ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বহু মানুষ। ধ্বংসস্ত‚প সরানোর সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসছে লাশ। এমন বাস্তবতায় জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণবিষয়ক সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ভ‚মিকম্পে দেশ দুটিতে মোট মৃত্যু বর্তমান সংখ্যার দ্বিগুণের বেশি হবে।
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম স্কাই নিউজের সঙ্গে আলাপচারিতায় গতকাল এমন কথা জানিয়েছেন জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, কত মানুষের মৃত্যু হবে, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কারণ, ধ্বংসস্ত‚পগুলোতে এখনো খোঁজ চালিয়ে যেতে হবে। তবে আমি নিশ্চিত মৃত্যুর সংখ্যাটা দ্বিগুণ বা এর চেয়ে বেশি হবে।’
সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সোমবারের ভ‚মিকম্পে শুধু তুরস্কে ২১ হাজার ৮৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সিরিয়ায় মারা গেছেন ৩ হাজার ৫৫৩ জন। ফলে দুই দেশে মোট মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৪০১ জনে। এদিকে তীব্র ঠান্ডাসহ নানা প্রতিক‚লতার মধ্যে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। এখনো অনেককেই ধ্বংসস্ত‚প থেকে জীবিত উদ্ধার করা হচ্ছে।
মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ধ্বংসস্ত‚পের নিচে এখনো মানুষ আটকা পড়ে আছে, এটা বেদনাদায়ক। তাঁদের অনেকেই জীবিত। কোনো দুর্যোগের পর প্রথম ৭২ ঘণ্টা উদ্ধারের জন্য ‘সোনালি সময়’ ধরা হয়। সেই সময়টা পেরিয়ে গেছে। তবে এখনো যেহেতু জীবিত মানুষকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তাই কখন উদ্ধারকাজ বন্ধ করা হবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়টা কঠিন। তুর্কি কর্তৃপক্ষ এদিকে ভ‚মিকম্পের কেন্দ্রস্থল কাহরামানমারস থেকে ছয় শিশুকে উদ্ধার করেছে। এসব শিশুকে রাজধানী আঙ্কারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানায়, এসব শিশুর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, এখন তাদের পরিবারকে খোঁজা হচ্ছে। এসব শিশু বর্তমানে আইসিইউতে আছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া না পর্যন্ত তারা আইসিইউতে থাকবে। অপরদিকে সিরিয়ার উত্তর ও উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ভ‚মিকম্পের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আটকা পড়া জীবিতদের খোঁজে তাদের শুরু করা অভিযান শেষ হয়েছে বলে সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনটি হোয়াইট হেলমেটস নামেই বেশি পরিচিত। সিরিয়ায় মোট মৃতের সংখ্যা ৩৫১৩ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে দেশটির উত্তর ও উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে ২১৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে হোয়াইট হেলমেটস জানিয়েছে। আর উত্তরাঞ্চলের সরকার নিয়ন্ত্রিত অংশে ১৩৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, ভ‚মিকম্পে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোকে পুনর্গঠন করতে সরকার এক বছরের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই সময়ে যারা তাঁবুতে থাকতে রাজি নন, তাদের আবাসন ভাড়া বহন করবে সরকার। তুর্কি সংবাদমাধ্যম হুরিয়াত ডেইলি জানিয়েছে, শুক্রবার পৃঃ ৮ কঃ ৬
আদিয়ামান প্রদেশে উদ্ধার ও অনুসন্ধান অভিযান পর্যবেক্ষণে গিয়ে এ ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ভয়াবহ ভ‚মিকম্পে তুরস্কের ১০টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন এক কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষ। ‘আমরা নিশ্চিত করছি যে, আমাদের নাগরিকরা যারা তাঁবুতে থাকতে চান না, তারা এক বছরের ভাড়া পরিশোধ করার অর্থ পাবেন। সেটা দিয়ে তারা তাদের মতো বাসস্থানে থাকতে পারবেন।’ এ সময় এরদোগান জোর দিয়ে বলেন, তুরস্ক তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে। শক্তিশালী ভ‚মিকম্পে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ১৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আহত হয়েছেন ৭৫ হাজারের বেশি। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ওই ভয়াবহ ভ‚মিকম্প তুরস্কের পাশাপাশি প্রতিবেশী সিরিয়াতেও ব্যাপক তাÐব চালিয়েছে। দুই দেশ মিলে নিহতের সংখ্যা ২৪ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছেন লক্ষাধিক। ৮০ হাজারের বেশি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুর্কি নেতা এদিন বলেন, আমরা প্রতি পরিবারকে ১৫ হাজার লিরা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, যার মধ্যে স্থানান্তর সহায়তাও থাকছে। আমরা একটি ব্যাপক কর্মসূচি প্রস্তুত করছি, যা দেশকে, বিশেষ করে ভ‚মিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোকে আবারও উঠে দাঁড়াতে সক্ষম করবে। ‘আমরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি শুরু করেছি, নির্মাণকাজ দ্রæত শুরু হবে’, বলেন এরদোগান। তিনি বলেন, তুর্কি এয়ারলাইন্স ক্ষতিগ্রস্তদের বিনামূল্যে স্থানান্তর করছে। ভ‚মিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি প্রদেশ থেকে অন্তত ৭৬ হাজার মানুষকে সরিয়ে দেশের অন্যান্য অংশে পাঠানো হয়েছে। হুরিয়াত ডেইলি।
লাশের সারির স্তুপ জমে গেছে তুরস্কে। প্রিয় মানুষ আর আত্মীয়-স্বজন হারিয়ে বেদনায় কাতরাচ্ছেন অসংখ্য তুর্কি আর সিরীয় নাগরিক। উদ্ধারকাজ এখনও চলছে। এর মধ্যেই এলো আরও এক ভয়াবহ খবর। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি বলছে, তুরস্কের একটি ভবনের ১৫টি পরিবারের ৩ জন ব্যতীত সবাই মারা গেছে। এমন একটি বহুতল ভবনের নাম ‘অরকান’। ভ‚মিকম্পে ধসে গেছে ভবনটি। যেখানে ১৫টি পরিবার থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করা গেছে। ভয়াবহ ভ‚মিকম্প এসব পরিবার এবং বিল্ডিং ধ্বংস করে দিয়েছে। ভ‚মিকম্পের পরের দিনগুলোতে ওইসব পরিবারের বন্ধুবান্ধব এবং প্রিয়জন ‘অরকানের’ চারপাশে জড়ো হয়েছিল। এই আশায়, যদি কেউ বেঁচে ফেরে। এক দিনেরও বেশি সময় খনন করার পর ধ্বংসস্ত‚প থেকে একজনকে জীবিত টেনে বের করা হয়। কিন্তু তিনজনের বেশি উদ্ধার করা যায়নি। বাকিদের কোনো খোঁজ নেই। সবাই আশা নিয়ে অছে হয়তো তারা ফিরবে। ভবনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন ১৯ বছরের তরুণী সাইয়েদা ওকান। ধসে পড়া ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধু দামলা বলছিলেন, এটাই সাইয়েদার কক্ষ। তিনি এখন আশা করে আছেন, ফিরবেন তার প্রিয় বন্ধু। তাকেও পাওয়া যায়নি। সেখানে জড়ো হওয়া অনেক মানুষ বলছিলেন, এখানে প্রতিবেশীরা প্রায়ই চা বা তুর্কি কফি খেতে একে অপরের বাড়িতে যেতেন। অরকান এবং রাস্তার অন্যান্য বিল্ডিংয়ের বাসিন্দাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রæপও ছিল। তারা নিয়মিত আড্ডা দিতেন। খুব সুন্দর সময় কাটাতেন তারা। এমরুল্লাহ নামে একজন জানান, তিনি স্থানীয় একটি মুদি দোকান চালাতেন। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে এখানে প্রতিবেশীদের বন্ধন কেমন ছিল? সে হাত দুটো এক করে বলেন, এমন। আরো একজন বলছিলেন, অরকান কয়েক দশক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বয়স ৫০ বছর। আমার মনে আছে স্কুলে যাওয়া এবং যাওয়ার পথে এটির পাশ দিয়ে কত হেঁটেছি। ভবনটির নিচে আটকে পড়া মানুষের বেঁচে ফেরার আশা একেবারেই ক্ষীণ। উদ্ধারকর্মীরা ওই স্থানে অপেক্ষারত পরিবারগুলোকে বলছে, আটকে পড়া মানুষের বেঁচে থাকার আশা করবেন না।
ত্রাণের অভাবে চরম সঙ্কটে রয়েছেন উত্তর সিরিয়ার ভ‚মিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। ভ‚মিকম্প আঘাত হানার চার দিন পরও পর্যাপ্ত ত্রাণ পৌঁছায়নি সেখানে। উত্তর সিরিয়ার একটি হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার মোহাম্মদ হাসাউন জানান, ভ‚মিকম্পের পর এখন তাদের কাছে যে চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে তা দেশের উত্তরাঞ্চলের ২০ শতাংশ মানুষের চাহিদাও পূরণ হবে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি শুক্রবার জানিয়েছে, উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় ৯০ শতাংশ মানুষের সাহায্যে প্রয়োজন। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কাজ করছে এমন একটি বেসামরিক ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেট-এর প্রধান জাতিসংঘের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন। তিনি বলেন, ভ‚মিকম্পের পর জাতিসংঘের পদক্ষেপ ছিল খুবই বাজে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের প্রথম ত্রাণ-বাহী গাড়িবহর তুরস্ক থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে ওই অঞ্চলে প্রবেশ করে। বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সিরিয় ভ‚খÐের কিছু অংশে জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ বিতরণ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাশিয়া বলেছে, সাহায্য সামগ্রী দামেস্কের সরকারের মাধ্যমে যাওয়া উচিত। কিন্তু হোয়াইট হেলমেট থেকে দাবি করা হয়, ভ‚মিকম্পের পর সিরিয়ার সরকার উত্তর সিরিয়ায় ‘কিছুই’ পাঠায়নি। সূত্র : আল-জাজিরা, বিবিসি বাংলা ও রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন