শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বেপরোয়া বাস কেড়ে নিলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর প্রাণ

এক বছরে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

রাজধানীর বনশ্রীতে সড়ক দুর্ঘটনায় আশিকুর রহমান নিহতের সপ্তাহ না পেরোতেই গতকাল বেপরোয়া বাস চাপায় অকালে ঝরে গেলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্দান ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। নিহতের নাম নাদিয়া (২৪)। গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। নাদিয়া ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। মর্মান্তিক এ মত্যুর প্রতিবাদ এবং দায়ী বাসচালককে দ্রæত গ্রেফতারের দাবিতে গতকাল বিকেলে কাওলা ব্রিজ এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে নিহতের সহপাঠীরা। এদিকে নাদিয়ার মৃত্যুর খবরে শোকাহত তার পরিবার। খবর পেয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ছুটে আসেন তার মা-বাবাসহ পরিবার। সেখানে নাদিয়ার লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সবাই। তাদের আত্মচিৎকারে মর্গে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। নাদিয়ার বাবার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা এলাকায়।

নিহত নাদিয়া ছিলেন নর্দান ইউনিভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী। গতকাল রোববার দুপুরে নাদিয়া তার বন্ধু মেহেদি হাসানের মোটরসাইকেলে চড়ে যমুনা ফিউচার পার্কের দিকে যাচ্ছিলেন। বেলা পৌনে ১টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহণের একটি যাত্রীবাহী বেপরোয়া বাস নাদিয়াকে বহনকারী মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেলের পেছন থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়েন নাদিয়া। এরপর বাসটি তাকে চাপা দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান নাদিয়া। ঘটনার সাথে সাথে বাস ফেলে চালক কৌশলে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে বাসটি জব্দ করেছে পুলিশ।

এদিকে নাদিয়ার নিহত হবার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিমানবন্দর থানাধীন কাওলা এলাকায় জড়ো হন তার সহপাঠীরা। তারা কাওলা ব্রিজ এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। বিকেল ৪টা থেকে নাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় দোষী চালককে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে তার সহপাঠীরা। এসময় বিমানবন্দর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশ কর্মকর্তাদের আশ্বাস ও অনুরোধে অবরোধ প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীরা।

নাদিয়ার মৃত্যুকে হত্যাকাÐ দায়ী করে শিক্ষার্থীরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়ী চালককে গ্রেফতারের দাবি জানায়। অন্যথায় বৃহৎ আন্দোলনের কর্মসূচিরও দেয়ার কথা জানান তারা। শিক্ষার্থীরা সড়ক দুর্ঘটনার নামে এ ধরনের মানুষ হত্যার পেছেনে পুলিশসহ পরিবহণ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও ঘুষ বাণিজ্যকে দায়ী করেন। চার বছর আগে ২০১৮ সালে দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তখন সরকারের দিক থেকে দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রæতি দেয়ার পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছিল। কিন্তু সড়ক নিরাপদ হয়নি।

গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর বনশ্রী ফরাজী হাসপাতালের সামনে অটোরিকশার ধাক্কায় নিহত হন মোটরসাইকেল আরোহী আশিকুর রহমান (২৫) নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। ওই ঘটনার মাত্র ৫ দিনের মাথায় নিহত হলেন নাদিয়া।

গবেষকরা বলছেন, সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে মৃত্যু বেশি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বিদায়ী ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থী। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে যত মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ শতাংশই ছিলেন শিক্ষার্থী। দিনে অন্তত তিনজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে।

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত হনÑ নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের বাবা শাহ আলম বলেছেন, সরকার এত প্রতিশ্রæতি দিলো, রাস্তায় মৃত্যু কমল না। এটা মানা যায় না। অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো নিয়ে যত আলোচনা, পরামর্শ, তর্কবিতর্ক এর প্রায় সবটাই রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় বসেই দুর্ঘটনা কমানোর নানা প্রতিশ্রæতি দেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা। অথচ ঢাকায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমার বদলে বাড়ছেই। গত বছর সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় ২৭ শতাংশই হয়েছে ঢাকা বিভাগে। এমনকি দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ঢাকার সড়কেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দুটিই এখন সর্বোচ্চ।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সড়কে ১ হাজার ২৩৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে ডিসেম্বরে। বিদায়ী ২০২২ সালের মে, জুলাই, অক্টোবর ও ডিসেম্বর-এই চার মাসের প্রতি মাসেই শতাধিক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে সড়কে। এর মধ্যে মে মাসে ১০৭ জন, জুলাইতে ১০৪ জন এবং অক্টোবরে ১২৩ শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আর গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। অর্থাৎ মোট নিহতের ১৬ শতাংশের বেশি ছিল শিক্ষার্থী।

পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক নিরাপদ করার কথা সরকার মুখে যেভাবে বলছে, বাস্তবে সেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের উদ্যোগে উদাসীনতা দেখা যায়। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে কী করণীয়, তা সরকারের অজানা নয়। কিন্তু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে প্রতিশ্রæতি দিয়েও তা বাস্তবায়নে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী নয়।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথে আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের ফলে নতুন সড়ক পরিবহণ আইন হয়। এরপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায় গত বছরও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে।

রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় ভাটারা থানার ডিউটি অফিসার জানান, নাদিয়ার লাশ মর্গে থেকে অনুমতি সাপেক্ষে নিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তার স্বজনরা। একইসাথে নাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় ভাটারা থানায় সড়ক পরিবহণ আইনে একটি মামলা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Habibullah ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:০২ এএম says : 0
আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে কতজন প্রাণের প্রয়োজন? আগের অনেক ঘটনার জন্য আশা ছিল এরকম। কিছু কি পরিবর্তন হয়েছে? মোটেও না এবং কিছুই পরিবর্তন হবে না কারণ নোংরা মনের রাজনীতিবিদরা এই লেনদেন থেকে অর্থ উপার্জন করছে।
Total Reply(0)
Habibullah ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:০২ এএম says : 0
আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে কতজন প্রাণের প্রয়োজন? আগের অনেক ঘটনার জন্য আশা ছিল এরকম। কিছু কি পরিবর্তন হয়েছে? মোটেও না এবং কিছুই পরিবর্তন হবে না কারণ নোংরা মনের রাজনীতিবিদরা এই লেনদেন থেকে অর্থ উপার্জন করছে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন