শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ভারতে নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ করতে সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০২৩, ৮:০৯ পিএম

ভারতে সুপ্রিম কোর্ট বৃহস্পতিবার দেশটির নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে যে রায় দিয়েছে, তাকে যুগান্তকারী বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। এতদিন শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ঠিক করত কারা নির্বাচন কমিশনার আর কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হবেন। এখন থেকে প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধী দলনেতার কমিটি সেই সিদ্ধান্ত নেবে।

সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছিল, তেমনই অভিযোগ আসছিল যে কমিশনের নানা সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন দল বাড়তি সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের এক সাংবিধানিক বেঞ্চ তাদের রায়ে সেই নিয়োগ প্রথাটাই বদলে দিয়েছে। নির্বাচনী পর্যবেক্ষক আর বিশ্লেষকরা মনে করছেন ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় এই বদল অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস বা এডিআর সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছিল ২০২১ সালে। সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের পদ্ধতিটিকেই চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল ওই রিট পিটিশনে। সংগঠনটি বলেছিল সংবিধানের ১৪ নম্বর ও ৩২৪(২) ধারা দুটির সঙ্গে ওই নিয়োগ পদ্ধতি সাংঘর্ষিক। যেভাবে এতদিন নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ হয়ে এসেছে, তা প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতাকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছিল ওই নিয়োগ পদ্ধতিতে।

এডিআর বলছে সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন কমিশন এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং যেভাবে সরকার থেকে তাদের নিয়োগ করা হয়েছে, তার ফলেই এই নিয়োগ পদ্ধতি বদলানোর দরকার হয়ে পড়েছিল। যদিও সংবিধানের ৩২৪(২) নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে লেখা আছে যে দেশের সংসদকে নির্বাচন কমিশনার এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন করতে হবে। এতবছর কোনও সরকারই সেই আইন তৈরি করে নি, ফলে সরকারই নিয়োগ করে এসেছে নির্বাচন কমিশনারদের।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এডিআর, যারা বেসরকারিভাবে দেশের সব নির্বাচনই পর্যবেক্ষ করে, তার পশ্চিমবঙ্গের কোঅর্ডিনেটর উজ্জ্বয়িনী হালিম বলছিলেন, “নির্বাচন কমিশন আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোতে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির শুধু নিরপেক্ষ থাকাটাই যথেষ্ট নয়, মানুষের কাছে যাতে সেই নিরপেক্ষতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন না ওঠে, তাদের নিরপেক্ষতা মানুষের কাছে প্রতিভাত হওয়াটাও জরুরি।" “কিন্তু কমিশনের সাম্প্রতিক কিছু ক্ষেত্রে আমরা তাদের অতি সক্রিয়তা, আবার কোনও ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়তা দেখেছি, যার ফলে মানুষ এই স্বাধীন প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন,” বলছিলেন উজ্জ্বয়িনী হালিম।

সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মদন বি লোকুরের নেতৃত্বে সিটিজেনস কমিটি অন ইলেকশানস ২০২১ সালের মার্চ মাসে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে তারা দেখিয়েছিল ২০১৯ সালের যে লোকসভা নির্বাচনে জিতে নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই ভোট পরিচালনার সময়ে নির্বাচন কমিশনের কিছু সিদ্ধান্তের ফলে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা করে দিয়েছিল।

তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল, নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করে ভোটের ঘোষণা পিছিয়ে দিয়েছিল যাতে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চের মধ্যে অনেকগুলি সরকারি প্রকল্প উদ্বোধন করে ফেলা যায়। ওই সময়কালে ১৫৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছিল, যার মধ্যে অনেকগুলিই করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। ওই কমিটির আরেকটি পর্যবেক্ষণ ছিল যে, ভোটের সময়ে আদর্শ আচরণবিধি কঠোরভাবে বলবত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীন দলের ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছে। ওই ব্যাপারে যে নির্বাচন কমিশনার ভিন্ন মত পোষণ করেছিলেন, তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

তৃতীয় পর্যবেক্ষণটি ছিল ২০২১-এর ভোটে কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলিকে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে অপব্যবহার করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলি বারেবারেই এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ অন্য অনেক বিরোধী দলই অভিযোগ করে যে সাম্প্রতিক কালে বিজেপিকে ভোটের সময়ে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধীদের তোলা অভিযোগগুলি অনেক সময়েই পাশ কাটিয়ে যায় নির্বাচন কমিশন, কিন্তু বিজেপি যখন অভিযোগ করে, তখন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এই অভিযোগও উঠেছে একাধিক ভোটের সময়ে।

তবে বিজেপি বলছে এরকম প্রশ্ন তো আগেও উঠেছে। দলটির একজন নেতা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল শঙ্কর নন্দ বলছেন, “এটা সঠিক নয় যে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এর আগে অনেকবারই তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নানা দল। তখন তো বিজেপি ক্ষমতায় ছিল না। আর কমিশনের সঙ্গে প্রশাসনের যে দ্বন্দ্ব, তাও কিন্তু নতুন নয়। আবার সেই সময়কার বিরোধী দলগুলোও নির্বাচন কমিশনের নানা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে।"

‘সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় দিয়েছে, সেটা তো মানতেই হবে, কীভাবে কী করা হবে, সেটা সরকার দেখবে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চর্চা করি বলেই আমার মাথায় একটা বৃহত্তর প্রশ্ন আসছে যে সবধরনের নিয়োগের ব্যাপারে আদালতের ঢুকে পড়াটা গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা কাম্য? যারা সরকার চালায়, তারা নির্বাচিত এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, কিন্তু আদালত তো তা নয়। তাই গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগগুলি কীভাবে হবে, তা আদালত ঠিক করে দিতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হওয়া জরুরি বলে আমার মনে হয়,’ বলছিলেন অধ্যাপক নন্দ।

তিনি যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, ‘ওইসব দেশগুলিতে কি আদালত এধরনের ভূমিকা পালন করে? উত্তর হচ্ছে না।’ বিচারব্যবস্থায় নিয়োগ নিয়ে বিজেপি সরকার এবং সুপ্রিম কোর্টের মতবিরোধ চলছেই। সরকার যেভাবে বিচারপতি নিয়োগ করতে চায়, সুপ্রিম কোর্ট সেই ব্যবস্থায় সায় দিচ্ছে না। এ নিয়ে সরকারের মন্ত্রীরা বারে বারে তাদের মতামত প্রকাশ করছেন। অধ্যাপক নন্দ আরও একটা প্রশ্ন তুলেছেন, সংবিধানে যখন বলা হয়েছিল যে নির্দিষ্ট আইন করে নির্বাচন কমিশনার এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করতে হবে, সেই আইন এত বছরেও হয় নি কেন, তার দায় কি বিজেপির?

কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বজিত ভট্টাচার্য বলছেন, ‘আমাদের দেশে যে গণতান্ত্রিক কাঠামো আছে, তার কোথাও যে কোনও বিচ্যুতি ছিল না, তা তো নয়। সেগুলি নিয়ে নানা সময়েই প্রশ্ন উঠেছে। সেই সব বিচ্যুতি থেকেছে বলেই তো এতবছর পরে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হল। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ নিয়ে গণতন্ত্রের একটা স্তম্ভ হিসাবে বিচারব্যবস্থাকে এগিয়ে আসতেই হয়েছে, যাতে নির্বাচন কমিশন সম্বন্ধে ভোটারদের মনে কোনও প্রশ্ন না জাগে।’

অ্যাসোসিয়েশান ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস অবশ্য বলছে এরপরেও হয়তো নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিরোধী দলগুলি প্রশ্ন তুলবে, কিন্তু তখন তাদের প্রশ্ন তোলার নৈতিক অধিকার হয়তো থাকবে না, কারণ এরপর থেকে তো তারাও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকবে। সূত্র: বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন