‘দিকে দিকে নিনাদিত শ্রদ্ধানত জনতার নিযুত সালাম
মাওলানা মান্নান এক কালজয়ী পুরুষের নাম’
সত্যিই মাওলানা এম এ মান্নান এক কালজয়ী পুরুষেরই নাম। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠতা, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের নবরূপকার, মসজিদে গাউসুল আযম ও জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্সের স্থপতি, অসংখ্য দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক, সাবেক ধর্ম ও ত্রাণমন্ত্রী, আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নান এক মহান কর্মবীর, এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে কখনো ভোলা যায় না। তাঁর ইন্তেকালবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে তাঁকে যেমন মনে পড়ে, তেমনি মনে পড়ে দেশ-জাতির নানা সংকট-সম্ভাবনার সময়ে, হরিষ-বিষাদে, আনন্দ-বেদনায়। বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বারবার উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তাঁর উজ্জ্বল কান্তি, প্রশান্ত মুখচ্ছবি। এক সাধারণ পরিবেশ থেকে উঠে এসে তিনি রেখে গেছেন অসাধারণ কীর্তি। মেধা, প্রতিভা, সৃজনশীলতা, কর্মকুশলতা, দুর্দমনীয় মনোবল, কর্মনিষ্ঠা ও অধ্যবসায় দ্বারা তিনি বিপুল অবদান রেখে গেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। কালের পাতায় রেখে গেছেন স্মরণীয় কীর্তি ও স্মৃতি।
বিস্ময়কর প্রতিভা : জন্মগতভাবেই মাওলানা মান্নান ছিলেন বিস্ময়কর মেধা ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। শৈশবেই পিতৃহারা হন তিনি। ইয়াতিমের অসহায়ত্ব তাঁর প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। শ্রেণিকক্ষে তিনি উস্তাদদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন অপূর্ব মেধা ও প্রতিভায়। মাদরাসার প্রতিটি পরীক্ষায় রেখেছেন সেই মেধার স্বাক্ষর। তাঁর উস্তাদদের মুখে শুনেছি, শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে উস্তাদ যখন বেরিয়ে গেছেন সাথে সাথে তিনি সহপাঠীদের ঐ পাঠটি ঠিক উস্তাদদের মতোই এমনকি তার চেয়েও উত্তমরূপে বুঝিয়ে দিতেন। ইলমে হাদীসের আসমাউর রিজাল (বর্ণনাকারীদের নাম, জীবন ইতিহাস, পরম্পরা সূত্র) একটি কঠিন বিষয়। এর মাধ্যমে হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা ও অগ্রহণযোগ্যতা, সহীহ দয়ীফ মওদূ নির্ণীত হয়। মাওলানা মান্নান এ বিষয়ে ছিলেন সুপ-িত। শিক্ষকতা জীবনে তিনি মুহাদ্দিসরূপে টাইটেল ক্লাসে কখনো কখনো একাই সিহাহ সিত্তার পাঠদান করেছেন। ইমামদের বিভিন্ন মত ও তাদের দলিল সবিস্তার বর্ণনা করেছেন, বিভিন্ন মতের মধ্যে যৌক্তিক সামঞ্জস্য তুলে ধরেছেন। দেশ-বিদেশে লাখো মানুষের সাথে মেলামেশা করেছেন তিনি, নোট বই বা ডাইরিতে তাদের নাম-পরিচয় তাকে লিখে রাখতে দেখেনি কখনো কিন্তু তাদের নাম অনায়াসে বলে দিতে পারতেন তিনি। টেলিফোন নম্বর লিখে রাখতে দেখিনি তাঁকে কিন্তু কী দেশে, কী বিদেশে দিন-রাত টেলিফোন করতে থাকতেন তিনি। কত হাজার নাম্বার স্মৃতিতে ছিল তাঁর আল্লাহই তা ভালো জানেন। আমার প্রায় চল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা এই।
মাওলানা এম এ মান্নানের শিক্ষা কেবল মাদরাসায়। স্কুল-কলেজ, ভার্সিটিতে তিনি পড়ালেখা করেননি। তবে তাঁর মন্ত্রিত্বকালে ফাইল নোট সর্বদা ইংরেজিতেই লিখতেন। কেউ ইংরেজিতে ফাইল নোট দিলে এবং তার মধ্যে ভাষাগত কোনো ভুল থাকলে তা তাঁর চোখ এড়াতো না। ভুলটি ধরিয়ে দিতেন, সংশোধন করে দিতেন। বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে, কূটনীতিকদের সাথে অনায়াসে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতেন, মতবিনিময় করতেন। ইংরেজি ভাষার দেশে তিনি বেশ কয়েকবার সম্মেলন-সমাবেশে ভাষণও দিয়েছেন তাদের ভাষাতেই। লিখিত ভাষণ দেয়া তিনি পছন্দ করতেন না। বাংলা তো তাঁর মাতৃভাষা, উর্দু ভাষাতে তিনি ছিলেন সুপ-িত। শব্দচয়ন, ভাববিন্যাস, উপস্থাপনা ব্যাকরণের অনুসরণ তাঁর এত নির্ভুল ও মুন্সিয়ানাপূর্ণ ছিল যে, ঐ ভাষাভাষীরাও তা দেখে ও শুনে অবাক হয়ে যেতেন। আরবী একটি কঠিন ভাষা। এর ব্যাকরণও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। মাদরাসায় তা ভালোভাবে পড়তে হয়, পড়াতে হয়। একজন মুহাক্কিক আলেমে দ্বীন হয়ে এ ভাষা তিনি জানবেন, বুঝবেন তা স্বাভাবিক। অনেক আলেমই এ ভাষা জানলেও এ ভাষায় বক্তৃতা করতে পারেন না। আটলান্টিকের বেলাভূমি থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত যে আরবজাহান বিস্তৃত তার স্থানীয় ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, পার্থক্য আছে ক্লাসিক্যাল আরবী ও আধুনিক আরবীর মধ্যে। আর বিভিন্ন আরব দেশের দেহাতী আরবীয়ের মধ্যে পার্থক্য তো নদীয়া-শান্তিপুরের, চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামের কথ্য বাংলার চেয়েও বেশি। মাওলানা এম এ মান্নান ব্যাপকভাবে আরবজাহান সফর করেছেন, রাজা-বাদশাহ থেকে যাযাবর বেদুঈনদের সাথেও মিশেছেন, কথাবার্তা বলেছেন, মতবিনিময় করেছেন, আলাপচারিতায় অংশ নিয়েছেন, কিন্তু দোভাষীর সহায়তা নিতে কখনো তাঁকে দেখিনি। তিনি কী করে যে অতি অল্পসময়ের মধ্যে তাদের কলকুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ আয়ত্ত করে ফেলতেন আর অবলীলাক্রমে তা ব্যবহার করতেন, তা ভাবতে বিস্ময় লাগে।
সংগঠক হিসাবে : মাওলানা এম এ মান্নানের সাংগঠনিক প্রতিভা ছিল অসাধারণ। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন শতাধিক বছরের ঐতিহ্যধন্য মাদরাসা শিক্ষকদের সংগঠন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে, পাকিস্তানি শাসনকালে এটি আজকের মতো সাংগঠনিকভাবে এমন মজবুত, সুগঠিত, সক্রিয় ও প্রাণবন্ত ছিল না। মাওলানা সাহেব পাকিস্তান আমলে এর সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও এ সংগঠন আজকের এ রূপ লাভ করে বাংলাদেশ আমলে এসে, ১৯৭৬ সালে। তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে। তিনি এর নবরূপকার। তিনি একে রাজধানীর কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সুসংগঠিত করেন। মাদরাসার প্রতিটি শিক্ষককে এর সাথে সম্পৃক্ত করেন, তাদের মুখে ভাষা দেন, বুকে নব আশা জাগিয়ে তোলেন, তাদের উজ্জীবিত, উদ্দীপিত অনুপ্রাণিত করেন। ব্রিটিশ আমলে একজন বেসরকারি মাদরাসা শিক্ষক মাসে সরকারি অনুদান পেতেন মাত্র ৫ টাকা। পাকিস্তান আমলেও সরকারি অনুদান ছিল যৎসামান্য। শুধু মাদরাসা শিক্ষক কেন, সকল বেসরকারি শিক্ষক সমাজেরই ছিল একই হাল। আজ সেখানে সকল বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষক পাচ্ছে সরকারি স্কেলে ১০০% বেতন। পাচ্ছে চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়া ভাতা, অবসর ভাতা, কল্যাণ ভাতা ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষকতা আজ এক আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত হয়েছে। আর এসব কিছুর পেছনের প্রাণপুরুষ হলেন মাওলানা এম এ মান্নান।
তিনি মাদরাসা, স্কুল ও কলেজের শিক্ষক সমিতিসমূহকে একটি সংগঠনের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ করেন। সকল শিক্ষক নেতা এক অভিন্ন লক্ষ্যে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হন। গড়ে তোলেন দুর্বার আন্দোলন। তারই ফলশ্রুতি আজকের এই অবস্থান। সত্যি তিনি ছিলেন শিক্ষক ঐক্যের এক নজিবিহীন কারিগর। পেশাগত দিক দিয়ে একজাতীয় হলেও সাধারণ শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষার শিক্ষকদের মধ্যে একটা দূরত্ব বরাবরই ছিল। এর একটা ঐতিহাসিক ব্যাকগ্রাউন্ডও রয়েছে। সে আলোচনা ভিন্ন। আরবী শিক্ষায় শিক্ষিত মাওলানা এম এ মান্নান ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমমনা সহযোগীদের নিয়ে এই ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে ইবতেদায়ীর ক্বারী-মৌলভী আর টোলের ধুতি পরা প-িতদের, মাদরাসার হুজুর ও সাধারণ শিক্ষার মাস্টারদের যে একই প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ করেছেন পরস্পরকে পরস্পরের দাবির পক্ষে সোচ্চার করে তুলেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে গেছেনÑ বাস্তবিকই তা এক অনুপম নজির। আজ আমাদের সকল ক্ষেত্রেই বিভক্তি, শিক্ষকদের সংগঠনগুলো যে কত ভাগে বিভক্ত তার হিসাব দেয়া কঠিন। রাজনীতি, অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রেই একই দৃশ্য। এ সময় মাওলানা এম এ মান্নানের মতো দূরদর্শী উদারমনা, দক্ষ ও যোগ্য নেতার বড়ই প্রয়োজন।
মাওলানা এম এ মান্নান একজন দক্ষ ও সফল রাজনীতিকও ছিলেন। তিনি দল করতেন, দলীয় রাজনীতি করতেন, বহুবার এমপিএ, এমপি, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রিত্বের আসন অলঙ্কৃত করেছেন। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে পার্টির নেতৃত্বও দিয়েছেন, সফল ও সার্থকভাবে একাধিক মন্ত্রণালয়ও পরিচালনা করেছেন কিন্তু তার নিজস্ব সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদর্রেছীনকে সর্বদা রেখেছেন দলীয় রাজনীতিমুক্ত। এর পেশাজীবী চরিত্র কখনো ক্ষুণœ হতে দেননি। তেমনি তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবকেও দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি বলতেন, রাজনীতি করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার, প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বাধীন মতে পছন্দনীয় দল করতে পারেন তবে তা ঐ ফোরামে গিয়ে, এখানে নয়। এখানে তা করতে গেলে ঐক্যও থাকবে না, সংগঠনের লক্ষ্যেও পৌঁছা যাবে না। আমার ধারণা, এমনটা করতে পারলে আজও অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব।
ওলামা-মাশায়েখের ঐক্য ও সম্প্রীতি : এই যে আমাদের দেশের অধিবাসীদের ৯০%-এর অধিক মুসলমান, এই যে এ দেশের মুসলমানরা দুনিয়ার সর্বাধিক ধর্মপ্রাণ বলে খ্যাত, এই যে এ দেশের এত মাদরাসা, মসজিদ, ইসলামী প্রতিষ্ঠান, এসব কি এক দিনে হয়েছে? এসব কি কারোর একক প্রচেষ্টার ফল? অবশ্যই না। এর পেছনে রয়েছে শত শত বছরের মেহনত রয়েছে, শত শত ওলামা-ছালেহীনের অবদান। অত্যন্ত আফসোসের বিষয়, এ ঐতিহাসিক সত্য ভুলে গিয়ে অনেকেই মনে করতে শুরু করেছেন, আমার পীর আমার ধর্মীয় নেতা, মুরব্বী মসলাকের বুযুর্গ ছাড়া অন্য কারোর কোনো অবদানই নেই। অন্যারা দ্বীনের দুশমন, কেবল আমরাই রয়েছি সঠিক পথে। দেখা যাচ্ছে পরস্পরের মধ্যে কেবল মতপার্থক্যই। সৃষ্টি হয়েছে শত্রুতার। ইখতিলাফ পরিণত হয়েছে মুখালিফাতে। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল (রহ.) জওয়াবে শিকওয়ায় বহু আগে এ অবস্থা দেখে লিখে গেছেন।
‘লাভ-লোকসান এক তোমাদের, এক মঞ্জিল এক মোকাম
এক তোমাদের নবী রাসূল; এক তোমাদের দ্বীন-ইসলাম।
এক তোমাদের আল্লাহ এবং এক তোমাদের আল কোরআন।
আফসোস হায়, তবুও তোমরা এক নহ সব মুসলমান!
তোমাদের মাঝে হাজার ফিরকা, হাজার দল ও হাজার মত
এমন জাতি কি দুনিয়ার বুকে খুঁজে পায় কভু মুক্তি পথ।
কেবল বাংলাদেশে নয়, তামাম মুসলিম জাহানেরই আজ এই হাল।
উম্মাহর কল্যাণ ও দুর্দশার অবসানের জন্য নিজেদের মধ্যকার এই অহেতুক বৈরিতা, আত্মঘাতী সংঘাত নিরসনের কোনো বিকল্প নেই। চাই সবার অবদানের স্বীকৃতি, চাই পরস্পরে শ্রদ্ধা-সম্মান-মর্যাদার অভিব্যক্তির সংস্কৃতির আবাদ। এ ক্ষেত্রে মাওলানা এম এ মান্নান সরেজমিন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন, আমরণ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি ফুরফুরা-সিলসিলার লোক ছিলেন, তাঁর পিতা ও নানা ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে জমান হযরত মাওলানা আবু বকর সিদ্দিকী (রহ.)-এর খলিফা ছিলেন, তিনি নিজে ছারছীনার পীর মরহুম হযরত মাওলানা শাহ্ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ (রহ.)-এর বিশিষ্ট মুরিদ ছিলেন। এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ঘরানার লোক হওয়া সত্ত্বেও তিনি সব ঘরানার আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখতেন, সব দরবারে ও খানকায় যেতেন, তাদের দাওয়াত দিয়ে আনতেন, বিশেষভাবে মেহমানদারি করতেন। সবাইকে নিয়ে দ্বীনি সমস্যাসমূহ সমাধানের উপায় অন্বেষণ করতেন। নিজ মতাদর্শে অটল-অবিচল থেকে অন্যের মতকে গুরুত্ব দিতেন, সকলের অবদানের স্বীকৃতি দিতেন। তিনি ছিলেন ঐক্যের প্রতীক। তারাও তাঁকে মনে করতেন একান্ত আপনজন। তাদের কেউ কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে তার শরাণাপন্ন হতেন। তিনিও অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সে সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতেন। তিনি মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাতেন। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে দূতের ভূমিকা পালন করতেন। আরব জাহানের রাজা-বাদশাহ, শীর্ষস্থানীয় নেতারা তাঁকে অত্যন্ত কাছের মানুষ, নিজের মানুষ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করতেন। অনেকে তাঁকে বাংলাদেশ ও আরব জাহানের মধ্যকার সেতু বলেও আখ্যায়িত করতেন।
কবির ভাষায় :
দেখি তারে, দেখি বারে বারে
উম্মার ক্রান্তিকালে ঐক্য সৌহার্দ্য বার্তা বয়ে নিয়ে যেতে দ্বারে দ্বারে
মুসলিম বিশ্বের। সুবিজ্ঞ প্রাজ্ঞ দূত চৌকস নির্ভীক
দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী অক্লান্ত অবিশ্রান্ত দুরন্ত সৈনিক।
অবিস্মরণীয় তাঁর অবদান, খিদমত আঞ্জাম
মাওলানা মান্নান শান্তি কল্যাণের এক শ্বেত কপোতের নাম।
এক সফল পুরুষ : মাওলানা এম এ মান্নান যখন সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক সমাজকে একই প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করার সংকল্প ঘোষণা করেন তখন কতক সংশয়বাদী একে আকাশ কুসুম কল্পনা বলতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। কিন্তু তিনি তা বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন, যার সুফল আজ শিক্ষক সমাজ ভোগ করছে। তিনি যখন বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বেতন স্কেল প্রবর্তনের, টাইম স্কেল প্রবর্তনের, চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া ভাতা, অবসর ভাতা, কল্যাণ ফান্ডের কথা বলেছেন তখনও অনেকে একে অসম্ভব, অবাস্তব বলে আখ্যায়িত করেছেন, কেউ কেউ ঠাট্টা-মসকরা করতেও ছাড়েননি। কিন্তু তা আজ বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি যখন মহাখালীর গভীর লেকে একটি ঐতিহাসিক মসজিদ ও দ্বীনী কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেন তখনও অনেকে একে উদ্ভট খেয়াল বলে মজা উড়িয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে আজ সেখানে মনোরম স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন মসজিদে গাউসুল আজম ও তার গম্বুজ মিনার সে স্বপ্ন-সফলতার বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে। তিনি যখন একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন তখনো কতক সম্মানিত ও খ্যাতনামা সাংবাদিক একে মাওলানার ‘দিবাস্বপ্ন’ বলে অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানিতে দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠিত হয়ে সগৌরবে এত বছর টিকে আছে। তিনি যখন নবপর্যায়ে এফিলিয়েটিং ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন তখন ইসলামী আন্দোলনের কোনো কোনো নেতাও এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অসম্ভব ও অবাস্তব বলে পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ করেন। কিন্তু মর্দেমমিন মাওলানা এম এ মান্নানের সেই দাবি এবং শতাব্দীর ওলামা-মাশায়েখ, ইসলামী জনতার সেই আকাক্সক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার কার্যক্রম এখন পূর্ণোদ্যমে চলছে। অনেকেই বড় বড় স্বপ্ন দেখেন, আশা করেন কিন্তু নিজ চোখে সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য সকলের হয় না। কিন্তু মাওলানা এম এ মান্নান এমন এক সফল পুরুষ ও সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার বাস্তব রূপ দিয়ে নিজ চোখেই তা দেখে যেতে পেরেছেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন বহু গ্রন্থ প্রণেতা ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা, মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের একটি অনুষ্ঠানের কথা। ঐ কমিটি তার স্মারকে লিখেছে, ‘কমিটি চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন, বাংলাদেশ জামিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী আলহাজ মাওলানা এম এ মান্নানকে চলতি ১৪২৫ হিজরি সালের শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব পুরস্কার প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে মুহতারাম মাওলানাকে এ সম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।’ সম্মাননা স্মারকে মুহতারাম মাওলানার জীবন-কর্ম নিবন্ধে আরো লেখা হয়েছে, ‘প্রাজ্ঞ আলেম, দক্ষ সংগঠক, সফল রাজনীতিবিদ, বহু ভাষাবিদ ও অসাধারণ বাগ্মী হিসেবে যেমন খ্যাত মাওলানা এম এ মান্নান, তেমনি চারিত্রিক মাধুর্যেও তিনি অনন্য। সদালাপী, বন্ধুবৎসল, অতিথিপরায়ণ, উদার ও অমায়িক এই মানুষটির সন্নিধ্যে এসে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারে না। তাঁর বদান্য ও উদারহস্তের অবারিত দানে উপকৃত হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা বিপুল। আত্মপ্রত্যয়ী নির্ভীক অধ্যবসায়ী, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, অক্লান্ত কর্মী পুরুষ মাওলানা এম এ মান্নান এক জীবন্ত ইতিহাস।’
আধ্যাত্মিকতায় : না, আর বেশি লেখার অবকাশ নেই সীমিত এই পরিসরে। তাই তাঁর আর একটি দিক আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে তাকে নিয়ে লেখা একটি কবিতার কয়েকটি চরণের উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করছি এ লেখা।
‘কখনো কাবার পাশে, রাসূলের রওযা মোবারকে
বাগদাদে, কারবালায়, কখনো আজমিরে দেখি তাঁকে
দেখি পীর-মুর্শিদের দরবারে খানকায়
মাদরাসায়, মসজিদে, কভু দেখি ধ্যানমগ্ন, আত্মলীন মহাতপস্যায়
বেখুদীতে মশ্গুল, কভু পানে মত্ত ইশকের জাম
মাওলানা মান্নান এক মহাধ্যানী সাধকের নাম।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন