ইউক্রেনের সংঘাতের অবসানের লক্ষ্যে চীন মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে চাইছে এবং এজন্য কতগুলি নীতিমালা ঘোষণা করেছে। এই নীতিমালায় দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা, দু’দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো এবং হানাহানি বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিবিসি সংবাদদাতা টেসা ওয়ং লিখছেন, গত এক বছরে পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চীনের সাহায্য পাওয়ার চেষ্টা করেছে। বেইজিং সরকার এখন সে বিষয়ে এপর্যন্ত সবচেয়ে সবল প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, যা অনেক পশ্চিমা দেশের পছন্দ নাও হতে পারে। সাম্প্রতিক দিনগুলিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র ইউরোপ সফরের মধ্য দিয়ে চীন সবার মন জয় করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, অবশ্য যেটি শেষ হয়েছে মস্কোতে ওয়াংকে ভ্লাদিমির পুতিনের উষ্ণ অভ্যর্থনায় মধ্য দিয়ে।
ইউক্রেন প্রশ্নে চীন মূলত একটি নয় বরং দুটি অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে – প্রথমটি, যুদ্ধের অবসানে চীনা সমাধানের প্রস্তাব, এবং অন্যটি, বিশ্ব-শান্তির লক্ষ্যে এক পরিকল্পনার রূপরেখা। এগুলি মূলত চীনা বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি, গত এক বছর ধরে চীনা নেতারা যা বলে আসছেন। এতে রয়েছে: (ইউক্রেনের জন্য) সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহ্বান এবং (রাশিয়ার) জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ রক্ষা করে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) একতরফা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করা।
এসব বিষয় পশ্চিমা দেশগুলোকে হয়তো খুশি করবে না, কিন্তু তাদের খুশি করা কখনই চীনের প্রধান লক্ষ্য ছিল না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনের যা লক্ষ্য তা হচ্ছে প্রথমত, বিশ্বের শান্তিরক্ষক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করা। তারা আসলে কাকে দলে টানতে চাইছে সেটার সুস্পষ্ট ইংগিত রয়েছে তাদের একটি দলিলে যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা - তথাকথিত গ্লোবাল সাউথের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে চীন বিশ্বের বাদবাকি সেইসব দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে যারা এখন নজর রাখছে পশ্চিমা দেশগুলো কীভাবে ইউক্রেন সংকট মোকাবেলা করে তার ওপর। চীনের আরেকটি লক্ষ্য হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একটি সুস্পষ্ট বার্তা পাঠানো।
ব্রিটেনের নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের একজন বিশেষজ্ঞ ড. আলেকজান্ডার কোরোলেভ বলছেন, "এর মধ্যে বিরুদ্ধাচরণের স্পর্ধা দেখানোর একটি ব্যাপারে রয়েছে।" "এটি বার্তা দিচ্ছে: 'আমাদের মধ্যে সম্পর্ক যদি খারাপ হয়, তাহলে আমরা অন্য কারও কাছে যেতে পারি। রাশিয়া একা নয়, যার মানে হল যখন যুদ্ধ হবে তখন আমরাও একা থাকব না ... তাই ধমকা-ধমকি করে পার পাবেন না।'"
যে সময়ে এই বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা থেকে ব্যাপারটা খোলাসা হয়েছে, বলছেন পর্যবেক্ষকরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তিক্ত। এটি আরও খারাপ হয়েছে সম্প্রতি স্পাই বেলুন ঘটনায়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, চীন কেন ঠিক এই সময়টাতে ইউক্রেনের শান্তির জন্য কূটনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে। "নেতৃত্ব দেখানোর জন্য যথেষ্ট সুযোগ চীনের ছিল,” বলছেন ড. কোরোলেভ, “লড়াইয়ের অবসান ঘটাতে ভূমিকা রাখার জন্য প্রথম দিকেই তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ... যদি সত্যি তাদের লক্ষ্য থাকতো বিশ্বনেতা হিসেবে ভাবমূর্তি গড়ে তোলা, তাহলে গত একটি বছর দেশটি দর্শকের ভূমিকায় থাকতো না।"
চীনের তৃতীয় একটি লক্ষ্য রয়েছে, এবং ওয়াংয়ের ভ্রমণ-সূচি থেকে এটা বোঝা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং হাঙ্গেরি, যে দেশগুলোর নেতারা রাশিয়ার প্রতি কম কট্টরপন্থী বলে চীন বিশ্বাস করে, এসব দেশ সফর করে ওয়াং হয়তো দেখতে চাইছেন যে ইউরোপের কিছু অংশকে চীনা বলয়ের দিকে প্রলুব্ধ করা যায় কিনা। ইস্ট চায়না নর্মাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ ঝ্যাং শিন বলছেন, এই দেশগুলির সাথে বেইজিং "স্বার্থের যৌক্তিক মিলন" দেখতে পাচ্ছে। "চীন বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্র একটি আধিপত্যবাদী শক্তি এবং তার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ট্রান্সআটলান্টিক বিশ্বের একটি বড় অংশ হয়তো উপকৃত হবে।“
কিন্তু সেই নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে চীন আদৌ সফল হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে ওয়াংয়ের যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা ঘর বোঝাই আমেরিকার কট্টর মিত্ররা ভালভাবে গ্রহণ করেনি, এবং কূটনীতিকদের মতে, এই ভাষণ শুধুমাত্র চীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবিশ্বাসের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরে "খোলাখুলি গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে: 'ইউরোপের সাথে আমাদের কোন সমস্যা নেই, মূল সমস্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। ইউরোপীয়দের সাথে সমস্যা আমরা দূর করতে পারি এবং আপনাদের বুঝতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র আপনাদের সমস্যাপূর্ণ রাস্তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বলছেন জার্মানির মার্শাল ফান্ড থিংক ট্যাঙ্কের ইউরোপ-চীন সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ একজন সিনিয়র ফেলো অ্যান্ড্রু স্মল। "কিন্তু আমি মনে করি ইউরোপের বেশিরভাগ জায়গায় এই বার্তাটির প্রতি কেউ খুব একটা আকৃষ্ট হবে না।"
এখন মূল প্রশ্ন হলো, রাশিয়াকে আলিঙ্গন করার পাশাপাশি চীন শান্তি স্থাপনে তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে পারবে কিনা। যুক্তরাষ্ট্র এ সপ্তাহে সতর্ক করেছে যে চীন রাশিয়াকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করার কথা বিবেচনা করছে, এবং চীনা সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই প্রাণঘাতী নয় এবং দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায় এমন প্রযুক্তি সরবরাহ শুরু করছে। এসব যন্ত্রপাতি বেসামরিক এবং সামরিক দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায়, যেমন ড্রোন এবং সেমি-কন্ডাকটর। এর জবাবে চীন প্রকাশ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। কিন্তু বন্ধ দরজার আড়ালে ওয়াং ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কর্মকর্তা জোসেপ বোরেলকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করবে না।
বোরেল জানিয়েছেন, ওয়াং তাকে আরও জিজ্ঞাসা করেছিলেন: "আপনারা যখন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছেন তখন আমরা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করছি কিনা, তা নিয়ে কেন উদ্বেগ প্রকাশ করছেন?" পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই বাক্যটির মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে চীনা সরকার এখনও সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করে যে এই যুদ্ধে ইন্ধন জোগানোর জন্য পশ্চিমারাই দায়ী। "যুদ্ধরত কোন এক পক্ষের কাছে অস্ত্র পাঠানো লড়াই বৃদ্ধির প্রচেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করা হয় - এখন পর্যন্ত এটাই চীনের অবস্থান," বলছেন ড. ঝ্যাং।
বেইজিং শেষ পর্যন্ত মস্কোকে অস্ত্র সরবরাহ করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে, কারণ তাহলে তা চীনা স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। অন্যরা এধরনের পদক্ষেপকে সংঘাত বৃদ্ধি হিসাবে দেখবে এবং নিষেধাজ্ঞা ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যে আরও ব্যাঘাত ঘটবে, যা চীনের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর কারণ হবে। ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনও চীনের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারদের অন্যতম। এতে বিশ্বব্যাপী উত্তেজনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে এবং সম্ভবত মিত্রদেশগুলোকে আরও বেশি করে আমেরিকার বলয়ের দিকে ঠেলে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে গিয়ে এসব দেশকে কাছে টানার চীনা কৌশলটি তখন নস্যাৎ হয়ে যাবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, যেটা ঘটার সম্ভাবনা বেশি তা হলো বেইজিং সরকার রাশিয়ার প্রতি পরোক্ষ সমর্থন অব্যাহত রাখবে কিংবা বাড়িয়ে দেবে। যেমন, অর্থনৈতিক বাণিজ্য যা মস্কোর অর্থনৈতিক জীবনের একটি চাবিকাঠি। তারা একই সাথে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেকোন নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে থাকবে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ক’দিন আগে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন যে দু’দেশের মধ্যে "বন্ধুত্ব সীমাহীন।" সেই বিশেষ বন্ধুর জন্য চীন আর কতদূর যেতে পারে, এক বছর পর চীনকে সেই প্রশ্নের উত্তরও দিতে হবে। সূত্র: বিবিসি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন