ব্যাংকে জমা রাখা টাকার উপর যে সুদ আসে সে ব্যাংকটি যদি সুদী কারবারের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, তাহলে এর লভ্যাংশও অবৈধ। কিন্তু এমন অনেক দেশ আছে যেখানে সুদী ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোন ব্যাংক নেই। তখন তাকে বাধ্য হয়েই সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে কেউ যদি ব্যাংকে তার সঞ্চয়ের উপর যে সুদ আসে তা গ্রহণ না করে, তাহলে ব্যাংক ইচ্ছা করলে অদাবিকৃত সুদের অর্থকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দান করতে পারে। কখনো কখনো অনুদান প্রাপ্ত এ সমস্ত প্রতিষ্ঠান ইসলাম বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে। সে কারণেই ব্যাংকে জামা টাকা উপর যে সুদ আসে তা ছেড়ে না দিয়ে বরং তা গ্রহণ করা উচিত। অবশ্য এ অর্থ নিজের বা পরিবারের জন্য ব্যয় না করে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে। প্রখ্যাত মুফতী সারাখশী বলেছেন যে, ‘অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ থেকে অবশ্যই মুক্তি পেতে হবে এবং এ সম্পদকে কোন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে’। কারো কারো মতে সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও দায়-দেনার ভিত্তিতে গড়ে উঠা সোসাইটির সঙ্গে বীমা করা বিধিসম্মত। কিন্ত পুঁজিবাদী মুনাফালোভী কোন কোম্পানীর সঙ্গে বীমা করাটা অবৈধ।
বিবাহ : এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একজন মুসলমান পুরুষ একজন মুসলমান মহিলাকে বিয়ে করবে। অবস্থার প্রেক্ষিতে খৃষ্টান বা ইয়াহূদী ধর্মাবলম্বী নারীকে বিয়ে করাটা বৈধ বরে বিবেচিত। কিন্তু সে কোন পুতুল পূজারী, নাস্তিক বহু ঈশ্বরবাদী মহিলাকে বিয়ে করতে পরে না। কিন্তু একজন মুসলিম মহিলা কোন অমুসলিমকে বিয়ে করতে বা অমুসলিমকে নিয়ে দামপত্য জীবন যাপন করতে পরে না। সে অমুসলিম পুরুষ, ইয়াহূদী, খৃষ্টান নাস্তিক, যাই হোক না কেন তাতে কিছু যায় আসে না। অমুসলিম পরিবারের পুরুষ যদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে কিন্তু স্ত্রী ইয়াহূদী বা খৃষ্টার থেকে যায়, তাতে দাম্পত্য জীবন অবৈধ হয় না। কিন্তু একটি অমুসলিম পরিবারের স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর স্ত্রী যদি নাস্তিক, পুতুল পূজারী বা বহু ঈশ্বরবাদী থেকে যায় তা হলে সে বিয়ে তৎক্ষণাৎ ভেঙ্গে যায়। অবশ্য দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে দেওয়ার পূর্বে বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য স্ত্রীকে পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দিতে হয়। অনুরূপভাবে কোন অমুসলিম পরিবরের স্ত্রী যদি ইসলাম গ্রহণ করে, তাহলে স্বামীকে বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ সময় দেওয়া হবে। এরপরও স্বামী মুসলমান না হলে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটবে এবং মুসলমান স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আইনের আশ্রয় নিতে হবে।
মৃত্যু : মৃত্যুপথযাত্রী একজন মুসলমান শেষ মুহূর্তেও পাঠ করতে চায় : ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ -অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) তাঁর রাসূল। মৃত্যু পথযাত্রীর পাশে যারা থাকে তারাও রোগীকে বার বার এ কথাগুলো উচ্চারণ করতে সাহায্য করে। ইসলামী পরিভাষায় এটাকে বলে তালকীন। মৃত ব্যক্তির শরীর শক্ত হয়ে যাওয়ার পূর্বে তার হাত দুটি সালাতের ভঙ্গিমায় হয় বুকের উপর অথবা শরীরের দু’পাশে সোজাভাবে রাখতে হয়। সম্ভব হলে মৃতদেহ করবস্থা করার পূর্বে ওযু-গোসল দিয়ে পবিত্র করা হয়। নিত্যদিনের পোশাকগুলো খুলে তিন প্রস্থ সাধারণ কাপড় দিয়ে দেহ আবৃত করা হয়। মৃতদেহ গোসল করানোর প্রথম পর্যায়ে মৃতদেহের সমস্ত শরীরে সাবানের পানি ঢালা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে গায়ে লেগে থাকা সাবানের পানি ভালভাবে পরিস্কার করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর্পুর মিশ্রিত পানি দিয়ে সারা শরীর ধুয়ে ফেলতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষ নেহায়েত অসুবিধার কারণে পানি দিয়ে পরিস্কার করা সম্ভব না হলে তায়ামমুমের সাহায্যে মৃতদেহ পাক পবিত্র করতে হয়।
সাধারণ কাপড় দিয়ে মৃতদেহ আবৃত করার পর জানাযার নামাযের ব্যবস্থা করা হয়। এটা ফরযে কিফায়া। মৃতদেহের অনুপস্থিতিতেও জানায়ার যে নামায পড়া হয় তাকে বলে গায়েবানা জানাযা। যতদূর সম্ভব মক্কার সমান্তরালে উত্তর-দক্ষিণে কবর খোধাই করা হয়। কবরের মধ্যে মৃত ব্যক্তির মাথা উত্তরের দিকে রেখে মুখ ডান দিকে সামান্য কাত করে দেওয়া হয়। মৃতদেহকে কিবলামুখী করে রাখাই এর উদ্দেশ্য। মৃতদেহ কবরে রাকার সময় বার বার এ দু’আটি পড়তে হয় “বিসমিল্লাহ ওয়া’আলা মিল্লাতি রাসূলুল্লাহ”। মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, মৃতদেহ কবরস্থ করার পর দুজন ফেরেশতা কবরের মধ্যে আসেন এবং মৃত ব্যক্তিতে তার ঈমান সম্পর্কে কতকগুলো প্রশ্ন করেন। এ বিশ্বাসের সূত্র ধরেই কবরের পাশে দাড়িয়ে দু’আ পাঠ করা হয়্ কুরআন মজীদের এই আয়াতও বার বার তিলাওয়াত করা হয় যার অর্থ হচ্ছে : হে প্রশান্ত চিত্ত, তুমি তোমার রব-এর নিকট ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষ ভাজন হয়ে। আর বান্দাদের অন্তুর্ভূক্ত হও এবং আমার জান্নাতে দাখিল হও (৮৯ : ২৭-৩০)। করবস্থানকে জাঁকজমকপূর্ণ করে তোলার জন্য যে কোন রকম বাহুল্য ব্যয় বাঞ্ছনীয় নয়। কবরস্থানকে যতাসম্ভব স্বাভাবিক অবস্থায় রাখা উচিত। বস্তুতপক্ষে মৃত ব্যক্তিকে উপলক্ষ্য করে অভাবী ও গরীবদের মধ্যে বেশি দান খয়রাত করা ভাল। আল্লাহর দরবারে এ মুনাাত করতে হবে যে, তিনি যেন দান খয়রাতের সওয়াব মৃত ব্যক্তির রূহের উপর পৌছে দেন। একে সওয়াবে রিসানী বলে।
সাধারণ আচরণ : নিয়মিত সালাত আদায় এবং রমযান মাসে রোযা রাখা ছাড়াও বিশেষ বিশেষ আচার-আচরণের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিয়মিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা, কুরআনের অর্থ বুঝা এবং এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা করা। বস্তুত পক্ষে কুরআনের বিভি-বিধানগুলো নিজেদের জীবনে রূপায়িত করাই এর উদ্দেশ্য। প্রতিটি কাজ করার সময় বিসমিল্লাহ বলে শুরু হবে। আবার কাজ শেষ করেই বলতে হবে আলহামদুলিল্লাহ। ভবিষ্যতে কোন কাজ করার ইচ্ছা পোষন করলে অথবা ওয়াদা করলে সঙ্গে সঙ্গে ইনশাআল্লাহ বলতে হবে। একজন মুসলমানের সঙ্গে আরেকজন মুসলমানের দেখা হলে আসসালামু আলায়কুম বলে অভিবাদন করতে হবে। এর জবাবে অন্যজন বলবে ওয়া আলায়কুমুস সালাম। দুনিয়াতে অভিবাদন জানানোর যত রীতি ও পদ্ধতি আছে, তন্মধ্যে এ বাক্য দুটি খুবই অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। গুড মরনিং, গুড ইভিনিং (শুভ প্রভাত, শুভ সন্ধ্যা) ইত্যাদি আইয়ামে জাহিলিয়াতেরই অবশিষ্টাংশ। নিদ্রায় যাওয়ার অথবা নিদ্রা থেকে জাগরণের সময় প্রত্যেক মুসলমানকে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সুবহানাল্লাহ ইত্যাদি পাঠ করা ভাল। সেই সঙ্গ নবী করীম (সা.) এর উপর দরুদ শরীফ পড়তে হবে। এর জন্য সবচাইতে সহজ পথটি হল ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি‘আলা মুহাম্মাদ ওয়াবারিক ওয়া সাল্লাম’ বলা। নবী করীম (সা.) ডান দিককে বেশি পসন্দ করতেন। যেমন জুতো স্যান্ডেল পায়ে দেওয়ার সময় প্রথমে ডান পা এবং পরে বাম পায়ের জুতো পরতেন। আবার খোলার সময় এর ঠিক উল্টোটি করতেন। অর্থাৎ প্রথমে বাম পা এবং পরে ডান পায়ের জুতো খুলতেন। পিরহান (জামা) গায়ে দেওয়ার সময় প্রথমে ডান হাত এবং পরে বাম হাতের আস্তিন গায়ে দিতেন। মাতা আঁচাড়ানোর সময় ডান দিকের চুল আঁচড়ানোর পর বাম দিকের চুল আঁচড়াতেন। মসজিদ অথবা ঘরে প্রবেশের সময় প্রথমে ডান পা ফেলতেন। কিন্তু গোসলখানা বা পায়খানায় ঢোকার সময় প্রথমে বাম পা দিতেন, আবার বেরিয়ে আসার সময় প্রথমে ডান পা বাইরে ফেলতেন। সঙ্গী সাথীদের মধ্যে কোন কিছু বিতরণের সময় ডান দিকে দিয়ে শুরু করতেন এবং বাম দিক দিয়ে শেষ করতেন।
পানাহার : পর্ক বা শুকুরের মাংস বা চর্বি কোনভাবেই গ্রহণ করা যাবে না। মদের ব্যাপারেও এই একই কথা। ইসলাম উভয়টাকেই হারাম করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি ভ্রান্তির অপনোদন হওয়া আবশ্যক। কুরআন মাজীদে ‘খামর’ একটি শব্দ আছে। সাধারণত আঙ্গুর থেকে তৈরি মদকে খামর বলে। কিন্তু নবী করীম (সা.) এর যামানায় যে কোন প্রকার মদকেই ‘খামর’ বরে চিহ্নিত করা হত। সেখানে মদ কি দিয়ে তৈরি করা হত তা ছিল গৌণ। তাই দেখা যায় যে, ‘খামর’ সংক্রান্ত আয়াতটি যখন প্রথম নাযিল হয় তখন মদীনার মুসলমানগণ শুধু মদই ফেলে দেয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন