বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

প্রশ্ন: ইমাম আজমের দুনিয়া বিরাগ কিরূপ ছিল?

| প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

উত্তর: যারা আল্লাহর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন। সবসময় তারা দুনিয়াকে এড়িয়ে চলতেন। দুনিয়াতে বেঁচে থাকার প্রয়োজনকে সামনে রেখে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই চেষ্টা করতেন। দুনিয়াকে স্বাদের, আহলাদের, আনন্দের আসল জায়গা চিন্তা করতেন না। কিভাবে চললে আল্লাহ খুশি হবেন পরকালে উচ্চতর স্থানে স্থান পাবেন এই ছিল তাদের সব সময়ের চিন্তাা। তাদের জ্ঞান ধ্যান চেষ্টা সাধনা শুধু আল্লাহকে খুশি করা। তাদের রাত কাটত জ্ঞান সাধনায়, নামাজে দাড়িয়ে, কান্নায় আর দিন কাটত দ্বীন প্রচারে, জ্ঞান ছড়ানোয় আর মানুষের সেবায়। এই ক্ষেত্রে ইমাম আযম আবু হানিফা রাহঃ এর জুড়ি নেই। ইবনে মুবারক রাহঃ বলেন, আমি কুফা সফরে এলাম। এখানে এসে জানার ইচ্ছা জাগল যে, এই শহরে সবচেয়ে বড় ফকিহ্ কে? লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতেই জবাব এল, আবু হানিফা। আবার জানতে চাইলাম সবচেয়ে বড় দুনিয়া ত্যাগী কে? উত্তর এল আবু হানিফা। আবার প্রশ্ন করলাম সবচেয়ে বড় মোত্তাকী কে? জনগন এও জবাব দিল আবু হানিফা। ইমাম শাফেয়ী রাহঃ বলেন, ফিকহের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার কাছে সবাই ঋণী। তিনি যখন কোরআন পড়তেন রাতের বেলা নামাজে দাঁড়াতেন দুর থেকে তাঁর কান্নার করুন আওয়াজ শোনা যেত নামাজে দাঁড়িয়ে এক আয়াত অনেক সময় বার বার পড়তে থাকতেন। আবু হানিফা রাহঃ তখনকার বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। প্রতিদিন তার ব্যবসায় লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেন হত। দেশের বিভিন্ন শহরে তার ব্যবসার শাখা ছিল। তবে তার ব্যবসার ও অর্থ উপার্জনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের উপকার করা। তিনি অনেক ভক্ত ও বন্ধু বান্ধবদের জন্য মাসিক ভিত্তিতে নিজের অর্থ থেকে ভাতা নির্ধারন করে দিয়েছিলেন। আল্লাহভীতি তাঁর অন্তরে আসন গেড়ে বসেছিল। আল্লাহর ভয়ে দুচোখের পানি ফেলা তাঁর অভ্যাসে পরিনত হয়ের্ছিল। আব্দুর রাজ্জাক রাহঃ বলেন, আমি যখনই আবু হানিফা রাহঃ এর দিকে তাকিয়েছি তখনই তাঁর চেহারায় কান্নার চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। আবু হানিফা রাহঃ সুন্দর চেহারার অধিকারী ছিলেন, সব সময় সুন্দর বেশভূষা পছন্দ করতেন। অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। উদার হস্তে দান করতেন। ইবরাহিম ইবনে উৎবা চার হাজার দিরহামের ঋণে জর্জরিত ছিলেন। লজ্জায় তিনি বের হতেন না। তাঁর এক বন্ধু চাঁদা তুলে ঋণ পরিশোধের উদ্দোগ নিলেন। তিনি যখন ইমাম আবু হানিফা রাহঃ এর নিকট গেলেন, ইমাম জিজ্ঞাসা করলেন তার কি পরিমান ঋণ আছে? বন্ধু জবাব দিল চার হাজার দিরহাম। ইমাম সাহেব সাথে সাথে এই চার হাজার দিরহাম দিয়ে দিলেন। হাফস ইবনে আব্দুর রহমান ইমাম আবু হানিফা রাহঃ এর ব্যবসায় শরিক ছিলেন। আবু হানিফা রাহঃ তার কাছে রেশমী কাপড়ের পণ্য পাঠাতেন। একদিন তিনি প্রচুর পণ্য পাঠালেন আর বলে দিলেন অমুক অমুক থানে ত্রুটি রয়েছে। বিক্রি করার সময় ক্রেতার নিকট ত্রুটিগুলো বলে বিক্রয় করবে। হাফস ইবনে আব্দুর রহমান বিক্রি করার সময় এই ব্যাপারটি ভুলে গেলেন। ইমাম আজম এই বিষয়টি জানতে পেরে বিক্রিত পণ্যের সব মূল্য দান করে দেন। বিক্রিত মূল্য ছিল ৩০ হাজার দিরহাম। একবার খলিফা মনসুর তাঁকে ডেকে পাঠালেন। খলিফা অনেক ইজ্জত সম্মান দেখালেন। আবু হানিফা রাহঃ এর বিদায়ের সময় খলিফা তাঁকে ৩০ হাজার দিরহাম ভর্তি একটি থলে উপহার দিলেন। আবু হানিফা রাহঃ তাকওয়ার দৃঢ়তা নিয়ে খলিফাকে বললেন, আমিরুল মুমিনিন আমি বাগদাদের একজন সাধারণ লোক আপনার এত দিরহামের আমি হেফাজত করতে পারব না। বরং আপনার রাজকোষেই তা জমা থাকুক। আমার প্রয়োজন হলে আপনার নিকট থেকে চেয়ে নেব। ইমাম আজমের মৃত্যুর পর তাঁর ঘরে মানুষের অনেক আমানত পাওয়া গেল। যার পরিমান খলিফার উপহারের চেয়ে অনেক বেশী। খলিফা তা জানতে পেরে বললেন, আবু হানিফা আমাকে ফাঁকি দিয়েছেন। আমার থেকে কোন কিছু গ্রহণ করতে তিনি চাননি। এই না চাওয়া সত্ত্বেও আমার উপহার আমাকে সুন্দর ভাবে ফেরত দিয়েছেন। মানুষ নেতৃত্ব গ্রহন করার জন্য উদগ্রীব থাকে। নেতৃত্ত্ব পাওয়ার জন্য এমন কিছু নাই যে মানুষ করে না। আবু হানিফা রাহঃ এর পদতলে নেতৃত্ব এসে হামাগুড়ি দিয়েছে। কিন্তু জেল জুলুম বেত্রাঘাতের বিনিময়ে তিনি এই নেতৃত্ত্ব ছুড়ে ফেলেছেন। তাকওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। রাবি বিন আসেম বলেন, আমাকে ইয়াজিদ বিন বিন ওমর বিন হুবায়রা আবু হানিফা রাহঃ এর নিকট প্রেরণ করে খাদ্য মন্ত্রণায়য়ের দায়িত্ব গ্রহন করার জন্য প্রস্তাব পাঠালে তিনি তা গ্রহন করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। এতে ক্রুধাম্বিত হয়ে ইবনে হুবায়রা আবু হানিফা রাহঃ কে বিশটি বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন। আবু হানিফা বিশটি বেত্রাঘাত সয়ে নেন। তারপরও মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহন করেন নি। খলিফা মনসুর ইমাম আবু হানিফাকে বিচারকের দায়িত্ব দিতে চাইলেন। আবু হানিফা উত্তরে বললেন, আমি বিচারক হওয়ার যোগ্য নই। খলিফা বললেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। আবু হানিফা রাহঃ তখন বললেন, আপনিই আমাকে বিচারক না হওয়ার অযোগ্যতার রায় দিয়েছেন। আমি যদি মিথ্যাবাদী হই তবে এমনিতেই বিচারক হতে পারি না। কারন একজন মিথ্যাবাদী কখনও বিচারক হতে পারে না। দ্বিতীয়ত যদি সত্যবাদী হয়ে থাকি তবে আমি আমিরুল মুমিনিন কে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমি বিচারক হওয়ার যোগ্য নই। এভাবে তিনি বিচারকের দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে জেলে বন্দি করা হয় । এরপর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি জেলখানায় ছিলেন। তারপরও তিনি খলিফা মনসুরের কথা মেনে বিচারকের পদ গ্রহন করেন নি। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তাঁর প্রিয়দের পথে পরিচালিত করুন। আমিন।


উত্তর দিচ্ছেন: মুন্সি আব্দুল কাদির, ইসলামী গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন