অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর বিধান অনুযায়ী, নাবালকের স্বাভাবিক এবং আইনগত অভিভাবক হলেন পিতা। পিতার অনুপস্থিতিতে বা অভিভাবক হিসেবে অযোগ্যতায় মাতা অথবা আদালতে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োজিত ব্যক্তি নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক হতে পারেন। তবে নাবালকের সার্বিক মঙ্গল ও কল্যাণের গুরুত্বের ওপরে ভিত্তি করে তার জিম্মাদারিত্বের বিষয়ে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন অনুযায়ী সন্তানের মাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশুকে সাত বছর এবং মেয়েশিশুকে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মা তার জিম্মায় রাখার অধিকারী। তবে মা বা নাবালক সন্তান যার তত্ত¡াবধানেই থাকুক না কেন সন্তানের খোঁজখবর নেওয়া, দেখাশোনা করা এবং ভরণপোষণ দেবার দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে সন্তানের পিতার।
পিতা যদি সন্তানকে নিয়মিত ভরণপোষণ দেন, সেক্ষেত্রে সার্বিক কল্যাণ। যেহেতু পিতা নিয়মিত সন্তানের ভরণপোষণ দিচ্ছেন, সেহেতু সন্তানকে পিতার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতে দিতে এখানে আইনী বাধা নেই। মায়ের জিম্মায় সন্তান থাকা অবস্থায় বাবা যদি কোনো ভরণপোষণ না দেন, সে ক্ষেত্রে মা সন্তানকে পিতার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করাতে বাধ্য নন বলে বিভিন্ন মামলার রায়ে অভিমত প্রদান করা হয়েছে (১৭ ডিএলআর ১৩৪)। কিন্তু এ মামলাটি ব্যতিক্রম।
অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ১৯ ধারায় অভিভাবক হিসেবে পিতাও অযোগ্য হতে পারেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যদি বাবা চারিত্রিকভাবে অসৎ হন, সন্তানের মা অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতা করেন, মাদকাসক্ত এবং অধার্মিক হন, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন, প্রকাশ্যে লাম্পট্য করেন, দুস্থ অথবা নিঃস্ব হন অথবা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি থাকে এবং নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অবহেলা করেন।
অভিভাবকের অন্যতম দায়িত্ব হলো, প্রতিপাল্য অর্থাৎ নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ অন্যান্য সকল ব্যাপারে নৈতিক এবং অর্থনৈতিক সকল সুবিধা প্রদান করা। মুসলিম আইনে বাবা হলেন নাবালক সন্তানের শরীর ও সম্পত্তির স্বাভাবিক অভিভাবক। বাবার অভিভাবকত্বের ব্যাপারে তার অধিকারের সমর্থনে আদালত কর্তৃক কোনো আদেশ প্রদানের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলেও পিতাই নাবালক ও তার সম্পত্তির অভিভাবক হওয়ার অধিকারী। পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ-১৯৮৫ এর ৫ ধারা মতে, সন্তানের কাস্টডির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার একচ্ছত্র এখতিয়ার আদালতের।
কী কী কারণে মা সন্তানের জিম্মাদারিত্ব হারায়
১. নীতিহীন জীবনযাপন করলে, ২. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে ও দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে, ৩. বিয়ে থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে, ৪. যদি সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে, ৫. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেয়।
জধসবংয া. ঝসঃ খধীসর ইধর ১৯৯৯, ঈৎর খঔ ৫০২৩ মামলায় ৯ বছরের ছেলে বাবার সঙ্গে বসবাস করার সময়ে ওই শিশুর মা আদালতে সার্চ ওয়ারেন্ট মামলা আনয়ন করেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, বাবার কাস্টডি হতে মায়ের কাস্টডিতে শিশুকে নেওয়ার উদ্দেশ্যে সার্চ ওয়ারেন্ট আকৃষ্ট করে না বিধায় ওই মামলা চলতেই পারে না।
ঝযৎর অঃধহঁ ঈযধশৎধনড়ৎঃু াং ঞযব ঝঃধঃব ঙভ ডবংঃ ইবহমধষ ্ অহৎ (ঈ.জ.জ. ঘড়. ৩৮৭০ ড়ভ ২০০৯) মামলায় ৪ বছরের ছেলে-সন্তানকে বাবার কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য মা কর্তৃক সার্চ ওয়ারেন্টের আবেদনের ভিত্তিতে ভারতের বিধাননগরের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু করে পুলিশকে নির্দেশ দেন ওই নাবালককে উদ্ধার করে আদালতে হাজির করতে এবং বাবাকেও হাজির থাকতে। সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু সংক্রান্ত ওই আদেশের বিরুদ্ধে নাবালকের বাবা কলকাতা হাইকোর্টে ক্রিমিনাল রিভিশন দায়ের করেন। ক্রিমিনাল রিভিশন মামলার রায়ে বাবার কাস্টডি থেকে নাবালক ছেলেকে উদ্ধারের জন্য দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সার্চ ওয়ারেন্ট সংক্রান্ত আদেশ আইনসম্মত নয় বিধায় বাতিল করা হয়। হাইকোর্ট বলেন, বাবার বিরুদ্ধে অন্যায় আটক অভিযোগ আনয়ন করা হয়েছে, যেখানে ঐরহফঁ গরহড়ৎরঃু ধহফ এঁধৎফরধহংযরঢ় অপঃ, ১৯৫৬-এর ৬ ধারা মতে, ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে বাবা এবং বাবার পরে মা হলো স্বাভাবিক অভিভাবক। নাবালক ছেলের বয়স ৫ বছর পূর্ণ না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে মায়ের কাস্টডিতে থাকার কথা। আদালতের আদেশ লঙ্ঘন না করে থাকলে, ৫ বছরের কম বয়সী নাবালক ছেলে তার বাবার কাস্টডিতে থাকলে তাকে অন্যায় আটক বলা যাবে না। ওই মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আদালত বলেন, বাবার সঙ্গে নাবালক ছেলের বসবাস থাকায় সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যুর প্রশ্নই আসে না। পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, এঁধৎফরধহ ্ ডধৎফং অপঃ, ১৮৯০-এর বিধান মতে, নাবালকের কাস্টডির জন্য পক্ষদ্বয় উপযুক্ত দেওয়ানি আদালতে যেতে পারেন। দেওয়ানি আদালতের সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত মা ৪ বছরের নাবালক ছেলের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবেন কি-না, এই প্রশ্নের বিষয়ে উচ্চ আদালত তার সহজাত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বলেন, উপযুক্ত দেওয়ানি আদালতে নাবালকের তত্ত¡াবধান বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত নাবালক তার বাবার কাস্টডিতেই থাকবে।
‘ইমামবন্দি বনাম মুসাদ্দির ২২ ডিএলআর, পৃষ্টা ৬০৮’ মামলায় বলা হয়েছে, ‘মুসলিম আইনে সন্তানের শরীরের ব্যাপারে লিঙ্গভেদে কিছু বয়স পর্যন্ত মা তত্ত¡াবধানের অধিকারীনি। মা স্বাভাবিক অভিভাবক নন। একমাত্র পিতাই বা যদি তিনি মৃত হন তাঁর নির্বাহক আইনগত বা বৈধ অভিভাবক।’ তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে মা এ অধিকার হারাবেন। (হেদায় ১৩৮, বেইলি ৪৩৫)।
তবে আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডি এল আর এর মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে, সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন। ব্যক্তিগত আইন এবং কল্যাণ মতবাদ অভিভাবকের ক্ষেত্রে মতবিরোধ সৃষ্টি করলে কল্যাণ মতবাদই প্রাধান্য পাবে। (আয়শা খানম বনাম অন্যান্য বনাম সাব্বির আহমেদ এবং অন্যান্য, ৪৬ ডিএলআর হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা ৫৯৯)।
উল্লেখ্য, মার হেফাজত থাকাকালে নাবালক পুত্রের সাথে বাবার সাক্ষাতের অধিকার অস্বীকার করা যায় না। অভিভাবকত্ব নিয়ে মামলা চলাকালে সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করে বাবা যাতে তার সন্তানকে নিয়মিত দেখতে পায় তজ্জন্য বাবা-মার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার বিষয়টি পারিবারিক আদালত বিবেচনায় নিতে পারেন (আক্তার মাসুদ বনাম মিসেস বিলকিস জাহান ফেরদৌস, ৫০ ডিএলআর, আপিল বিভাগ, পৃষ্ঠা ১৪৫)।
অনেক সময় সন্তানের যদি ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সন্তানের মতামতকেও আদালত গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এ জন্য প্রয়োজন হলে সন্তানকে আলাদা করে বিচারক নিজের কাছে নিয়ে তার মতামত জেনে নিতে পারেন। আবার মা-বাবা পর্যায়ক্রমে সন্তানকে কাছে রাখা কিংবা একজনের কাছে থাকলে অন্যজনকে দেখা করার অনুমতিও দিয়ে থাকেন। পারিবারিক আদালতে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানকে কাছে রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। তবে সবার মনে রাখার দরকার, ‘বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করে’।
বাংলাদেশে ঋধসরষু ঈড়ঁৎঃং ঙৎফরহধহপব, ১৯৮৫-এর ৫ ধারা মতে, সন্তানের কাস্টডির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একচ্ছত্র এখতিয়ার পারিবারিক আদালতের। আর কাস্টডি প্রদানের ক্ষেত্রে আদালত কী কী বিবেচনা করবেন, সেগুলো এঁধৎফরধহং ধহফ ডধৎফং অপঃ, ১৮৯০-এর ১৭ ধারায় বিস্তারিত বলা রয়েছে। ওই ধারার বিধান মতে, নাবালক-নাবালিকা যে ধর্মীয় অনুশাসনের অধীন, সেই অনুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এবং তার সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি বিবেচনা করে আদালত অভিভাবক নিয়োগ করবেন। নাবালক-নাবালিকার কল্যাণ কী হবে, তা নির্ধারণ হবে নাবালক-নাবালিকার বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, প্রস্তাবিত অভিভাবকের চরিত্র, সামর্থ্য ও নাবালকের সঙ্গে নৈকট্য ও আত্মীয়তার সম্পর্ক, মৃত মা-বাবার কোনো ইচ্ছা (যদি থাকে) এবং প্রস্তাবিত অভিভাবক নাবালক-নাবালিকার সম্পত্তির বিষয়ে সম্পর্কযুক্ত কি-না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে। এতদবিষয়ে নাবালক-নাবালিকার কোনো বুদ্ধিদীপ্ত মতামত থাকলে আদালত সেই মতামতকে প্রাধান্য দেবেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন