বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সর্বযুগের নেতা হযরত মোহাম্মদ (সা.)

বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ

| প্রকাশের সময় : ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নাজির আহমদ জীবন : হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, “আমি আদম সন্তানদের প্রত্যেক যুগের উত্তম শ্রেণিতে যুগের পর যুগ প্রেরিত হয়েছি। শেষে ঐ যুগে জন্মগ্রহণ করি যে যুগে বর্তমানে আমি আছি। (বুখারি শরীফ)
হযরত মোহাম্মদ (সা.) নেতা হিসেবে সর্বযুগের কিনা তা বিচার করতে হলে আমাদের দেখতে হবে তাঁর সম্বন্ধে স্বয়ং স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা কি বলেছেন, রাসূল (সা.) নিজে কি বলেছেন, আর, বিশ্ব মানবতায় তাঁর বিরাট অবদান দেখে পৃথিবীর জ্ঞানী-গুণীগণ ও চিন্তাশীলগণ কি বলেছেন ও বলছেন।
স্বয়ং আল্লাহ বলেন, “আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি বিশ্বের শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে।” (সূরা আম্বিয়া) এখানে দেখা যাচ্ছে তিনটি ব্যাপক বিশ্লেষক শব্দ বিশ্বের শান্তি, বিশ্বের কল্যাণ ও বিশ্ব মানবের মুক্তির পথ প্রদর্শক। এই তিনটি মানুষের বড় আকাক্সিক্ষত বস্তু। এ সবগুলো বাস্তবায়িত করার জন্য যা যা গুণের ও ব্যক্তিত্বের দরকার তা সবই তার মাঝে ছিল।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) এমন এক সময় পৃথিবীতে প্রেরিত হন যে সময় অশান্তি, অনাচার, অবিচারে শুধু আরব নয় সমগ্র বিশ্ব মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়েছিল। বিশ্বের একপ্রান্ত হতে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত যখন মানুষ্যরূপী শয়তানের নারকীয় উল্লাসে প্রকম্পিত হচ্ছিলো। এমন এক যুগে বিশ্ব মানবের ত্রাণকর্তা হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট ১লা জ্যৈষ্ঠ ১২ই রবিউল আউয়াল সোমবার।
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। কিন্তু আদর্শ শিক্ষার অভাবে অনাদর্শ পরিবেশের ঘূর্ণিপাকে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে এবং পশু প্রবৃত্তি ও শয়তান স্বভাবপ্রাপ্ত হয়। তখন, মানুষ আর পশুতে বাহ্যিক চেহারা ছাড়া পার্থক্য থাকে না। তাদের সে অবস্থার কথা তুলে ধরে আল্লাহ বলেন, “তোমরা তো অগ্নিকু-ের প্রাপ্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলে। আল্লাহ তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করলেন।’’ আর রক্ষা করার দোয়া করলেন সে মহান ব্যক্তি হযরত মোহাম্মদ (সা.)।
সর্বযুগের নেতা তিনিই হতে পারেন, যিনি নিজ যুগের সকল সমস্যার সুন্দর সমাধানের ব্যবস্থাই শুধু করেন না, সাথে সাথে সর্বযুগের জন্য একট আদর্শ জীবন ব্যবস্থা দিয়ে যান। এজন্য তাকে নিজ দেশ, জাতি ও সমাজকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হয়, বিশ্বের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করতে হয়। নিজ জীবনে ও সমাজে নিজ আদর্শ প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান করে যেতে হয়। আর সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে আগামীদিনের সমাজ, জাতি ও বিভিন্ন সমস্যাকে পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করে তার জন্য একটা সুন্দর মতাদর্শ বা জীবন ব্যবস্থা দিয়ে যেতে হয়।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর সবচেয়ে বড় অবদান তিনি বিশ্ব মানবকে একত্ববাদের মত বিশেষ নিয়ামত দান করেছেন। তাঁর নব্যুয়ত প্রাপ্তির পূর্বে সারাটা বিশ্ব বিশেষ করে আরববাসীরা নানা প্রকার কুসংস্কার ও পাপ কাজে নিমজ্জিত ছিল। তাওহীদের কেন্দ্রস্থল কা’বায় ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করে তারা পূজা করতো। প্রাণহীণ এসব মূর্তির কাছে মানুষ তার আত্মমর্যাদা বিলিয়ে দিতে লজ্জিত হতো না। নর-নারী, নগ্ন দেহে কা’বা ঘর প্রদক্ষিণ করতে লজ্জাবোধ করতো না। খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো বাচ-বিচার ছিল না। মানুষ আর মানুষ ছিল না। যার ফলে শান্তি ও রহমত বলে কিছু ছিল না। ঠিক এমন এক সময় আল্লাহ মোহাম্মদ (সা.)-কে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করলেন। তাই বর্তমান যুগ এবং কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র যুগটা মোহাম্মদ (সা.)-এর যুগ, আর সর্বযুগের নেতা হলেন “হযরত মোহাম্মদ (সা.)”।
বিশ্বনবী বিদায় হজে একলক্ষ চব্বিশ হাজার জনতার সম্মুখে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা সর্বযুগের সর্বকালের মানুষের জন্য মানবকল্যাণকর বানী। তিনি মানবজাতিকে দুইটি একতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। একটি হচ্ছে : মানবজাতির স্রষ্টার ঐক্য, আর অপরটি হচ্ছে : মানব বংশের প্রতিষ্ঠাতা আদি পিতার ঐক্য। সকল মানুষের ¯্রষ্টা একজন এটি হচ্ছে আত্মিক সম্পর্ক। আর সকল মানুষ একই পিতার সন্তান এটি হচ্ছে রক্তের সম্পর্ক। বিদায় হজের ভাষণে তিনি মানুষকে সম্মান করতে শিখিয়েছেন। মানুষের মর্যাদা দান এটা মানবজাতিকে তাঁর একটা বড় অবদান। মানুষ মানুষের কাছে মাথা নত করবে না, একমাত্র প্রভু আল্লাহর কাছে মাথা নত করবে।
দাস-দাসী ও নারীদের প্রতি যে ব্যবহার করা হতো তা এক লজ্জা ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। তাই, সেদিন বিদায় হজের ভাষণে দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার, তাদের খাদ্য ও বস্ত্রের নিশ্চয়তা দান; পর স্ত্রী, অপহরণ ও ব্যভিচার না করা এবং অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা না করা। এসব ঘোষণা সে সময়ের জন্য তো বটেই সর্বযুগের জন্য একটা সুন্দর যুগান্তকারী ঘোষণা।
মোহাম্মদ (সা.)ই একমাত্র মানুষ যিনি আধ্যাত্মিক, জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করেছিলেন। তিনি জানতেন মানুষের সৃষ্টি রহস্য। মানুষ জন্মগতভাবে কোথায় দুর্বল, কেন মানুষকে পৃথিবীতে আসতে হলো, মানুষের মধ্যে কিসের তাড়না সর্বদা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে, এ থেকে মুক্তির পথ কি, এ সবই তাঁর জানা ছিল। তাই সর্বপ্রথম ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে মানুষকে তিনি পথে এনেছিলেন। এজন্য ব্যক্তি মানুষকে তার মনোজগতে আমূল পরিবর্তন সাধন করেছেন। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য থেকে সংযমী হয়ে জীবনযাপনের জন্য। কারণ ব্যক্তি মানুষ নিয়েই পরিবার; পরিবার নিয়েই সমাজ, সমাজ নিয়েই দেশ জাতি। এ কাজে তিনি যেভাবে সফল হয়েছিলেন তার তুলনা নাই। তিনি ছিলেন মানুষের মনের রোগের বড় চিকিৎসক। কারণ, তিনি জেনেছিলেন নিজেকে জেনেছিলেন তাঁর স্রষ্টাকে, জেনেছিলেন সৃষ্টি রহস্যকে।
তাই তনি মানুষের খাওয়া পরার সমস্যা হতে শুরু করে নাগরিক ও আন্তর্জাতিক সব সমস্যার সমাধান নৈতিক ভিত্তির উপর স্থাপন করেছেন এবং জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের মধ্যে এক পূর্ণ সামঞ্জস্য নির্মাণ করেছেন। তিনি নিজ কাল ও যুগেরই নেতা ছিলেন না, তিনি সর্বকাল ও সর্বযুগেরই নেতা বলেই ইতিহাসের ক্রমবর্ধমান জাতির সাথে অগ্রসর হতে পেরেছেন। তাই, আজও তাঁর আদর্শ ও চিন্তাধারা চৌদ্দশত বৎসর পূর্বের মত তেমনই সুন্দর, তেমনই কল্যাণকর, তেমনই উপযোগী।
হযরত মোহাম্মদ (সা.)-কে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে বিশ্ব মানবের শান্তি ও মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে, মানবীয় গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে মানুষকে মানুষ হয়ে দুনিয়া হতে ফিরে যাবার পথ দেখাতে। তিনি ছিলেন ‘বিশ্বের রহমত’। আল্লাহ বলেন, “হে নবী! আমি আপনাকে বিশ্ব জগতের জন্য কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি।’’ (আল কোরআন) কখন হতে তিনি রহমত? যখন হতে সৃষ্টির সূচনা। তিনি কতদিন পর্যন্ত রহমত? তা হলো যতদিন এ সৃষ্টি জগৎ থাকবে ততদিন। মানব চরিত্রে যত প্রকার গুণ থাকা দরকার তা তাঁর চরিত্রে পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। আল্লাহ বলেন “হে নবী! নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী।” (আল কোরআন)
তিনি আভিজাত্যের গৌরব ও বংশ মর্যাদার মূলে কুঠারাঘাত করেন। মানুষে মানুষে সকল প্রকার অসাম্য ও ভেদাভেদ দূর করেন এবং শুধুমাত্র মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন দৃঢ় করেন। তিনি ঘোষণা করেন, “সকল মানুষ সমান, মানুষের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহর প্রতি সর্বাধিক অনুগত এবং মানুষের সর্বাধিক কল্যাণকামী।
দাস প্রথার মতো নিকৃষ্ট প্রথার বিলোপ সাধন করেন। তিনি ঘোষণা করলেন, “গোলামকে আযাদী দানের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম কাজ আল্লাহর কাছে আর নাই।” তিনি নিজে অনেক দাসকে মুক্তি দিয়েছেন। ক্রীতদাস যায়েদকে সেনাপতি করে এবং হাবসী ক্রীতদাস হযরত বেলাল (রা.)-কে প্রথম মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করে তাদের মুক্তি ও পদমর্যাদার উন্নতির পথ সুপ্রশস্ত করেন।
সভ্যতা গর্বিত গ্রিক হতে শুরু করে আরব ও বিশ্বের সর্বত্র নারীরা ছিল অবহেলিত ও পুরুষদের দাসী ও ভোগের বস্তু। ইসলাম নারীকে অভূতপূর্ব নাগরিক অধিকার দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “পুরুষের নারীর উপর যতটা অধিকার আছে, নারীর ও পুরুষের উপর ঠিক ততটা অধিকার আছে।” রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর প্রতি সর্বোত্তম ব্যবহার করে।” তিনি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি ও মৃত স্বামীর সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকার ও বিবাহে নিজ মতামত ব্যক্ত করার স্বাধীনতা দেন। মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত একথা ঘোষণা করেন।” শিশু কন্যা হত্যার মত জঘন্য প্রথা ও তিনি বন্ধ করেন।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) আরবের রাজনৈতিক জীবনে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। ইসলামপূর্ব যুগে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে দলীয় কোন্দল ও যুদ্ধ লেগে থাকত। বহু দলে বিভক্ত আরববাসীকে তিনি এককেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে এনে শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করেন।
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আরব দেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও বিচারক নিযুক্ত করেন। মদিনার মসজিদে বসে তিনি প্রধান বিচারপতি ও শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, কোরআনের নির্দেশ, নিজ বিচার বুদ্ধি এবং সাহাবাদের সাথে আলোচনা করে। এভাবে ঐশীতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের সমন্বয়ে একটি সুন্দর শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
ইসলামপূর্ব আরবে কোনরূপ সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছিল না। বেশিরভাগ লোক পশু পালন অথবা লুটতরাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। চড়াহারে সুদ গ্রহণ প্রথা প্রচলিত ছিল। হযরত ধন- বৈষম্য দূর করে সঞ্চয় ও বণ্টনের সামঞ্জস্য বিধান করেন। তিনি নীতি সম্মত উপায়ে অর্থ উপার্জন করে তা সাদ্কা ও জাকাতের মাধ্যমে সেই অর্থের কিছু অংশ গরিবদের মধ্যে বণ্টন করার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সম্পদে, জাকাতে, জনসাধারণের অধিকার ও ভোগ করার সুযোগ-সুবিধা থাকে, তা বিবেচনা করে তিনি পাঁচ প্রকার রাজস্বের প্রবর্তন করেন। যথা- (১) আল গনিমাহ, (২) জাকাত, (৩) খারাজ, (৪) জিজিয়া, (৫) আল’ফে। ঐগুলো আয়ের উৎস ছাড়াও সাদ্কা নামে ইচ্ছাধীন এক প্রকার আয়ও রাষ্ট্রের ছিল। এভাবে যে রাজস্ব সংগৃহীত হত তা বায়তুল মালে জমা দেয়া হত এবং নির্দিষ্ট হারে জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হতো। তিনি আরববাসীকে কৃষি কার্য ও ব্যবসা-বাণিজ্যে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেন। এর ফলে নিতান্ত দরিদ্র আরব দেশ একটি সম্পদশালী দেশে পরিণত হয়।
তিনি ছিলেন ‘বিশ্বশান্তি’ প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ। তিনি ছিলেন ‘রাহ্মাতুল্লিল আলামিন।’ সমগ্র সৃষ্টির জন্য আল্লাহর রহমত। পরধর্মে তিনি যেমন ছিলেন পরম সহিষ্ণু, তেমনি পর রাষ্ট্রের প্রতি তার বাণী ছিল শান্তি-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন রাজদরবারে দূত প্রেরণ করেন। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও পারস্পরিক সৌহার্দের নীতিতে মহানবী ছিলেন আস্থাবান। এই নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি আন্তর্জাতিক বিবাহকে স্বীকৃতি দেন। উদার এবং সহনশীলতার পরিচায়ক মদিনা চাটারে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ নীতিতে তিনি একটি সুসঙ্ঘবদ্ধ জাতিই গঠন করেননি, বরং এমন একটি সর্বপ্রথম অলিখিত সংবিধান তৈরি করেন যা পরবর্তী কালের সংবিধানগুলোর অগ্রদৃত ছিল। ঐতিহাসিক গীবনের মতে, ‘মহানবী, ধর্মনেতা, রাজনীতিজ্ঞ এবং প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন। উপরন্ত আল্লাহর উপর প্রগাঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ব্যতীত মানবজাতির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অলিখিত থেকে যেত।’’
ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, “মদীনার ধর্মভিত্তিক সমাজ হতে উত্তরকালে বিশাল ইসলামী, সা¤্রাজ্য গড়ে উঠে। শুধু আরববাসীদের জন্যই তিনি আসেন নাই। শুধু মুসলমানদের মধ্যেই তিনি একতা ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে সন্তুষ্ট হন নাই, তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মিলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদৃত।’’
বিশ্বনবী আজীবন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, কিন্তু তবুও তাঁর অনুসারীগণকে মূর্তিপূজকদের ঘৃণা করতে নিষেধ করেন। এটা তার চরিত্রের এক বড় দিক। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন বলে এটা সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব গণতন্ত্রের বীজ তিনি প্রথম বপন করেন। এজন্য তাঁকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বলা হয়। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্মরণ করে এবং তাঁর গণতান্ত্রিক চেতনা ও সাম্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন বিখ্যাত নেত্রী সরোজিনী নাইডু যে বক্তব্য ব্রিটিশ শাসকদের সামনে তুলে ধরেন তার কিছু অংশ এখানে উদ্বৃত্ত করা হলো- “ঋড়ৎ ৎবসবসনবৎ ঃযধঃ যিধঃ ুড়ঁ ফৎবধস ঃড় ফধু ধিং হড়ঃ সবৎবষু ফৎবধসঃ, নঁঃ ভঁষভরষষবফ ভড়ঁৎঃববহ যঁহফৎবফ ুবধৎং ধমড়. ডযবহ ঃযব ষড়হবষু ফৎবধসবৎ ড়ভ ঃযব ফবংবৎঃ পড়সসঁহরহম রিঃয ঃযব ংঃধৎং, ভরৎংঃ ৎবধষরুবফ ঃযব নৎড়ঃযবৎ যড়ড়ফ ড়ভ সবহ.”
ইসলাম ও মুসলমানের সার্বজনীনতায় মুগ্ধ হয়ে সরোজিনী নাইডু বলেছেন- “ওংষধস ঢ়ৎবধপযবং ঁহরাবৎংধষ নৎড়ঃযবৎযড়ড়ফ, ধ পড়সঢ়ষবঃব ফবসড়পৎধপু ঃড়ধিৎফং যিরপয ঃযব বিংঃবৎহ পড়ঁহঃৎু রং নবপড়সরহম হবধৎবৎ ধহফ  হবধৎবৎ. ওংষধস রং ফবংঃরহবফ ঃড় নবপড়সব ঃযব পড়হাবৎমরহম ঢ়ড়রহঃ ড়ভ রিফবষু ফরাবৎমবহঃ পৎববফং.”
হযরত মোহাম্মদ (সা.) বিশ্ব মানবের জন্য এমন এক আদর্শ স্থানীয় যুগনেতা যাকে ছাড়া বিশ্ব মানবতা অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। তিনি বিশ্ব মানবের জন্য এমন এক জীবন ব্যবস্থা নিয়ে এসেছিলেন যা সর্বযুগের মানুষের সব সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারে। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।
এজন্য বিখ্যাত মনীষী জজ বার্নাড়’শ বলেছেন, ‘‘যদি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায়, আদর্শ, মতবাদ সম্পন্ন মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক নায়কের শাসনাধীনে আনা যেত, তবে একমাত্র মোহাম্মদ সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালনা করতে পারতেন।’’
মোহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিশেষের কাছ হতে জ্ঞান লাভ করেন নাই। তাঁর শিক্ষাদাতা ছিলেন স্বয়ং মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহ। আর জ্ঞান লাভ করেছিলেন আল্লাহর এ সৃষ্টি বিশাল বিশ্ব প্রকৃতি হতে। তিনি নিজেও বলেছেন- ‘‘আমাকে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সকলের জ্ঞান দান করা হয়েছে।’’ এত জ্ঞান আর কোন নবীকে এবং কোন মানুষকে দান করা হয় নাই। তাই ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর ঠিকই বলেছেন, “ঐব ধিং হড়ঃ ড়হষু ধ সধংঃবৎসরহফ ড়ভ যরং ড়হি ধমব, নঁঃ ড়ভ ধষষ ধমবং”–অর্থাৎ তিনি শুধু তাঁর সমসাময়িক কালেই নয়, বরং সর্বযুগের ও কালের মানুষের মধ্যে সুনিপুণ বিদ্যাবত্তার প্রতীক।’’ তাই, তিনি জগৎ গুরু মর্যাদালাভের একমাত্র বরেণ্য ব্যক্তি। হযরতের চরিত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে জোসেফ হেল বলেন, “মোহাম্মদ, এমনই একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন যারে না হলে বিশ্ব অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর কৃতিত্বময় ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে।’’
নিজ যুগ বা কালকে ছাড়িয়ে তিনি সর্বকালের জন্য চিন্তা-ভাবনা করে সমস্যার সমাধান রেখে গেছেন; কেবল তিনিই হলেন সর্বযুগের সর্বকালের নেতা। অনুসরণীয় সর্বোত্তম মহান ব্যক্তি। তাই তিনিই কালজয়ী। আর তা কেবল পার্থিব বিষয় নিয়ে হলে চলবে না। কারণ, মানুষ কেবল দেহ সর্বস্ব জীব নয়। আত্মা নামক এক অবিনশ্বর শক্তির অধিকারী। পৃথিবীতে কেবল ভোগ সর্বস্ব জীবনের জন্য তাকে পাঠানো হয়নি। তাকে পাঠানো হয়েছে এজন্য যে, তার মাঝে যে অমূল্য সম্পদ আত্মা আছে তার বিকাশ ও পবিত্রতা ঘটায়ে পৃথিবী হতে আত্মার জগতে ফিরে যাবার জন্য। কারণ; আমাদের আদি ঠিকানা তো এ মাটির পৃথিবী নয়। তা’হল আলমে আরওয়াহ্ বা আত্মার জগৎ। (চলবে)

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
মিরানা আক্তার ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১:৩০ এএম says : 0
এই লেখাটির জন্য লেখক ও ইনকিলাবকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন