ডিসিকে প্রকাশ্যে বদলির হুমকি না দেয়া, ঘন ঘন বদলির আদেশ বাতিল করা, রাজনীতি মুক্ত পরিবেশে দায়িত্ব পালনের অধিকার, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিরোধ কমানো, সকল নির্বাচনের পরে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকাশ ব্যবস্থা না নেয়া,বাজেট বরাদ্দ দেয়াসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে কর্মস্থলে ফিরছেন জেলা প্রশাসকরা। তবে এসব প্রস্তাব পূরণে প্রতিশ্রুতি না পেলেও পেয়েছেন আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিসিদের দায়িত্ব পালন করার, সরকারের বহুমুখী কার্যক্রম সমন্বয় ও তত্ত¡াবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ না করা, মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সজাগ থাকার দায়িত্ব তাদের বলা হয়েছে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িত না হয় সে জন্য সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। যুব সমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে নিদেশনা পেয়েছেন ডিসিরা। ডিসিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ২৫ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়েও ফিরছেন মাঠে ডিসিরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন শেষ। প্রতিবারের মতো এবারও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা নতুন ও পুরনো দাবিগুলোই তুলে ধরেছেন। পেয়েছেন আগের মতোই আশ্বাস। মাঠ প্রশাসনের গতিশীলতা আনতে এবং তৎপরতা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ নির্দেশনা এবং জাতীয় নির্বাচনী বার্তা নিয়ে ফিরবেন ডিসিরা।
মাঠ পর্যায়ে সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার এজেন্ডার অভিযোগ, স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে নানান দাবি-দাওয়া এবং সুপারিশ দাবি করেছেন জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনে (ডিসি সম্মেলন) আলোচনার জন্য ২৪৫টি প্রস্তাব এসেছে ডিসিদের পক্ষ থেকে। ২৬টি অধিবেশনে ৫৭টি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং উপদেষ্টারা পৃথক পৃথকভাবে দিক-নির্দেশনা দেন। এসময় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছ থেকে তাদের দায়িত্ব পালনকালের কি কি বাধা-বিপত্তি, সুবিধা-অসুবিধা এবং প্রয়োজনীয়তার কথা শোনেন এবং সমাধানের প্রতিশ্রæতি দেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, আমরা সরকারের পঞ্চম বছরে আছি। ডিসি সাহেবদের একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছি, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে জনমুখী জনপ্রশাসনের কথা বলে আসছেন। আমরা জেলা প্রশাসকদের মনে করিয়ে দিয়েছি, জাতির পিতার সেই কথাটি- মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। যারা সেবা নিতে আসছেন, তারা তোমাদের ভাই, তোমাদের আত্মীয়। তাদের সম্মান দিয়ে চলতে হবে। আমরা সেটা মনে করিয়ে দিয়েছি। সেবাপ্রার্থীদের সম্মান দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার বিষয়টি জেলা প্রশাকদের (ডিসি) মনে করিয়ে দিয়েছি। ফরহাদ হোসেন বলেন, একজন ডিসির এখন অনেক দায়িত্ব। সেই দায়িত্বগুলো তিনি স্মার্টলি পালন করছেন। আমাদের এখন লজিস্টিক সাপোর্ট ও ডিসি অফিসে সুবিধা অনেক বেশি। বাজেটের আকার বড়। তাদের কাজও করতে হচ্ছে অনেক বেশি। সারাদেশে এক হাজার ৭০০ প্রকল্প চালু আছে। প্রকল্পগুলো সুন্দরভাবে বাস্তবায়নে ডিসিরা আরও বেশি সম্পৃক্ত হবেন, কাজ করবেন। কাজগুলো সুনিপুণভাবে করতে হবে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
এবার ডিসি সম্মেলনে টাঙ্গাইলে বদলির আগে জসীম উদ্দিন হায়দার ছিলেন বরিশালের ডিসি। সেখানে দায়িত্ব পালনের সময় বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ভোটকেন্দ্রে বির্তক এবং এর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শুভেচ্ছা ব্যানার অপসারণসহ নানা ঘটনা ঘটে। এতে জড়িয়ে পড়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনসহ গোটা প্রশাসন। এসব ঘটনার বেশ কিছু দিন পর বরিশালের ওই সময়ের ডিসি জসীম উদ্দিন হায়দারকে টাঙ্গাইলে বদলি করা হয়। একজন ডিসি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অঞ্জনা আর জসীমের বিষয় দুটিই প্রমাণ করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমেছে। গত এক বছরে কেবল তাদের দুজনকেই স্থানীয় রাজনীতিবিদের চাপে সরাতে হয়েছে। তারপরও তাদের প্রত্যাহার করা হয়নি। এক জেলা থেকে সরিয়ে অন্য জেলায় দেওয়া হয়েছে। সরকার যদি মনে করত তারা অপরাধী, তাহলে তাদের প্রত্যাহার করা হতো। রাজনৈতিক চাপের কারণে তাদের কেবল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অঞ্জনা খান মজলিস আর জসীম উদ্দিন হায়দার ছাড়াও গত বছর আলোচনায় ছিলেন নাফিসা আরেফিন। গত বছরের ৫ জানুয়ারি নাফিসাকে নীলফামারীর ডিসি হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু ঘটনার এক সপ্তাহ না যেতেই নাফিসার ডিসি পদের নিয়োগ বাতিল করা হয়। নাফিসা সম্পর্কে অভিযোগ ছিল, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শামসুন্নাহার হল ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ ওঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নতুন নিয়োগ পাওয়া ডিসিদের জন্য আয়োজিত ব্রিফিংয়েও তাকে ডাকেনি।
গত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমলাতন্ত্র দৃষ্টিকটুভাবে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করছে বলে অভিযোগ রাজনীতিবিদদের। তাদের মতে, আমলাদের কেউ কেউ নিজেদের মূল দায়িত্ব ভুলে দলীয় কর্মীর মতো কাজ করছেন। অনেকেই মনে করেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাতেই তারা নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবতে শুরু করেছেন। ক্ষমতায় আসতে নেতাকর্মী, জনগণের ভোটের গুরুত্ব কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতেও রাজনীতিবিদদের প্রভাব কমেছে। তোফায়েল আহমেদের মতো রাজনীতিবিদও সংসদে আমলাদের বাড়াবাড়ি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। তোফায়েল আহমেদের মতো ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদও রাজনীতিবিদদের অসহায়ত্বের কথা বলেন সংসদে। এস বিষয় গুলো তুলে ধরেছেন ডিসিরা।
সংসদের বাইরে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, ‘আমলাতন্ত্রের বিকল্পও তো নেই। কেউ আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিকল্প বের করতে পারেনি। চীনারা পারেনি। ফেরাউনও পারেনি। খলিফারাও পারেননি। সেই মহান আমলাতন্ত্র আমাদের মধ্যেও আছে।’
এবার জেলা প্রশাসক সম্মেলন স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত ২৩টি প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এরপর ভূমি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রস্তাব ১৫টি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রস্তাব ১৩টি, সুরক্ষা সেবা বিভাগ সংক্রান্ত ১১টি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রস্তাব ১০টি। ডিসি সম্মেলনের প্রধান আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম জোরদারকরণ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন ও দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার এবং ই-গভর্ন্যান্স, শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণরোধ, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় বিষয়ে উপর আলোচনা।
গত বছর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে ডিসিদের দেওয়া অনেক প্রস্তাবের মধ্যে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ২৪২টি আমলে নিয়ে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর মধ্যে ১৭৭টি বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ৬৫টি প্রস্তাব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে আবারও গত ২৪ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন শেষ হয়েছে। এবার বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং নির্দেশনা গ্রহণের পাশাপাশি স্পিকার ও প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, নির্দেশনা গ্রহণ ও মতবিনিময় করেছেন ডিসিরা। তাছাড়া সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সামরিক-বেসামরিক সমন্বয় বিষয়ক অধিবেশন হয়েছে। এরারে জেলা প্রশাসক সম্মেণনে চার বিভাগীয় কমিশনা ও ২১ জেলার ডিসি বক্তব্য রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর কাযালয়ের অধিবেশন ছাড়া প্রতিটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মো, মাহবুব হোসেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন