শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চট্টগ্রামে নিষ্ক্রিয় নেতাদের নিয়ে দু’দলেই ক্ষোভ অসন্তোষ

| প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : চট্টগ্রামে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাদের অংশগ্রহণ কমছে। মাঠের রাজনীতিতে এখন আর আগের মতো সক্রিয় নেই অনেক নেতা। শাসক দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মাঠের বিরোধী দল বিএনপির নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধে রাজনীতির ময়দান থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এখন কর্মীদের মুখে মুখে। এসব নিষ্ক্রিয় নেতাদের নিয়ে উভয় দলের তৃণমূলে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বিগত প্রায় এক দশক ধরে দেশে যে বিরাজনীতিকরণ চলছে এটি তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে খালি মাঠে খেলতে গিয়ে সরকারি দল খেলাই ভুলে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য অনেকের।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকার দলীয় নেতাদের অনেকে এখন ক্ষমতা উপভোগে ব্যস্ত। মাঠের রাজনীতিতে সময় দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই। আবার যারা দলের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পাননি তারাও অভিমানে দূরে সরে আছেন। দল দীর্ঘ প্রায় আট বছর ক্ষমতায়-এরপরও যাদের যথাযথ মূল্যায়ণ হয়নি তারা রাজনীতিতে থাকলেও মাঠে ময়দানে সরব হচ্ছে না।
 গেল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে দেখা গেছে অনেক আসনে দলের নেতাদের বাদ দিয়ে ব্যবসায়ী কিংবা অন্য দল থেকে আসা নেতাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আর এই কারণেও অনেকে রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখছেন। আবার হঠাৎ নৌকায় উঠে যারা এমপি হয়েছেন তারাও দলীয় রাজনীতিতে তেমন একটা সরব হচ্ছে না। কারণ তারা কেউ আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতিতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছেন না।
বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধে মাঠের রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। আর এই কারণে অনেক নেতা দলকে এড়িয়ে চলছেন। ব্যস্ত রয়েছেন নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। অনেকে আবার মামলার অজুহাতে মাঠের রাজনীতি থেকে দূরে রয়েছেন। আবার দলে ভাল পদ-পদবী পাননি এমন অভিমানেও অনেকে মাঠে নামছেন না।
প্রধান দুই দলের নেতাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গরহাজিরের বিষয়টি আলোচনায় ছিল দীর্ঘদিন থেকে। তবে ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে নেতাদের অনুপস্থিতি উভয় শিবিরে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি এখন রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
৫ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসাবে পালন করে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে ওই জাতীয় নির্বাচন বর্জনকারী মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দিনটিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসাবে পালন করে। আওয়ামী লীগ পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে সমাবেশ করে। আর বিএনপিকে অনেক শর্ত দিয়ে দলীয় কার্যালয় নাসিমন ভবনের সামনে সমাবেশের অনুমতি দেয় প্রশাসন।
আওয়ামী লীগের সমাবেশে অনেক নেতাদের দেখা যায়নি। এমনকি চট্টগ্রামের এমপিরাও সে সমাবেশে যোগ দেননি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৃতীয় বর্ষ পূর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের বিশেষ করে দায়িত্বশীল নেতাদের কাঙ্খিত উপস্থিতি না পেয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝাড়েন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। মহানগর আওয়ামী লীগের ওই দুই শীর্ষ নেতা নিষ্ক্রিয় নেতাদের দায়িত্ব পালন না করলে পদ ছেড়ে দেয়ারও আহ্বান জানান।
সরকারী দলের ওই সমাবেশে নগর কমিটির কয়েকজন সহ-সভাপতি ও সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য এবং নির্বাহী কমিটির বেশ কিছু সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। নগরীর কোনো সংসদ সদস্যও উপস্থিত ছিলেন না। সভাপতির বক্তব্যে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমার চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। তবুও আমি সব সভা-সমাবেশে আসি। কষ্ট হোক, আমি বেঁচে তো আছি। যতদিন বেঁচে থাকব, দলের জন্য কাজ করে যাব। এখন দল ক্ষমতায়। সেজন্য অনেকে কর্মসূচিতে আসছেন না। তারা নিজের লাভের জন্য দল করছেন। তিনি বলেন, দলের ভেতরে অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে। অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। তারা দলের ভেতরে বিভেদ সৃষ্টি করে দলকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।  নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি আসলাম, মিটিং এর সামনে বসে বসে পা নাড়ালাম, তা হবে না। বহু সহ্য করছি। একদিন দুই দিন তিন দিন, আর না।
নেতাদের অনুপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, স্বাধীনতার সুফল দেশবাসীকে পৌঁছে দিতে আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও গতিশীল করতে হবে- এটা সবাই মুখে বলে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। আমরা কে কোন পদ অলঙ্কৃত করছি সেটি বড় কথা নয়। সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা নিয়ে সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যারা পদ নিয়ে বসে আছেন, দায়িত্ব পালন করেন না, সভা সমাবেশে আসেন না। পদ নিয়েও নিষ্ক্রিয় থাকা নেতারা নিজ উদ্যোগে দায়িত্ব না ছাড়লে দলীয় সিদ্ধান্তে তাদের বাদ দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ার করেন তিনি। আ জ ম নাছির আরো বলেন, আমাদেরও তো কাজ আছে, দায়িত্ব আছে। আমরা তো প্রত্যেকটি সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ করছি। আপনাদের লজ্জা থাকা উচিত। পদ অলঙ্কৃত করবেন, সংগঠনের কাজে আসবেন না, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এটা তো হতে পারে না। সংগঠনের সাথে প্রতারণা করতে পারেন না। এমপিদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ৫ জানুয়ারি অনেক মানুষ মারা গেছে। রক্ত দিয়ে অনেকে এমপি উপহার দিয়েছে। আমাদের অনেক এমপি আছে। কিন্তু এই সমাবেশে তাদের কেউ নেই।
আওয়ামী লীগের ওই সমাবেশের পর অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির সমাবেশ। সেখানেও নেতাদের অনুপস্থিতি কর্মীদের চোখে পড়ে। দীর্ঘদিন রাজপথে বিএনপির কোন কর্মসূচি নেই। দলীয় কিছু কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে সীমিত আকারে। বৃহস্পতিবারের সমাবেশে পুলিশের অনুমোতিও মিলেছে। তবে সমাবেশে কর্মী সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেলেও ব্যতিক্রম ছিলেন নেতারা। চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধশত নেতা গত জাতীয় কাউন্সিলে দলের কেন্দ্রে স্থান পেয়েছেন। তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন নেতাকে দেখা গেছে ওই সমাবেশে। এমনকি মহানগরীর অনেক নেতাকেও সমাবেশে দেখা যায়নি। সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম ও নগর বিএনপির সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনসহ মহানগর ও উত্তর জেলার কয়েকজন নেতা সমাবেশে ছিলেন। দলীয় কর্মসূচিতে নেতাদের অনুপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মাঠের কর্মীরা। সমাবেশে মহানগর বিএনপিসাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, সহসভাপতি আবু সুফিয়ানও ছিলেন না।
বিএনপির নেতারা বলছেন, দল ক্ষমতায় নেই এই কারণে অনেক নেতাকে মাঠে দেখা যায় না। আবার অনেকে দলের বড় বড় পদ নিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন। বিএনপির ভাইস চেয়াম্যান এম মোরশেদ খান ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। জাতীয় কাউন্সিলে চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা থেকে পদোন্নতি পেয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য হন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এখন পুরোপুরি ঢাকায় থাকলেও মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতে চট্টগ্রাম আসছেন তিনি। স্থায়ী কমিটিতে স্থান না পেয়ে কিছুটা অভিমান করেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান। তিনিও চট্টগ্রামের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন। দলের ভাইস চেয়াম্যান হিসাবে পদোন্নতি পাওয়া মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বেশির ভাগ সময়ে ঢাকায় থাকছেন। কর্মীদের অভিযোগ অনেক নেতা এখন রাজপথে পাওয়া যায় না।
বিগত ২০০৭ সাল থেকেই মাঠের রাজনীতিতে মন্দাভাব শুরু হয়। হোঁছট খায় গণতান্ত্রিক রাজনীতি। ওয়ান ইলেভেনের পর টানা দুই বছর রাজনৈতিক কর্মকান্ড ছিল সীমিত। বিগত ২০০৮সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসলে শুরু হয় বিরোধী দল দমন। ওয়ান ইলেভেনের রাজনৈতিক সিডরে বিধস্ত বিএনপিকে মাঠেই দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। মামলা হামলা আর হুলিয়া নিয়ে অনেক নেতা জেলে, অনেকে পালিয়ে বেড়ান দেশে-বিদেশে। বিগত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করতে গিয়ে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। এর পরের বছরে টানা তিন মাসের আন্দোলনে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শুধু মামলা আর হুলিয়ার সংখ্যাই বাড়ে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিরোধী দলকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ফলে সরকারি দলও ধীরে ধীরে রাজনীতির মাঠ থেকে সরে গেছে। কারণ প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে তাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে না। অন্যদিকে ৫ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচনের পর সিটি কর্পোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে বিরোধী দলকে টিকতেই দেওয়া হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদে একচেটিয়া সরকারি দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। আবার এসব স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি দলের মূলধারার নেতাদের চেয়ে দলে নবাগত কিংবা ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এতে করে সরকারি দল স্থানীয় সরকারে তাদের আধিপত্য নিশ্চিত করলেও দলীয় রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার থেকেও ছিটকে পড়েছে বিএনপি। ভোটের নামে প্রহসনের কারণে সাধারণ মানুষও ভোট এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারাতে বসেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে-এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক দলের প্রবীণ নেতারা। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলার প্রবণতা গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকারক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন