ম্যাচ শুরুর নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। তার আগে সমাপনী কনসার্ট দুপুর ৩টা থেকে। দর্শক প্রবেশের জন্য গেট খোলা হয় দুপুর ১টায়। কিন্তু আরও কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সবকয়টি প্রবেশদ্বারেই লোকে লোকারণ্য। সাদা চোখে দেখলে বিপিএল ফাইনাল নিয়ে দর্শক উন্মাদনার প্রতিচ্ছবিই বলা যায় এটিকে। তবে কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে কালোবাজারির কাছ থেকে মোটা অঙ্কে কেনা, এবং ফাইনাল ছুটির দিনে না হওয়ার আক্ষেপে যা রূপ পেয়েছে বিষাদে।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ডিআরএস না থাকা, ভালো মানের বিদেশি ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিসহ নানান বিষয়ে তুমুল সমালোচিত হয়েছে বিপিএল। তবে টুর্নামেন্টের শেষ দিকে এসে সব কিছু ছাপিয়ে দর্শক আগ্রহের কেন্দ্রে জায়গা করে নিয়েছে দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ঘরোয়া আসর। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে লড়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ও চমক জাগানিয়া সিলেট স্ট্রাইকার্স। এমনিতে কোনো টুর্নামেন্টের ফাইনাল সাধারণত হয় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে। কিন্তু বিপিএলের পর্দা নেমেছে গতকাল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে। তবু ক্রিকেটপ্রেমী জনতাকে দমিয়ে রাখার সাধ্য কার! খেলা শুরুর অনেক আগে থেকেই ভরে উঠতে শুরু করে প্রতিটি গ্যালারি। ঢাকার কাছাকাছি নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুর তো বটেই, প্রিয় দলের সমর্থনে কুমিল্লা ও সিলেটের মানুষেরও ঢল নেমেছে শের-ই বাংলায়। খেলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই ‘সিলেট... সিলেট’ আর ‘কুমিল্লা... কুমিল্লা’ সেøাগানে মুখর স্টেডিয়াম প্রাঙ্গন।
আগের দিন সকাল ৯টায় শুরু হয়েছিল ফাইনালের টিকিট বিক্রি। তারও আগে থেকে শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামের এক নম্বর গেটসংলগ্ন কাউন্টারে ছিল টিকিট প্রত্যাশীদের ভিড়। পরে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাউন্টার থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, শেষ হয়ে গেছে ৩০০ (ইস্টার্ন) ও ৪০০ (নর্দার্ন ও সাউদার্ন) টাকার টিকিট। এতে টিকিট কিনতে আসা উৎসাহীদের মধ্যে দেখা দেয় অসন্তোষ। টিকিটের আশায় ম্যাচের দিন সকালেও কাউন্টারের সামনে ভিড় জমান অনেক দর্শক। তবে তাদের প্রায় সবাইকেই ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। যারা টিকিট কিনতে পেরেছেন তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন, ছোটখাটো যুদ্ধ করে ফিরেছেন তারা।
ফাইনাল ম্যাচই শুধু নয়, এ দিন দুপুর থেকে দেশের খ্যাতিমান কয়েকজন ব্যান্ড তারকাকে নিয়ে বিশেষ কনসার্টের আয়োজনও করা হয়েছে। দর্শকের আগ্রহ তাতে বেড়ে গেছে আরও। তবে টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতায় জেমস, মাকসুদদের গানও যেন বিরস মুখে শুনেছেন দর্শকরা। কাউন্টারে না পেয়ে ৩০০ টাকার টিকিট ৮০০ টাকায় কিনেছেন ঢাকার ফার্মগেট থেকে আসা কামরান। বাড়তি টাকা খরচ করে টিকিট কেনার হতাশা এই তরুণের কাছে চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজাকে ফাইনালে সামনে থেকে খেলতে দেখার আশায়, ‘বৃহস্পতিবারে খেলা হওয়ায় ভেবেছিলাম ভিড় কম হবে। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে এসে দেখি, কাউন্টারে অনেক ভিড়। কোনো টিকিট নেই। খুব বাজে অবস্থা। একবার ভেবেছি চলেই যাব। তবু শেষ পর্যন্ত কালোবাজারে কিনলাম। মাশরাফি ভাই আরেকবার চ্যাম্পিয়ন হবে দোয়া করি।’
কুমিল্লা থেকে বন্ধুদের নিয়ে খেলা দেখতে এসেছে রাজিয়া সুলতানা রিমি। ঢাকায় থাকা বন্ধুদের মাধ্যমে আগের দিনই টিকিট করে ফেলেন তিনি। বৃহস্পতিবার সকালে ট্রেনে করে ঢাকায় এসে মাঠে ঢোকার মুখে কথা হয় তার সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের জয়ের আশা করছেন তিনি, ‘কুমিল্লা বরাবরই ভালো দল। প্রতিবারই মনে হয় চ্যাম্পিয়ন হবে। এবার তো শেষ দিকে অনেক ভালো ক্রিকেটাররা এসেছে। মাশরাফি ভাইকে যদিও আমার ভালো লাগে। কিন্তু কুমিল্লার ঘরেই শিরোপা দেখতে চাই।’
নিয়মিতই শেরেবাংলায় খেলা দেখেন হাসনাইন মোহাম্মদ আকিফ। টিকিটের ব্যাপারে অনিশ্চয়তায় তিনি ফাইনাল দেখা নিয়ে ভুগছিলেন সংশয়ে। পরে কাউন্টারে গেলেও টিকিট প্রত্যাশীদের দীর্ঘ সারি দেখে ফিরে যাচ্ছিলেন খালি হাতে। শেষ পর্যন্ত অনেকটা নাটকীয়ভাবে কাটতে পেরেছেন নিজের ও স্ত্রীর জন্য খেলা দেখার টিকিট। টিকিট পাওয়ার উচ্ছ্বাস থাকলেও বিসিবির প্রতি অভিযোগও থাকল আকিফের কণ্ঠে, ‘অনেক সমালোচনা, অনেক বিতর্কের মাঝেও এত এত মানুষ খেলা দেখতে মাঠে আসে। বিসিবির উচিত তাদের এই প্যাশনকে সম্মান করা। সবকিছু আরও ভালোভাবে ব্যবস্থা করা। আজকের ফাইনাল ম্যাচটি যেমন বৃহস্পতিবার না দিয়ে সহজেই শুক্রবারে করা যেত। এসব ছোট ছোট বিষয় মাথায় রাখলে সবকিছু আরও সুন্দর করা সম্ভব।’
স্টেডিয়ামের ৪ নম্বর ও ৫ নম্বর গেটের মাঝামাঝি জায়গায় রীতিমতো হাঁক ডেকে ৩০০ টাকার টিকিট ৮০০ টাকা এবং ৪০০ টাকার টিকিট ১ হাজার টাকায় বিক্রি করছিলেন একজন। পুলিশ আসতে দেখে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করলেও তিনি পরে আবার শুরু করেন কালোবাজারে টিকিট বিক্রি। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় নতুন এক গল্প। কালোবাজারে টিকিট বিক্রির আগে তিনি নিজেও এসব কিনেছেন আরেক কালোবাজারির কাছ থেকে! তবে কারও পরিচয় খোলাসা করতে রাজি হননি তিনি, ‘দাম আসলে কম রাখার সুযোগ নেই ভাই! আমিই ৩০০ টাকার কিনেছি ৫০০ টাকা দিয়ে। ৪০০ টাকার টিকিটও সাড়ে ৬শ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। অনেকগুলি টিকিট বিক্রি করে ফেলেছি। আর কিছুক্ষণ পর হয়তো আরও বেশি দামে বেচতে পারবো।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন