির সম্পর্ক, আবার চীন-ভারত সীমান্তে যে উত্তেজনা সবসময়েই বজায় থাকে, সেই প্রেক্ষাপটে দিল্লিকে কাছে পেতে চাইবে ওয়াশিংটন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের রাজধানীতে দু‘বছর ধরে কোনো পূর্ণ সময়ের দূত কেন পাঠাচ্ছে না বাইডেন প্রশাসন, সেই প্রশ্ন উঠছে।
চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ে যে ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের
নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিশ্লেষক মীনাক্ষী আহমেদ লিখেছেন, ‘এটা কল্পনা করাও কঠিন যে যুক্তরাষ্ট্র গত দু‘বছর ধরে ভারতে কোনো রাষ্ট্রদূত পাঠায়নি। নিজেদের অংশীদার বলে কয়েকবারই উল্লেখ করেছেন বাইডেন। তার পরেও এই পরিস্থিতি। দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
মীনাক্ষী আহমেদ লিখেছেন, ‘১৯৬২ সালে চীন যখন ভারতের ওপরে হামলা চালায়, ওই সময়ে জন কেনেথ গলব্রেথ দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। গলব্রেথ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির কাছের লোক ছিলেন, আবার জওহরলাল নেহরুর সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিল। কেনেডি ও নেহরুর মধ্যে যে অবিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল, সেটা গলব্রেথই ভাঙতে পেরেছিলেন। ওই যুদ্ধের সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ভারতের সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল।’
কেনেথ গলব্রেথ ছাড়া ১৯৬০-এর দশকেই আরো একজন রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যার নাম চেস্টার বাউল্স। শীতল যুদ্ধের ওই সময়ে রাশিয়ার সাথে ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, কিন্তু এই দুই রাষ্ট্রদূতই নেহরুর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। এরই ফলশ্রুতিতে জওহরলাল নেহরু প্রথমে দ্বিধা করলেও পরে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন চেয়েছিলেন।
রাষ্ট্রদূতের মনোনয়ন আটকে গেছে সেনেটে
তবে ভারতে রাষ্ট্রদূত পাঠানোর কোনো উদ্যোগই যে বাইডেন প্রশাসন নেয়নি, তা নয়। তারা লস অ্যাঞ্জেলসের প্রাক্তন মেয়র এরিক গার্সেটিকে বেছেছিল দিল্লিতে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসাবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে, গার্সেটি তার এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগের যথাযথ ব্যবস্থা নেননি। তারপরেই সেনেটে এরিক গার্সেটির মনোনয়ন নিয়ে ভোটাভুটির প্রক্রিয়া থমকে যায়।
হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকা গার্সেটির সম্বন্ধে লিখেছে, ‘তিনি বেশ কয়েকবার ভারতে এসেছেন এবং তিনি হিন্দি ও উর্দু পড়েছেন।’
তবে শুধু যে ভারতেই যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পূর্ণ সময়ের রাষ্ট্রদূত নেই তা নয়।
ফরেন পলিসি ডট কম এই সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যে কটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী রাষ্ট্রদূত নেই, তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হল ভারত।
এছাড়া ইথিওপিয়া, ইতালি, কলম্বিয়া ও সৌদি আরবেও রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
ওই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ দফতরের এক কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ‘যখন প্রায় দু‘বছর ধরে চেষ্টা করেও একজনের মনোনয়ন পাশ করাতে পারছ না, এমন একটা সেনেট থেকে, যেটা আবার তোমার দলেরই নিয়ন্ত্রণে, তখন বোধহয় বলে দেয়াই ভাল যে ওই মনোনয়নটা আর করা যাবে না।’
ফরেন পলিসি ডট কম লিখেছে, ‘কিন্তু গার্সেটিকেই ভারতে রাষ্ট্রদূত করার ভাবনা থেকে হোয়াইট হাউস যে এখনই সরে আসছে না, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে এক সংবাদ সম্মেলনেই।’
কূটনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি ব্লুমিংটনের রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত অম্বুজ সাহু ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দিল্লিতে কোনো রাষ্ট্রদূত না থাকার ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কূটনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বা ভারতে আসলে কী ঘটছে, তার দিকে নজর রাখা সম্ভব হচ্ছে না।‘
সাহু লিখেছেন,‘ভারত সম্পর্কিত তথ্যের জন্য বাইডেন প্রশাসনকে পেশাদার কূটনীতিকদের যোগাড় করা তথ্যের বদলে এখন শুধুই নির্ভর করতে হচ্ছে তথাকথিত বিশ্লেষক বা ‘ইন্ডিয়া ওয়াচারদের’ ওপরে।’
সাহুর কথায়, ‘এর ফলে দিল্লির সাথে যেকোনো বিষয়ের সমাধানে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নামতে হচ্ছে। যেমন সম্প্রতি ভারতীয়দের ভিসার সমস্যা মেটানোর মতো একটা সাধারণ বিষয়তেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে কথা বলতে হয় সেক্রেটারি অফ স্টেট অ্যান্থনি ব্লিংকেনের সাথে।’
ফরেন পলিসি ডট কম জানাচ্ছে এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের যত দূতাবাস বা উপ-দূতাবাস আছে, চীনের দূতাবাসের মোট সংখ্যা তার থেকেও বেশি। সূত্র : বিবিসি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন