পুরান ঢাকার বাসিন্দা ইশরাক হোসেন। টগবগে যুবক। মেটালক্রাফট কেমিক্যালের মালিক তার বাবা। দুই ভাইয়ের মধ্যে ইশরাক বড়। বাবার সঙ্গে ওই ব্যবসাই দেখভাল করত সে। গত ২৫ জানুয়ারি। রাত সোয়া ১টা। সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘটে যায় বড় দুর্ঘটনা। যা কেড়ে নেয় ইশরাকের জীবন। ঘটনার সময় নিজের বাইকে চেপে হাতিরঝিলের লেক ধরে রামপুরার দিকে গন্তব্য ছিল তার। ফাঁকা রাস্তা। তাই বাইকের গতিটা একটু বেশিই ছিল। হঠাৎই বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সজোরে ধাক্কা লাগে রাস্তার ধারে বাইক উল্টে নিচে চাপা পড়ে ইশরাক। তার সুঠাম দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। উঠে দাঁড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা। চিৎকার করছে। হাতের ইশারায় বাঁচার আকুতি। অথচ পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে পথচারী। দ্রæত বেগে ছুটে চলছে প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাসসহ কত যানবাহন। অথচ ইশরাকের আবেদনে সাড়া নেই কারো। পথচারী ক্ষণিক থমকে দাঁড়িয়েছে সেখানে। কেউ এ মর্মান্তিক দৃশ্যের ছবি তুলছে কেউবা করছে ভিডিও। এভাবেই সময় পার হতে থাকে। শেষমেষ এক মানবিক যুবক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। অচেতন ইশরাককে রিকশায় করে নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান বাবা-মা ও স্বজনরা। সেখানে ইশরাকের মায়ের আর্তচিৎকার, অপরদিকে নির্বাক তার বাবা। স্বজনরা ব্যস্ত লাশ নেয়ার প্রস্তুতি সারতে।
দীর্ঘ সময় রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে এবং পথচারীদের ছবি তোলার বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর মানুষের মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের কথা বলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে আমরা কি হারাতে বসেছি সামাজিক, ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধ। নিহতের ছোট ভাই ইফতেখার হোসেন জানান, রাতে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন নিকেতনে এক বন্ধুর বাসায় যাবেন বলে। বাসায় মোবাইল ফোন রেখে গিয়েছিলেন। পরে সেখান থেকে বাসায় ফিরছিলেন। রাতে তার মোবাইলে কল আসছিল। ওই ফোন কলের মাধ্যমে খবর পাই তিনি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। ইশরাক ঢাকার ওয়ারী ৮ নম্বর গুপি কিষাণ লেনের স্থায়ী বাসিন্দা ইমরান হোসেনের ছেলে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, দুর্ঘটনার পর দ্রæত চিকিৎসা পেলে হয়তো এভাবে অকালে চলে যেতে হতো না ইশরাকের মতো একজন যুবককে। এজন্য কাকে দায়ী করা যায়। কেনবা পথচারীরা এগিয়ে এলো না। এ প্রশ্œই যেন ঘুরপাক খাচ্ছে।
মানুষের এহেন অমানবিক হওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, দিনের পর দিন আমাদের মানসিকতা ও মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন নীতি এবং আসলে আমরা পুঁজিবাদকে মূল জায়গায় নিয়ে এসেছি। আমাদের মানষিকতা এখন প্রত্যেকটা জিনিসই পণ্য, যখন কোনো জিনিসের অর্থনৈতিক মূল্য থাকে বা বিক্রয়যোগ্য করে গড়ে তোলা হয়, তখন অন্যেরা এ জিনিসকে তাৎপর্য হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু যখন এর কোনো বিক্রয়মূল্য থাকে না, তখন এর কোনো গ্রহণযোগ্যতাও থাকে না। আমাদের স্বাধীনতার ঠিক কিছু আগে থেকেই আস্তে আস্তে এটার বিস্তার ঘটতে শুরু করে। পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের এদিকে নিয়ে এসেছে।
তিনি আরো বলেন, পূর্বে আমাদের একটা সুন্দর সম্প্রদায়ভুক্ত জীবন ছিল। যেটাকে বলে কমিউনিটি লাইভলিহুড। যেখানে আমরা একে অপরের সবকিছু শেয়ার করতাম। ছিল পারিবারিক ও সামজিকবন্ধন। সুখে দুখে একে অপরের সঙ্গী হয়ে থাকতাম। যা ছিল ইসলামী মূল্যবোধের সাথে প্রচÐ রকমের ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু পরিকল্পিতভাকে পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে গেছে। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যতই পুঁঁজিবাদের দিকে যাবে, ততই বেশি এখান থেকে তারা মুনাফা লাভ করতে পারবে বহুজাতিক কোম্পানীর মতোই। তারা আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য বা সমাজব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আধুনিকায়নের চেষ্টা করছে। এ অবস্থার মধ্যে আমাদের মধ্যে এমন একটা মূল্যবোধের পরিবর্তন আসছে যে, আমরা প্রত্যেকেই চিন্তা করি আমরা কার সাথে কথা বললে আমাদের কী ধরনের লাভ হবে। যে পথচারীরা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করা ওই যুবকের দৃশ্যের দিকে তাকিয়েছে তাদের চোখ হয়তো ওই যুবকের মানিব্যাগের দিকেই ছিল।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এখনো মানবিকতা রয়েছে, তবে সে মানুষগুলো দরিদ্র মানুষ। বড় লোক যারা তারা প্রচÐ রকমের নিজের রিটার্ন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করেন। আমাদের মমত্ববোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটাই মূল কারণ। তাছাড়া আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যে পর্যায়ে চলে গেছে, সেখানে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কেউই উল্টো হ্যারেসমেন্ট হতে চাইবে না। কারণ পুলিশ এখন উল্টো হয়রানি করে।
ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের পরিবার প্রথা ভেঙে যাচ্ছে। যে কারণে সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের থেকে কমতে শুরু করেছে। আগের মতো পারিবারিক প্রথা যেমন বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করার রেওয়াজ নেই। এখন আমরা ব্যক্তি স্বার্থের কথা চিন্তা করি, নিজের বেনিফিট নিয়ে চিন্তা করি। যে কারণে বড় স্বার্থ যেমন পরিবার ও সমাজের কথা ভুলে যাই। দেশে যেহেতু এক ধরনের রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতাও বলতে পারি সেহেতেু মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারে না। জেনারেশনের একটা বড় অংশ ইন্টারনেটের দিকে এতই ঝুঁকে পড়েছে যে, তাদের ফিজিক্যালি কোন অ্যাকটিভিটিজ নেই। তারা সামাজিকভাবেও কোনো কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকতে চায় না। দেশে আগে ছোট ছেলে-মেয়েরা মাঠে খেলাধুলা করত, এখন সব কিছুই মোবাইল ফোনকেন্দ্রিক। যে কারণে তারা মানবিক মূল্যবোধ শিখছে না। আমরা যেভাবে পরিবার থেকে ও সমাজ থেকে মূল্যবোধ বিষয়টি রপ্ত করেছি এখন সেটা অনুপস্থিত। তাদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই।
তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ থেকেই শিশুদের মানবিক মূল্যবোধের ওপর হাতে-কলমে শিক্ষা দেয়া উচিত। প্রয়োজনে এ ধরনের একটি সাবজেক্ট বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে তাদের নেতা-নেত্রীর ওপর সেøাগান দেয়। ঠিক সেভাবে ভালো কিছুর সেøাগান থাকা এবং কর্মপরিকল্পনা থাকা উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন