শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

সার গায়েব নদীতে

৪০ কোটি টাকা পণ্য নিয়ে ডুবে গেছে জাহাজ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ বিএডিসির কর্মকর্তারা জড়িত আমি কোন দুর্নীতি করি নাই -বিএডিসির ড. আব্দুস সামাদ

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

চলতি বোরো মৌসুমে দেশের কৃষকদের সব ধরনের সারের সরবরাহ নির্বিঘœ করতে সরকার যখন প্রস্তুতি নিচ্ছে; তখন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) ৫০০ মেট্রিক টন সার (যার মূল্য ৪০ কোটি টাকা) নদীতে গায়েব হয়ে গেছে। দাবি করা হচ্ছে মোংলা বন্দরের হারবাড়িয়া এলাকায় সারবোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবে গেছে। সার বোঝাই জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় চালকের গাফিলতি এবং বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে বলে তথ্য পেয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটি। এ ঘটনা বিএডিসির সদস্য পরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) ড. আব্দুস সামাদ এবং সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রকল্প পরিচালক মজিবর রহমান জড়িত রয়েছে এ ঘটনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবকে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ে লিখিত দিয়েছেন ব্রক্ষপুত্র ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড ডেটিং কোম্পানী নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কৃষিবিদ এম এ মুজিদ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) ৫০০ মেট্রিক টন সার (যার মূল্য ৪০ কোটি টাকা) মোংলা বন্দরের হারবাড়িয়া এলাকায় সারবোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনার রহস্য আছে কি না তা ক্ষতিয়ে দেখার দরকার। তিনি বলেন, অনেক সময় সার না এনে সরকারি টাকা লুটপাট করা হয়। আবার খারাপ সার এনে নদীতে বছর পর বছর জাহাজ রাখা হয।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদকে এ বিষয় ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেনি। এ বিষয়ে বিএডিসির সদস্য পরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) ড. আব্দুস সামাদ ইনকিলাবকে বলেন, মের্সাস বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি: মাধ্যমে আনা ৫০০ মেট্রিক টন সারে লাইটার জাহাজটি ডুবে গেছে। আমি কোন দুর্নীতি করি নাই।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মের্সাস বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লি: মাধ্যমে ৫০০ মেট্রিক টন সার নিয়ে শাহাজালাল এক্সপ্রেস-২ লাইটার জাহাজটি যশোরের নওয়াপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। হারবাড়িয়া-৮ এলাকায় সুপ্রিম ভ্যালর নামের একটি বিদেশি জাহাজকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করে জাহাজটি। এ সময় ঘন কুয়াশায় লাইটার জাহাজটি বিদেশি ওই জাহাজকে ধাক্কা দেয়। এতে জাহাজটির নিচের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইঞ্জিনরুমে পানি ঢুকে পড়ে। আতঙ্কিত হয়ে জাহাজের নয় জন কর্মচারী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পান বলে জানা গেছে।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়, বিএডিসির সদস্য পরিচালক (সার ব্যবস্থাপনা) ড. আব্দুস সামাদ ১৪০ কোটি টাকার সার লুটপাট করেছেন। বিএডিসির সার বোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনায় সরকারে ৫০০ মেটিক টন যার যার মূল্য ৪০ কোটি টাকা মালামাল মের্সাস বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটিডের নিয়ে আসার জন্য কার্যা আদেশ দেয়া হয়। এছাড়া বিএডিসির গত ২০২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর আমদানীকৃত ১ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন সার বিদেশ ধেতে আমদানী করা হয়। যার মূল্য ১৪০ কোটি টাকা। কিন্তু সেই সার এখন বিএডিসির কোনো সরকারি গুদামে নেই। বিএডিসির সার পরিবহন খাতে গত বছর অক্টোবর মাসে ৮৩.৯১ কোটি টাকার ছাড় প্রদান করা হয়। কিন্তু ড. সামাদ কমিশন না পাওয়ার কারণে সেই টাকা কয়েক মমাস আটকে রাখেন। পরে ঠিকাদাররা ৩% কমিশন ছাড়া দেয়ার পরে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গুলোকে বিল প্রদান করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। ২৫জন পরিবহন ঠিকাদারের মধ্যে মের্সাস নেয়াপাড়া, মের্সাস তাইবা সাইফুল্লাহ একই মালিক ২৭.৭৬ কোটি টাকা বিল প্রদান করা হয় এবং মের্সাস বাল্ক টেডা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটিড ও মের্সাস দেশ টের্ডিক কপোরেশনকে ২৮ দশমিক ৫০ কোটি টাকার বিল প্রদান করা হয।
তবে গাফিলতির ঘটনায় অভিযুক্ত জাহাজচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে মোংলা বন্দরের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ বলেন, বর্তমানে ওই নৌ-চ্যানেল নিরাপদ আছে। ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে ডুবে যাওয়া সারবোঝাই লাইটার জাহাজ এমভি শাহাজালাল এক্সপ্রেস-২-এর চালক ওবায়দুর রহমানের গাফিলতি পাওয়া গেছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওই সময় ঘন কুয়াশা থাকায় চালকের উচিত ছিল জাহাজটি না চালিয়ে কোনও এক জায়গায় নোঙর করে রাখা। কিন্তু সেটি না করে হারবাড়িয়া-৯ এলাকায় এমভি ভিটা অলিম্পিক জাহাজ থেকে ৫০০ মেট্রিক টন সারবোঝাই করেন এমভি শাহাজালালের চালক। ওই ৫০০ মেট্রিক টন সার নিয়ে লাইটার জাহাজটি যশোরের নওয়াপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। হারবাড়িয়া-৮ এলাকায় ‘সুপ্রিম ভ্যালর’ নামের একটি বিদেশি জাহাজকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করেন চালক। এ সময় ঘন কুয়াশায় লাইটার জাহাজটি বিদেশি ওই জাহাজকে ধাক্কা দেয়। এতে সার নিয়ে লাইটারটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় গত ২৫ জানুয়ারি ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করে বন্দর কর্তৃপেক্ষের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি। বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহাদাৎ হোসেন, পাইলট ফারুক আহম্মেদ এবং মেরিন বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী মো. রিয়াদ খাঁন তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন।
ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ বলেন, দুর্ঘটনার পর বন্দরের নৌ-চলাচলের চ্যানেল স্বাভাবিক আছে। ডুবে যাওয়া লাইটার জাহাজের সার্ভে সনদ ও রেজিস্ট্রেশন সবই ঠিক আছে। ডেপুটি হারবার মাস্টারের নেতৃত্বে একটি দল দুর্ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করেছেন। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ডুবে যাওয়া জাহাজটি উদ্ধারের জন্য মালিকপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডুবে যাওয়া এমভি শাহাজালাল এক্সপ্রেসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ভাই ভাই শিপিং লাইন্সের পরিচালক আজাহার সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, জাহাজটি ডুবে যাওয়ার ঘটনায় চালক ওবায়দুর রহমানের গাফিলতি ছিল না। তিন দক্ষ চালক। অন্য কোনও কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দুর্ঘটনার যে কারণ বন্দর কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছেন তার ব্যাখ্যায় আজাহার সিদ্দিক বলেন, কোনও বিদেশি জাহাজ থেকে পণ্যবোঝাইয়ের পর সেখানে এক মুহূর্ত থাকতে দেওয়া হয় না। কাজেই সেখান থেকে অন্যত্র অবস্থান নেওয়ার জন্য ঘন কুয়াশায় জাহাজটি চালিয়ে স্থান খুঁজছিলেন চালক। তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের বেঁধে দেওয়া ১৫ দিনের মধ্যে লাইটার জাহাজটি উঠানো সম্ভব হবে না। আরও অনেক সময় লাগবে। জাহাজ থেকে সার সরাতেই এক সপ্তাহ সময় লাগবে। পরে জাহাজ তোলার কাজ শুরু করতে হবে।
এর আগে মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে মোংলা বন্দরের হারবাড়িয়া এলাকায় সারবোঝাই এমভি শাহাজালাল এক্সপ্রেস-২ নামের লাইটার জাহাজটি ডুবে যায়। জাহাজে নয় জন কর্মচারী ছিলেন। সবাইকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে হারবাড়িয়া নৌ-চ্যানেলে সারবোঝাই লাইটার জাহাজ ডুবে যাওয়ার ফলে জলজ সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ওই জাহাজের জ্বালানি তেল পানিতে মিশে সুন্দরবনের আশপাশের পরিবেশ দূষণ করবে। একইসঙ্গে বারবার লাইটার জাহাজ ডুবির ফলে বন্দরের নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি পাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন