শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কৃষির বিরুদ্ধে চক্রান্ত রুখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বিশ্বজুড়ে কৃষিই খাদ্যের জোগান দেয়। অধিকাংশ শিল্পের কাঁচামালেরও জোগান আসে কৃষি থেকে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান ছাড়াও কৃষি বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। করোনাকালে বিশ্বব্যাপী সব কিছু বন্ধ ও অচল হয়ে গেলেও কৃষি ছিল বহাল ও সচল। খাদ্যসংস্থানের পাশাপাশি তখন কৃষিই অর্থনীতিকে যতটা সম্ভব গতিশীল রাখে। অর্থনীতিবিদরা সব সময়ই কৃষিকে সামনে রাখেন। জীবনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী খাদ্য। এর চাহিদা ক্রমবর্ধমান। বিশ্বে জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে খাদ্যের চাহিদা। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য পণ্যচাহিদাও বাড়ছে। তারও বেশির ভাগের উপকরণ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এখন এটাও লক্ষ করার বিষয়, খাদ্য উৎপাদন নানা কারণে কমছে। কৃষি জমির পরিমাণ কমছে। জমির উৎপাদনশীলতা কমছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যহত হচ্ছে। আফ্রিকা সব সময় খাদ্য সংকটে আছে। এখনও দুর্ভিক্ষের আশংকা আছে কয়েকটি দেশে। বিশ্বে খাদ্য রাজনীতি বরাবর সক্রিয়। যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদার অনেক বেশি খাদ্য উৎপাদিত হয়। খাদ্য বাণিজ্যে দেশটি শীর্ষে। দেখা গেছে, বাণিজ্যিক স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য উৎপাদন কমিয়েছে। এ জন্য কৃষকদের ভর্তুকি দিয়েছে। অনেক সময় উৎপাদিত খাদ্যশস্য নষ্টও করে দিয়েছে। খাদ্যমূল্য চাঙ্গা রাখার জন্যই এসব করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বব্যাপী কৃষির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। তৃতীয় বিশ্বের কৃষি প্রধান দেশগুলোতে তারা কম মূল্যে জমি কিনে আবাদ বিস্তার করছে। কৃষকদের ঋণ ও উপকরণ সহায়তা দিচ্ছে। বীজের ওপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব নিশ্চিত করছে। এভাবে কৃষি উৎপাদন ও অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে কবজা করে নিচ্ছে। বলা হয়, উপনিবেশবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু কার্যত অন্যভাবে অন্যদিক দিয়ে উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদ জারি আছে। কৃষি দখল করার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঁয়তারা ও অপচেষ্টার মধ্যে উপনিবেশবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের প্রকাশই লক্ষ করা যায়।

আমাদের দেশও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টির বাইরে নেই। জমি দখলের চেষ্টা এখানেও হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকেরা জমি কিনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা নানাভাবে কৃষকদের সহায়তা করছে। এক ধরনের বীজ তারা মার্কেটিং করছে, যা উচ্চ ফলনশীল। জেনিটিক্যালি মোডিফায়েড অর্গানিক (জিএমও) নামের ওই বীজে উৎপাদিত শস্য থেকে নতুন বীজ তৈরি হয় না। বীজ একবারই ব্যবহারযোগ্য। নতুন করে আবাদ করতে হলে বীজ যারা মার্কেটিং করেছে, তাদের কাছেই ধরনা দিতে হবে। এভাবে বীজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। যেহেতু ফসল বেশি সুতরাং কৃষকরা বেশি উৎপাদনের আশায় ওই বীজের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশি বীজ ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ধানের অনেক বীজ লোপ পেয়েছে। অন্যান্য ফসলের বীজও। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সার-কীটনাশক ও জৈবপ্রযুক্তিতে তৈরি বীজ ব্যবহারের ফলে আবাদী জমির প্রকৃতি নষ্ট হচ্ছে, উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর একটা সীমা আছে। এমন একটা সময় আসতে পারে, যখন জমিতে সার-কীটনাশক, এমন কি অধিক ফলনশীল বীজ ব্যবহার করেও উৎপাদন এতটুকু বাড়ানো যাবে না। জমি বন্দাত্ত হয়ে যেতে পারে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত বীজে উৎপাদন বেশি হলেও সেটা মানুষের জন্য কতটা নিরাপদ, কতটা উপযোগী, তা উপযুক্ত পরীক্ষায় পরীক্ষিত নয়। জানা যায়, উন্নত দেশগুলোতে জিএমও বীজ ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সেই নিষিদ্ধ বীজই মার্কেটিং করা হচ্ছে, তার আবাদ-উপাদন হচ্ছে। এর চেয়ে ক্ষতিজনক আর কী হতে পারে?

আমাদের দেশে আবাদী জমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। বসতবাড়ি, শিল্পকারখানা, রাস্তাঘাট নির্মাণে আবাদী জমি ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন ইত্যাদিতে ফসলি জমি বিলীন হচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, গত ১১ বছরে ৪ লাখ ১৬ হাজার একর আবাদী জমি কমেছে। অন্য এক হিসাবে দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে ৬৬ হাজার একর জমি কমেছে। আর নদী ভাঙনে গত সাড়ে চার দশকে ১ হাজার ৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়েছে বলে আরেক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবছর আবাদী জমিই শুধু কমছে না, কমছে জমির উৎপাদনশীলতাও। তারপরও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, গত ৫০ বছরে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্যশস্য উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। এতে মানুষের খাদ্যের সংস্থান হয়েছে। সরকারের দাবি, দেশ খাদ্য স্বয়ম্ভরতা লাভ করেছে। এ দাবির সত্যতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কারণ, প্রতি বছরই লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। তাছাড়া চাল-আটার দামও আকাশছোঁয়া, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। আমাদের দেশে আমন উৎপাদন আশাব্যঞ্জক হলেও বোরোর উৎপাদন ব্যহত হতে পারে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ার কারণে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশংকিত বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতির বিবেচনায় প্রতি ইঞ্চি জমি উৎপাদনে ব্যবহারের তাকিদ দিয়েছেন। সরকার কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। যে কোনো মূল্যে আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আগামীতেও এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। এমতাবস্থায়, আবাদী জমি রক্ষা করতে ও বাড়াতে হবে। জমির উৎপাদনশীলতা ধরে রাখতে হবে। সার, কীটনাশক ইত্যাদি ব্যবহার কমাতে হবে। জিএমও বীজ ব্যবহার রহিত করতে হবে। দেশি বীজের উন্নয়ন ও আবাদ বাড়াতে হবে। আশার কথা, অর্গানিক খাদ্যশস্যের প্রতি মানুষের ঝোঁক ও সচেতনতা বাড়তে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণা ও সহায়তা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ-কারবার সম্পর্কে মানুষকে অবহিত ও সচেতন করতে হবে। তাদের যে কোনো চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
রুবেল ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১:২৫ এএম says : 0
একটা সময় আমরা কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু আজ বেশিরভাগ জমিই অবৈধভাবে দখল ও মাটি কাটা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের চাপে অনেকে মুখ খূলে না
Total Reply(0)
রাজিব ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১:২৫ এএম says : 0
কৃষিকে বাঁচাতে এখনই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে
Total Reply(0)
আমজাদ ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১:২৬ এএম says : 0
কৃষি জমে কমে গেলে এ দেশ সংকটে পড়ে যেতে পারে। তখন আমরা অন্য দেশের উপর বেশি ডিপেন্ট হয়ে পড়বো
Total Reply(0)
Rezaul Karim ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১:২৭ এএম says : 0
আশা করি সরকার কৃষি জমি বাঁচানোর জন্য হস্তক্ষেপ করবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন