সমগ্র মুসলিম উম্মাহর হেফাজত, হেদায়েত, মাগফিরাত, নাজাত এবং ইহ ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনা করে আজ রোববার দুপুরে দিল্লীর মাওলানা সা’দ কান্দলভি অনুসারীদের অংশগ্রহণে দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হলো তাবলীগ জামাত আয়োজিত দুই পর্বের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা। দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা সা’দের বড় ছেলে মাওলানা ইউছুফ বিন সা’দ কান্দলভি। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে শুরু হয় বহুলকাঙ্খিত আখেরি মোনাজাত। শেষ হয় দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে। দীর্ঘ ৩০ মিনিটের আখেরি মোনাজাতে শরীক হয়েছেন দেশ-বিদেশের লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ। এসময় শিশু, কিশোর, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লী গভীর ভাবাবেগপূর্ণ কন্ঠে ‘আমীন, আল¬াহম্মা আমীন’ ধ্বনিতে তুরাগ তীরসহ আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মহামহিম আল্লাহর দরবারে নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য কায়মনো বাক্যে ফরিয়াদ জানান। দক্ষিণে উত্তরা হাউজবিল্ডিং, উত্তরে চেরাগ আলী মার্কেট, পূর্বে টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরী ও পশ্চিমে কামারপাড়াসহ আশপাশের কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকা বিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র থেকে বারবার ‘আমীন, আল্লাহুম্মা আমীন’ ধ্বনি উঠে। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লীর সাথে আখেরী মোনাজাতে শরীক হয়েছেন মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দলমত নির্বেশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।
গত ১৩ জানুয়ারি শুক্রবার মাওলানা যোবায়ের অনুসারীদের অংশগ্রহণে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারী আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। চার দিন বিরতির পর ২০ জানুয়ারি শুক্রবার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে আজ রোববার পূনরায় আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটে। এবারের বিশ^ ইজতেমায় প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় পর্বে রেকর্ড সংখ্যক মুসল্লীর সমাগম ঘটেছে। দুপুর ১২টা ১৫ মিনিট থেকে শুরু করে ১২টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত ৩০ মিনিট স্থায়ী আবেগঘন আখেরী মোনাজাতে আমীর-ফকির, ধনী-গরীব, নেতা-কর্মী নির্বিশেষে সকল শ্রেণী-পেশা-গোষ্ঠীর মানুষ পরওয়ারদেগার আল্ল¬াহর দরবারে দু’হাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। মোনাজাতে মাওলানা ইউছুফ বিন সা’দ কান্দলভি প্রথম ১১ মিনিট পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াতগুলো উচ্চারণ করেন। শেষ ১৯ মিনিট উর্দু ভাষায় দোয়া করেন।
৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার শেষ পর্বের শেষ দিন রোববার ভোর থেকেই আখেরি মোনাজাতে শামিল হতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রাজধানী ঢাকা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে ট্রেন, বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, জীপ, কার এবং নৌকাসহ নানা ধরনের যানবাহনে এবং দলে দলে পায়ে হেঁটে ইজতেমা ময়দানে পৌঁছেন। এছাড়া ভোর থেকেই ইজতেমা ময়দানের দক্ষিণে খিলক্ষেত, বিশ্বরোড থেকে এবং উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা, পশ্চিমে কামারপাড়া থেকে আশুলিয়া ধৌড় ও পূর্বে পূবাইল পর্যন্ত রিকসাসহ সকল ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখার ফলে সকাল থেকেই দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে ইজতেমা অভিমুখে ছুটতে থাকে মুসল্ল¬ীদের কাফেলা। এতে তুরাগের তীরকে কেন্দ্র করে কয়েক বর্গকিলোমিটার জুড়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশাল মানব বলয় সৃষ্টি হয়। মোনাজাত শুরুর আগেই সকাল ১০টার মধ্যে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় তুরাগ তীরের পুরো ইজতেমাস্থল ও চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঃ
এবারের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমায় নজীরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। সাত স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ১০ হাজারের অধিক পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি রয়েছে ৩ হাজার সাদা পোষাকী গোয়েন্দা পুলিশ। আকাশে হেলিকপ্টার, নৌ-পথে স্পীড বোটে সতর্ক টহল ও নজরদারী। আকাশ ও নৌ-পথের পাশাপাশি সড়ক পথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামরা ও ড্রোন ক্যামেরার মাধ্যমে মুসল্লীসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম শহীদ আহসান উল্লাহ স্টেডিয়ামে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত র্যাবের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছে।
সমাপনী বয়ানঃ
মোনাজাতপূর্ব হেদায়েতি বয়ানে দিল্ল¬ীর মাওলানা ইউছুফ বিন সা’দ কান্দলভি সমবেত মুসল্ল¬ীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দাওয়াতের মেহনত কোন নতুন কিছু নয়। এই মেহনত আল্ল¬াহর প্রিয়বান্দা নবী-রাসুল থেকে শুরু করে সাহাবায়েকেরাম আজমায়ীনগণ করে গেছেন। তিনি বলেন, অপর ভাইয়ের কাছে দিনের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে হেকমত ও ধৈর্য্যর সাথে। অপর ভাইয়ের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর আগে তার হালত (অবস্থা) জানতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিনের পথে আনতে হবে। মাওলানা ইউছুফ তার হেদায়াতি বয়ানে আরো বলেন, যে সমাজ, জাতি বা রাষ্ট্র আলেমদের কদর যত বেশী করবে সে জাতি বা সমাজ তত বেশী সঠিক পথে পরিচালিত হবে। জ্ঞান আহরণের জন্যে আমাদেরকে আলেমদের মুখাপেক্ষী হতে হবে। তিনি বলেন, আল্ল¬াহর রাস্তায় বের হওয়ার জন্য যারা জামাতবন্দী হয়েছেন তাদেরকে দু’ধরনের মেহনত করতে হবে। প্রথমত দিনের বেলা দাওয়াত বা গাশত করে মানুষকে মসজিদমুখি করতে হবে। দ্বিতীয়ত রাতের বেলায় চেখের পানি ফেলে আল্ল¬াহর কাছে দোয়া করতে হবে। এ দু’ধরনের মেহনত না হলে কাজ পরিপূর্ণ হবে না। তিনি বলেন, আমাদের প্রত্যেকটি কাজ হতে হবে আল্ল¬াহকে রাজি খুশি করার উদ্দেশ্যে। তিনি আরো বলেন, আমরা আল্ল¬াহর হুকুম ও নবী করীম (সঃ) তরিকা থেকে সরে গিয়েছি বলেই নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ঃ
আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার মহিলা মুসল্লীও ইজতেমা ময়দানের আশেপাশের সড়কে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরী মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা গেছে।
যে কারণে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমাঃ বিশ্ব তাবলীগ জামাতের মুরুব্বীগণ জানান, দেশ-বিদেশে তাবলীগের দাওয়াত পৌঁছে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে ইজতেমায় শরীক হওয়া মুসল্লীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে টঙ্গী তুরাগ তীরের ১৬০ একরের বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে স্থান সংকুলান হচ্ছিলো না। ২০১০ সালের বিশ^ ইজতেমায় রেকর্ড সংখ্যক আগত মুসল্লীদের মাঠে অবস্থান ও যাতায়াতে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাই বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীদের অসুবিধা ও দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো। সেই থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিদেশি মুসল্লীদের পাশাপাশি দেশের অর্ধেক জেলা অর্থাৎ ৩২/৩৩ জেলার মুসল্লীগণ প্রথম পর্বে এবং বাকি অর্ধেক জেলার মুসল্লীগণ দ্বিতীয় পর্বে অংশ নিতেন। ২০১৮ সালে দিল্লীর মাওলানা সা’দ কান্দলভির একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের আলেম ওলামাসহ তাবলীগ অনুসারি ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের মধ্যে মতবিরোধ ও এক পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে অনাকাঙ্খিত সাংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার পর সরকারের মধ্যস্থতায় মাওলানা যোবায়ের ও মাওলানা সা’দ অনুসারীরা পৃথকভাবে দুই পর্বে বিশ^ ইজতেমার আয়োজন করে আসছেন।
তাশকিল কামরাঃ ইজতেমা ময়দানের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে করা হয়েছে বিদেশী মেহমানদের অবস্থানের জন্য তাশকিলের কামরা। ময়দানের খিত্তাগুলো থেকে চিল্লায় নাম লেখানো ধর্মপ্রাণ মুসল্লীদের জামাতবন্দী করে তাশকিলের কামরায় জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। আখেরী মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লীগণ জামাতবন্দী হয়ে তাবলীগের মুরুব্বীদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জামাতবন্দী হয়ে দ্বীনের দাওয়াতী মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতবন্দীদের মধ্যে ৪০দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লীগণ রয়েছেন। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্তর অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবেন।
ট্রেনে মুসল্লীদের প্রচন্ড ভীড়ঃ
আখেরি মোনাজাত শেষে টঙ্গী রেলওয়ে জংশন থেকে চলাচলকারী সকল ট্রেনে মুসল্লীদের প্রচন্ড ভীড় দেখা গেছে। মুসল্লীরা ট্রেনের ভিতরে জায়গা না পেয়ে মই বেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনের ছাঁদে উঠে গাদাগাদি করে নিজ নিজ গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন