শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

নতুন বছর এবং সম্ভাবনার বাংলাদেশ

| প্রকাশের সময় : ৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : শুরু হয়েছে ২০১৭ সাল, নতুন বছরে সবার জীবন ভরে উঠুক নতুন আলোয়, নতুন আশায়। নতুন বছর শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমরা রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছি। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ শুরু করেছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর তিনি সংলাপ করেছেন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে। তাতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন ও রাজনৈতিক জট খোলার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তৈরি হয়েছে একটি নতুন দৃষ্টান্ত। নির্বাচনটি হয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু। এতে একটি নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। সব মিলিয়ে নতুন বছরটি বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলেই মনে হচ্ছে। বস্তুত বাংলাদেশকে নিয়ে অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন এবং সম্ভাবনার কথা বলছেন। তবে স্বপ্ন সেটি নয় যেটি মানুষ ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন সেটিই যা পূরণের প্রত্যাশায় মানুষ ঘুমানোর সুযোগ পায় না। বাংলাদেশের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে গণতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষিনীতি, শিল্পনীতিসহ সবক্ষেত্রেই নিতে হবে বাস্তবধর্মী উদ্যোগ। পরিবর্তন আনতে হবে মন-মানসিকতায় ও আচার-আচরণে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভাজন থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃকি গড়ে তুলতে হবে। কেননা মাথা যেমন সমস্ত শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশকে এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে। রাজনীতিতে সংকট জিইয়ে রেখে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সুদূর পরাহত। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত। এটি সবাইকে আশাহত করে, বিনষ্ট করে উদ্যম ও উদ্দীপনাকে। কাজেই রাজনৈতিক বিভাজন ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে হবে, জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের সামনে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে চ্যালেঞ্জও। আগামী দিনগুলোয় চীন, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পিলিপাইনসহ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের দিকে বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এ দু’টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে এ দুটি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। তারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে কীভাবে এ দুটি দেশে তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা যায়। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে-উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশকে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও। বাংলাদেশকে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সহযোগিতার প্রয়োজন। তাছাড়া মিয়ানমার দিয়েও বাংলাদেশ চীনে প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের ‘স্ট্যাট্রেজিক’ সুবিধাগুলো এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের নিয়ামক। রাজনৈতিক ও  কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট বোঝা যায় সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখ-ের বৈচিত্র্য দিয়ে। বাংলাদেশের তিন দিকজুড়ে রয়েছে ভারত। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। এর পাশে রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া রয়েছে ভুটান, নেপাল ও সিকিম। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এই প্রতিটি দেশ খুবই সন্নিকটবর্তী। বাংলাদেশ থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ১৮ মাইল, ভুটানের ৪৫ মাইল, এবং চীনের বর্ডার ৪০ মাইল। তাছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা শুরু সমুদ্রের জলরাশি দিয়ে। আর এ মহাসমুদ্রই বাংলাদেশকে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খ্যাতি। তাই বাংলাদেশকে বলা হয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগস্থল। এ জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে আরো জোরালো ও শক্তিশালী করেছে। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই রাজনীতিবিদদের পথ চলতে হবে এবং তৈরি করতে হবে কর্ম-কৌশল।
আগামী দিনগুলোয় যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপরের তালিকায় উঠে আসবে, এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের জন্য চমৎকার রাজনৈতিক সুযোগ। এজন্য বাংলাদেশকে দেখতে  হবে  ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্ন দৃষ্টিতে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, সিকিম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবেশদ্বার বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল। তাছাড়া ‘সেভেন সিস্টার’ বলে খ্যাত ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশ দ্বারও বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল। ফলে প্রায় শত কোটি মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপথ নয়; জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশী। পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরো সুসংহত হয়েছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরো বড় বড় দেশ বাংলাদেশের ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ! তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান! জনশক্তি রফতানি ও ওষধ শিল্পে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে! কাজেই বাংলাদেশের শত্রু এখন চতুর্মুখী। ওপরে উঠতে হলে বাংলাদেশকে এসব চিন্তা মাথায় রাখতে হবে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে; সুনিশ্চিত করতে হবে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। তাহলেই কেবল একটি দেশের অর্থনীতির আকার বড় হতে পারে, দেশটি হতে পারে উন্নত, আধুনিক একটি দেশ।
বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কর্মক্ষম। গত ২০ বছরে প্রায় ৫ কোটি উদ্যমী, তরুণ ও যুবক যোগ হয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তিতে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, জনশক্তি ও বেসরকারি খাত একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে, যা একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের খ্যাতি অর্জন করেছে। পাশাপাশি এ শিল্পটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পের গৌরবের অধিকারী। তাছাড়া চা, চামড়া, ওষুধ ও হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতেও বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এসব কোনো কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব সত্য; তাহলে এ দেশের উন্নয়নকে আটকে রাখার সাধ্য কার? যদি নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত না হইÑনিজেদের মধ্যে যদি শৃঙ্খলা না থাকে, কোনো সিস্টেম না থাকে; না থাকে দায়িত্বশীলতা। কাজেই বাস্তববাদী হতে হবে, দূরের জিনিস দেখতে হবে; জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে, নদীগুলোকে খনন করে মাছ চাষ ও সম্পদের উৎসে পরিণত করতে হবে, কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক জোর দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী গণপরিবহন ব্যবস্থা, রেলকে করতে হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক, রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত শহর হিসাবে। সর্বোপরি সংঘাতপূর্ণ, অশান্ত ও হানাহানির রাজনীতি থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। রাজনীতিবিদদের মন বড় করতে হবে এবং দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। অনৈক্য ও বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে এক প্লাটফর্মে থেকে দলমতের উর্ধেŸ উঠে, এক সুরে কথা বলতে হবে। অহমিকা ত্যাগ করে পরমতসহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে হবে। সম্ভব হলে ২০১৭ সালের মধ্যেই সবদলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথ সুগম করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে, স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
babul ৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৭ এএম says : 0
good write up
Total Reply(0)
liton ৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৭ এএম says : 0
excellent write up
Total Reply(0)
mojibur rahman ৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:১৯ এএম says : 0
সমযোপযোগী লেখা
Total Reply(0)
belayet ৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:২০ এএম says : 0
excellent write up
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন