অহংকার একটি ঘাতক ব্যাধি। পবিত্র কোরআনে নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে এই ঘাতক ব্যাধির কথা। ঘাতক ব্যাধি বললাম, কারণ তা মানুষের অন্তর্জগৎকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। আর এর পরকালীন ক্ষতিতো রয়েছেই। যে অহংকার শয়তানকে ‘শয়তানে’ পরিণত করেছে, অভিশপ্ত করে দিয়েছে, রহমতবঞ্চিত করেছে, সে অহংকারের মন্দ দিক সম্পর্কে আর কিছু না বললেও চলে। এরপরও আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার প্রকাশ করে তাদেরকে অবশ্যই আমি আমার নিদর্শনাবলি থেকে বিমুখ করে রাখব। (সূরা আরাফ : ১৪৬)।
‘তোমাদের মাবুদ এক মাবুদ। সুতরাং যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না তাদের অন্তরে অবিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেছে এবং তারা অহংকারে লিপ্ত। স্পষ্ট কথা, তারা যা গোপনে করে তা আল্লাহ জানেন এবং যা প্রকাশ্যে করে তাও। নিশ্চয়ই তিনি অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা নাহল : ২২-২৩)।
উদ্ধৃত আয়াতগুলো থেকে আমরা মোটা দাগের যে শিক্ষা পাই তা এমন, ১. অহংকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাঁর নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন। তার অন্তর ও চোখকে তিনি সত্য অনুধাবন এবং সঠিক পথ অবলম্বন থেকে ‘অন্ধ’ করে দেন। পবিত্র কোরআনের কত জায়গায় আল্লাহ জ্ঞানীদের বলেছেন তার নির্দশনাবলি নিয়ে চিন্তা করার কথা। এ চিন্তা মানুষের সামনে আল্লাহপাকের বড়ত্ব-কুদরত এবং আমাদের ওপর তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ ফুটিয়ে তোলে। তখন স্বাভাবিকভাবেই মহান প্রভুর কাছে সে নিজেকে পরিপূর্ণরূপে সঁপে দিতে প্রস্তুত হয়ে ওঠে; কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত হয়। তাই আল্লাহ যদি কাউকে তাঁর ওসব নিদর্শন থেকে বিমুখ করে রাখেন তাহলে সে যে দ্বীনের মূল ও সরল পথ থেকেও ছিটকে যাবে তা তো বলাবাহুল্য।
২. আল্লাহ তায়ালার প্রতি যার বিশ্বাস নেই, পরকালে বিশ্বাস নেই, অহংকার তো শুধু তারাই করতে পারে। ৩. অহংকারীকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। কী ইহকাল আর কী পরকাল, একজন মানুষের অশান্তি, লাঞ্ছনা আর বঞ্চনার জন্যে এর পরে কি আর কিছু লাগে? ‘আল্লাহ সর্বশক্তিমান’ এ বিশ্বাস যাদের আছে তাদেরকে এ কথা মানতেই হবে, প্রকৃত সম্মান পেতে হলে আল্লাহ তায়ালার প্রিয়ভাজন হতেই হবে।
আলোর দিশারী আমাদের প্রিয় নবী (সা.)। মানবজীবনের কোন দিকটি এমন, যেখানে তাঁর কোনো নির্দেশনা পাওয়া যাবে না! অহংকারের ভয়াবহতা তিনি অনেক হাদিসেই স্পষ্ট করে বলেছেন। বিভিন্ন শব্দে বলেছেন; বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছেন। একটি হাদিস লক্ষ্য করুন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তিল পরিমাণ অহংকার যার অন্তরে আছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না, আর তিল পরিমাণ ঈমান যার অন্তরে আছে সে দোজখে যাবে না। (জামে তিরমিজি : ১৯৯৮)।
এখানেও দু’টি বিষয় লক্ষণীয় : এক. অহংকারী ব্যক্তি জান্নাতে যেতে পারবে না। জান্নাতে যেতে হলে আল্লাহ তায়ালার কাছে উপস্থিত হতে হবে অহংকারমুক্ত ‘কলবে সালীম’ নিয়ে। দুই. এই হাদিসে জান্নাতের বিপরীতে দোজখের কথা যেমন বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি ঈমানের বিপরীতে উল্লেখিত হয়েছে অহংকারের কথা। অথচ ঈমানের বিপরীত তো কুফর। বোঝাই যাচ্ছে, হাদিসে কত ভয়াবহরূপে অহংকারকে চিত্রিত করা হয়েছে, বিন্দু পরিমাণ অহংকার নিয়েও কেউ জান্নাতে যেতে পারবে না!
অহংকার যে মানুষকে কতটা অন্ধ ও বাস্তবতাবিমুখ করে তোলে, সেই দৃষ্টান্তও রয়েছে পাক কোরআনে। মানুষ হিসেবে যে যত পাপ করেছে, ফেরাউন ও নমরুদের সঙ্গে কি কারও কোনো তুলনা চলে! তারা যে অবাধ্যতার সব রকম সীমালঙ্ঘন করেছিল-এর মূলেও এই অহংকার। অহংকারের ফলে যখন নিজেকে বড় আর অন্যদের তুচ্ছ ভাবতে শুরু করল, এরই এক পর্যায়ে নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করে বসল! আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে যখন কেউ কোনো কিছুকে শরীক করে, হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী সেটা সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ। কোরআনে বলা হচ্ছে-এ শিরকের গোনাহ আল্লাহ ক্ষমা করবেন না! এ তো অন্যকে আল্লাহর সঙ্গে শরীক করলে। তাহলে কেউ যদি নিজেকেই খোদা বলে দাবি করে, সে অপরাধ কতটা জঘন্য-তা কি বলে বোঝানো যাবে?
মক্কার মুশরিকরা যে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে নবী হিসেবে মানতে পারেনি-এর মূলেও তো একই অহংকার। বরং এই অহংকারের কারণেই পূববর্তী নবীগণকেও অস্বীকার করেছিল তাদের স্ব স্ব গোত্রের বিত্তবান লোকেরা। মক্কার মুশরিকদের কথা পবিত্র কোরআনে এভাবে আলোচিত হয়েছে : তারা বলে, এই কোরআন কেন দুই এলাকার কোনো মহান ব্যক্তির ওপর অবতীর্ণ হলো না! (সূরা যুখরুফ : ৩১)।
অহংকার থেকে মুক্ত থাকতে হলে কী করতে হবে-সে পথও বাতলে দিয়েছে আমাদের পবিত্র কোরআন। সে পথ শোকর ও কৃতজ্ঞতার পথ। বান্দা যখন শোকর আদায় করবে, কৃতজ্ঞতায় সিজদাবনত হবে, সবকিছুকেই আল্লাহর নিয়ামত বলে মনে-প্রাণে স্বীকার করবে তখন তার কাছে অহংকার আসবে কোত্থেকে? শোকর করার অর্থই তো হলো আমার যা প্রাপ্তি, সবই আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ। এখানে আমার কোনোই কৃতিত্ব নেই। এ ভাবনা যার মনে সদা জাগরুক থাকে, অহংকার তার মনে বাসা বাঁধতে পারে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন