শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সমাজে ও শিক্ষাঙ্গনে মাদকের ছোবল রুখতে হবে

প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মাদকের সর্বগ্রাসী আগ্রাসনে দিশাহারা হয়ে পড়েছে দেশের যুবসমাজ। বস্তিুর দরিদ্র ছেলে-মেয়ে থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত এলাকার ধনীর দুলাল এখন মাদকে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এমনকি স্কুলের কিশোর-কিশোরী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পর্যন্ত মাদকের ভয়াল থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষত: সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রতিদিন নানা ধরনের বিপুল পরিমাণ মাদক ভারত থেকে দেশে প্রবেশ করছে। মাদক পাচারকারীরা এসব মাদক পরিবহন ও বিপণনের জন্য একদিকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে, অন্যদিকে মাদক বিক্রির টার্গেট ক্রেতা হিসেবেও উঠতি যুবক ও স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেছে নেয়া হচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে সারাদেশের শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের মাদকের নেশায় আক্রান্ত হওয়া ও মাদকের অবাধ বাণিজ্যের একটি ভয়াল চিত্র পাওয়া যায়। সীমান্তবর্তী জেলা চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্টে জানা যায়, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের তরফ থেকে ব্যাপক মাদকবিরোধী জনসচেতনতামূলক তৎপরতা থাকা সত্তে¡ও সেখানে মাদকের পাচার এবং বেচাকেনা বাড়ছে। এহেন বাস্তবতায় উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ ও স্থানীয় প্রশাসনের মাদকবিরোধী সভা-সেমিনার, বিজিবি ও পুলিশের অভিযানসহ মসজিদভিত্তিক জনসচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণের পরও প্রতিদিন বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। মাদকের নীল ছোবলে একেকটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে যুবসমাজের শক্তি ও সম্ভাবনা।
দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে, ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ নানা ধরনের মাদক উদ্ধার করছে। গতকাল প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, রোববার রাত থেকে সোমবার পর্যন্ত একই সময়ে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ২৮ লাখ এবং কক্সবাজার থেকে ৬১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঢাকায় র‌্যাবের পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একে এ যাবতকালে একসাথে আটককৃত ইয়াবার বৃহত্তম চালান বলে অভিহিত করা হয়েছে। গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে একসাথে ১৫ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট আটকের রেকর্ড ভেঙ্গে এবার ২৮ লাখ ৬১ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট আটক করা হল। অর্থাৎ যতই দিন যাচ্ছে ইয়াবার পাচার ও চোরাচালান বাড়ছে। এসব চোরাচালানের খুব ক্ষুদ্র অংশই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ছে। অবশিষ্ট বিশাল অংশ প্রতিদিন দেশের যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন লাখ লাখ কিশোর, তরুণ-তরুণী ইয়াবার সর্বনাশা নেশায় বুঁদ হয়ে নিজের জীবন বিপণœ করছে, পরিবার ও সমাজের জন্য ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ইয়াবা, ফেন্সিডিলের নেশার টাকা যোগাড় করতে গিয়ে নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-তরুণরা। এভাবেই মাদকের ছোবলে সমাজে অপরাধের মাত্রাও বেড়ে চলেছে, যা’ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
যুবসমাজের বিশাল অংশ যখন মাদকের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে, তখন সরকারীদলের একশ্রেণীর নেতা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তাও মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজরা কালোটাকার উৎস হিসেবে যেমন মাদকের ব্যবসায়কে বেছে নিচ্ছে, একইভাবে বেআইনীভাবে অর্জিত অর্থের একটি অংশ মাদকের পেছনে ব্যয়িত হচ্ছে। গত সোমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি এম মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার পরিত্যক্ত কক্ষ তল্লাশি করে বিপুল পরিমাণ মদের বোতল, ফেন্সিডিলের বোতলসহ অজ্ঞাত রাসায়নিকের বোতল উদ্ধার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একভাবে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ছাত্রনেতাদের অনেকে চাঁদাবাজির পাশাপাশি মাদকের ব্যবসায় এবং মাদক ব্যবহারে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ মদ ও ফেন্সিডিলের বোতল উদ্ধারের ঘটনা থেকে তারই সত্যতা পাওয়া গেল। বৃহত্তম ইয়াবার চালান আটকের সাথে সাথে ইয়াবা পাচারে জড়িত ১৪টি চক্রকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে। মাদক ও ইয়াবা চোরাচালানের সাথে জড়িত চক্রের অনেক সদস্যকে ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে আটকও করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুনাফাবাজি ও নিয়ন্ত্রণের কারণেই বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবা ব্যবসায়। এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। নেপথ্যের গডফাদাররা সব সময়ই অধরা রয়ে যাচ্ছে। সীমান্তের মাদক চোরাচালান রুটগুলোতে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশের কড়া নজরদারির পাশাপাশি ইয়াবা চোরাচালানের মূল হোঁতাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা না করতে পারলে দেশ ও সমাজকে মাদকের ভয়ানক ছোঁবল থেকে রক্ষা করা অসম্ভব। মাদকের ব্যবসায় ও বিস্তার রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করতে হবে। তবে শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ব্যাপক জনসচেতনতা ও মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের যুবসমাজকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় পুরো সমাজব্যবস্থাই বিশৃঙ্খল ও অনিরাপদ হয়ে পড়তে পারে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন