উচ্চ অভিবাসী ব্যয় বন্ধে টনক নড়ছে মালয়েশিয়া সরকারের। অভিবাসী কর্মী নিয়োগে নতুন প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে মালয়েশিয়া সরকার। গত দু’সপ্তাহে মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের চাহিদাপত্র মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোতে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের আনাগোনা কমে গেছে। গতকাল একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে সরেজমিনে গেলে এ দৃশ্য চোখে পড়েছে। উচ্চ অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের আনা সম্ভব না হলে রেমিট্যান্স প্রবাহেও বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে। একাধিক জনশক্তি রফতানিককারক এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের অভিবাসন ব্যয়ের টাকা যোগাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। অঘোষিতভাবে চিহ্নিত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের কাছ থেকে প্রায় চার লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু একাধিক কর্মী এতথ্য জানিয়েছে। বায়রার যুগ্ম মহাসচিব এম টিপু সুলতান আজ বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হুমকির সম্মুখীন। আমরা চাই সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ে দেশটিতে কর্মী পাঠাক। সিন্ডিকেট চক্র মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীদের কাছ থেকে জনপ্রতি চার লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এটা চরম অমানবিক ঘটনা।
মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীরা অভিবাসন ব্যয়ের টাকা যোগাতে চড়া সুদে ঋণ এবং বাড়ী ঘর বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বায়রা নেতা টিপু সুলতান বলেন, আগামী শনিবার শাহাবাগস্থ সাবেক শেরাটন হোটেলে বায়রার এজিএময়ে মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট বন্ধ এবং সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিকে দেশটিতে সরকার নির্ধারিত ব্যয়ে কর্মী প্রেরণের সুযোগের দাবিতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। সকল রিক্রুটিং এজেন্সি দেশটিতে কর্মী পাঠানোর সুযোগ পেলে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি বাড়বে বলেও বায়রা নেতা উ্েল্লখ করেন। এম টিপু সুলতান বলেন, মালয়েশিয়ার এফডব্লিসিএমএস এর মাধ্যমে সিন্ডিকেট চক্র কর্মী প্রতি ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা বিনা কারণেই হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে প্রায় পাঁচ লক্ষ বাংলাদেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। বছরের শুরুতেই রেমিট্যান্সের প্রবাহ ইতিবাচকভাবে দেখা দিয়েছে। গত জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৩ দিনে দেশে এসেছে ৯২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো এই অর্থ দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। গত ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে দেশে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এই সময়ে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৭৭ কোটি ১৩ লাখ মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১২ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার। এছাড়া বিশেষায়িত এক ব্যাংকের মাধ্যমে ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ৩১ লাখ মার্কিন ডলার। বিদায়ী ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার।
অভিবাসী কর্মী নিয়োগের ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশটিতে তৃতীয় পক্ষের (এজেন্সি) হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে চান মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। গত বুধবার মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, 'মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসেবে আসতে নেপালের কর্মীদের খরচ মাত্র ৩ হাজার ৭০০ রিঙ্গিত। কিন্তু বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার কর্মীদের জন্য তা ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার রিঙ্গিত।' তিনি বলেন, দেশটির এজেন্টদের এই উচ্চ ফি 'আধুনিক দাসত্বের' সমতুল্য।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে বিদেশি কর্মীরা রেহাই পাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে মালয়েশিয়া মর্যাদাবান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশটির প্রধানমন্ত্রীর এমন সদিচ্ছাকে স্বাগত জানিয়েছেন কুয়ালালামপুর থেকে বাংলাদেশি এজেন্সি শিউর ওভারসীজ রিক্রুটের পার্টনার মো. দেলোয়ার হোসাইন। কুয়ালালামপুর থেকে জনশক্তি রফতানিকারক মো. দেলোয়ার হোসাইন আজ বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে বলেন, দেশটির প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অভিবাসী কর্মীদের উচ্চ ব্যয়ের বিষয়টি অনুধাবন করে সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়েছেন। এখন থেকে দেশটির নিয়োগকর্তারা বিদেশি কর্মী নিয়োগের জন্য সরাসরি ইমিগ্রেশনে আবেদন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের মূল হোতা এফডব্লিউসিএমএস আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব হারাতে যাচ্ছে। বর্তমানে যেসব চাহিদাপত্র এফডব্লিউসিএমএসে জমা পড়েছে শুধু সেগুলো প্রক্রিয়া করতে পারবে। ২০০৭ সালের নিয়ম অনুযায়ীই ইমিগ্রেশনের মাধ্যমেই বাংলাদেশের সকল বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি কর্মী প্রেরণের সুযোগ পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মো. দেলোয়ার হোসাইন। এফডব্লিউসিএমএস এর কার্যক্রম বন্ধ হলেই চিহ্নিত সিন্ডিকেট চক্রকে আর কর্মী প্রতি বিনা কারণে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা দিতে হবে না। এতে অভিবাসন ব্যয়ও অনেকটা কমে আসবে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থা অভিবাসী কর্মীদের বিদেশ যেতে অনাকাঙ্খিত উচ্চ খরচ হওয়াকে 'দাসের শ্রম' বা ফোর্স লেবার এবং মানবপাচার হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই ২টি অভিযোগে মালয়েশিয়া থেকে আমেরিকা ও ইউরোপের মার্কেটে মালয়েশিয়ান পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। বেশ কয়েকটি স্থানীয় হ্যান্ড গ্লোভ প্রস্তুতকারক কোম্পানি তাদের বর্তমান ও সাবেক বিদেশি কর্মীর অতিরিক্ত অভিবাসন খরচ ফেরত দিয়ে সেই অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। মালয়েশিয়ান নিয়োগকর্তারা নামমাত্র বা শূন্য খরচে কর্মী নিয়োগ করার ইচ্ছা বিভিন্ন সময় সরকারকে জানিয়েছে। তারা নিশ্চয়তা চেয়েছিল, উৎস দেশের কর্মীর অতিরিক্ত কোনো খরচ হবে না।
এদিকে, কুয়ালালামপুর থেকে প্রবাসী সাংবাদিক এম এ আবির জানান, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার মো. গোলাম সারোয়ার দেশটির নব নিযুক্ত মানবসম্পদ মন্ত্রী শিবকুমার ভারাথারাজু নাইড়ুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। উক্ত বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার সময় তারা মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিশদ আলোকপাত করেন। বাংলাদেশের হাই কমিশনার মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী জনশক্তি নিয়োগ আরও বেগবান করতে এবং স্বল্প ব্যয়ে আরও অধিক সংখ্যক কর্মী প্রেরণে বর্তমানে প্রচলিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণে সম্ভাব্য পদক্ষেপ সমূহ প্রস্তাবনা আকারে মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন।
তিনি কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং দ্রুততর করার নিমিত্তে প্রস্তাবনা সমুহের উপর আলোচনা পূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অতি দ্রুত দুই দেশের মধ্যে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা আয়োজনের আহবান জানান। মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রী যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী মার্চ মাসে উক্ত সভা আয়োজনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার বিদেশী কর্মী নিয়োগে অন্যতম বৃহত্তর সোর্স কান্ট্রি হিসাবে বাংলাদেশকে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
এছাড়াও, বাংলাদেশের হাই কমিশনার মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রীকে রিক্যালিব্রেশন প্রোগ্রামের আওতায় অনথি ভুক্ত বাংলাদেশী কর্মীদের বৈধ হওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য মালয়েশিয়া সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এবং অবগত করেন যে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী কর্মী বৈধ হওয়ার নিমিত্তে আবেদন করেছেন। অতিসম্প্রতি ঢাকা সফরকালে বিদেশি কর্মীদের অভিবাসন ব্যয় কমাতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছিলেন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন বিন ইসমাইল। ইসমাইল বলেন, তার সরকার অভিবাসন ব্যয় কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনতে চাচ্ছি। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক বৈঠক শেষে তিনি একথা বলেন। তিনি আরো বলেন, আগামী দিনে দুই দেশের প্রতিনিধিরা বসবেন। তারা রিভিউ করবেন যে সমঝোতা চুক্তিতে পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কিনা।
মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা আগের করা সমঝোতা চুক্তি নিয়ে কথা বলেছি। মালয়েশিয়া সরকার কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সহজতর করতে চায়, যেন মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চাহিদা পূরণ করা, অভিবাসী ব্যয় কমানো, বিদেশি কর্মীদের সম্মান রক্ষা করা। যদি বর্তমান প্রক্রিয়ায় সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো না যায়, আমরা পরিবর্তন আনতে প্রস্তুুত। সেজন্য আমরা আলোচনায় বসবো। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে ১৫ লাখ বিদেশি কর্মী আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মধ্যে সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশি কর্মী। সে কারণেই বাংলাদেশ ১৫টি সোর্স কান্ট্রির মধ্যে প্রথম স্থানে আছে। বাংলাদেশি কর্মীরা মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী বলেন, আমাদের দুটি বিষয়ে ফলপ্রসূ আলাপ হয়েছে। প্রথমত রিক্যালিব্রেশন প্রোগ্রাম আরও দ্রুত করার বিষয়ে। দ্বিতীয়ত মালয়েশিয়া সরকার অভিবাসন ব্যয় কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন