শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হৃদরোগ হাসপাতালই রোগাক্রান্ত

| প্রকাশের সময় : ৮ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অর্ধশত দোকান : প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিরাপত্তা হুমকীতে : নিয়ম-নীতি না মেনে দোকান বরাদ্দ : ৭ জনের পদ  পরিবর্তন করেছেন সদ্য বিদায়ী পরিচালক
হাসান সোহেল : জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল। চিকিৎসার যন্ত্র না দিয়ে বাক্স দিয়ে টাকা উত্তোলনের নজির আছে এই হাসপাতালে। টাকা ছাড়া এমনিতেই বিশেষায়িত এই হাসপাতালে চিকিৎসা মেলে না। অনেক সময় টাকা দিয়েও সম্ভব হয় না। তারপরও চিকিৎসা নেয়ার জন্য প্রতিদিনই সারাদেশ থেকে শত শত রোগী চিকিৎসার জন্য আসছেন। কিন্তু গত কিছুদিন থেকে হাসপাতালকে যেন চেনাই যায় না। দূর থেকে মানুষের কোলাহল দেখলে মনে হবে এখানে কোন মেলা বসেছে। আসলেও তাই। হাসপাতালের ভিতরে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান। একই সঙ্গে রয়েছে ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ২২ তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। মেলাকে কেন্দ্র করেও হাসপাতাল ও হাসপাতালের আশেপাশে গড়ে উঠেছে শত শত ভ্রাম্যমাণ দোকান। তাই চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হাসপাতালে প্রবেশ করলে বোঝার সাধ্য নেই কে রোগী, কে ক্রেতা বা কে ব্যবসায়ী।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত দোকান। পাশাপাশি বাণিজ্যমেলা কেন্দ্রিক ভ্রাম্যমান দোকানের পসড়া। একই সঙ্গে বেড়েছে বহিরাগতদের আনাগোনা। এতে হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আর তাই হাসপাতালের মধ্যে একধরনের নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে। এছাড়া রোগীদের টাকা, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি হচ্ছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের পাশেই হাসপাতালের অবস্থান হওয়ায় নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন হাসপাতালের কর্মচারীরা। এছাড়া অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব দোকানের পানি-বিদ্যুতও হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সূত্র মতে, সম্প্রতি হৃদরোগ হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মাঝের রাস্তা প্রশস্তকরণসহ আধুনিকায়নের কাজ শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এজন্য হৃদরাগ হাসপাতালের দেয়াল ভেঙ্গে ১০ থেকে ১৫ ফুট জায়গা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু দেয়াল ভাঙ্গার পরে আর নতুন কোন দেয়াল দেয়া হয়নি। এ সুযোগে হাসপাতালের একটি চক্র অবৈধভাবে দোকান গড়ে তুলে।   
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী এবং দোকানীরা জানান, হাসপাতালের ওয়ার্ডমাস্টার বাহার উদ্দিন ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে এসব দোকান বসার সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়া পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থাও সে করে দিয়েছে। এসব দোকান থেকে তিনি প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়াও তুলছেন।   
যদিও বাহারের বাহাদুরী এখানেই শেষ নয়, পরিচালকের মৌখিক সম্মতি নিয়ে তিনি হাসপাতালের নিজস্ব জায়গায় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ঘর-বাড়ি বানিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই সুযোগে সেখানে গড়ে উঠেছে ১০-১২টি বাসা। এরমধ্যে ওয়ার্ড বয় শহিদুল ইসলাম, রাশেদুল, হাবিব আহসান, রুহুল কুদ্দুস, রেজাউল করিম, লাভলু, স্ট্রেচারার মহিন উদ্দিন, লিফট ম্যান তালেব, ড্রাইভার হাবিবুর রহমান চৌধুরী ও জামাল ইতিমধ্যে সেখানে আধাপাকা বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করেছে।
সূত্র জানায়, এখানেও জায়গা বরাদ্দে কোন নিয়ম নীতি মানা হয়নি। যাদের আবাসন জরুরী তারা কেউই জায়গা পায়নি। এরমধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পারুল, শারীরিক ভাবে আহত বাবুর্চী সেকেন্দার আলী অন্যতম। তারা দীর্ঘদিন থাকার জন্য জায়গা বরাদ্দ চেয়েও পাননি। আর যাদের থাকতে দেয়া হয়েছে সন্ধ্যা নামলেই তারাও শুরু করেছে জুয়ার আসর।
সদ্য বিদায়ী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক প্রফেসর ডা. এস টি এম আবু আজম গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ শেষ কর্মদিবস পালন করেন। তিনি এই দিনে সরকারি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে হাসপাতালে দোকান বরাদ্দ এবং ৭ জনের পদ পরিবর্তন করে দিয়েছেন। যা তার এখতিয়ার বহির্ভূত। এছাড়া মেয়াদের শেষ দিকে তিনি অধিদফতরের মহাপরিচালকের নির্দেশ উপেক্ষা করে দু’জন কর্মচারীকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করে গেছেন। এসব কাজের নেপথ্যেও রয়েছেন সেই বাহার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিচালক স্বাক্ষরিত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬’র এক বরাদ্দপত্রে দেখা যায়, কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের নামে তিনি হাসপাতালের দক্ষিণ ব্লকের বেইজমেন্টে অবস্থিত গিফট সপ ও ফুলের দোকানের জন্য ৩শ’ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ প্রদান করেন। যার ভাড়া ৩ হাজার ৯শ’ টাকা। এমনকি একই দিনে এই বরাদ্দের প্রেক্ষিতে তিনি একটি চুক্তিনামাও সম্পাদন করেন। অবশ্য চুক্তিনামায় কোন ব্যক্তির নাম উল্লেখ নেই। সেখানে একপক্ষ পরিচালক জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং অপরপক্ষ কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।  
হাসপাতাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট নামে অনুমোদিত এবং নিবন্ধিত কোন সংগঠন নেই। এমনকি এদের কোন দৃশ্যমান কর্মকান্ডও নেই। হাসপাতালের ওয়ার্ডমাস্টার বাহার এই নাম ব্যবহার করে হাসপাতাল এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে।  
একই তারিখে স্বাক্ষরিত অপর এক আদেশে প্রফেসর ডা. আবু আজম ৭ জন কর্মচারীর পদ পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। এরমধ্যে ওয়ার্ড বয় হিসেবে কর্মরত শাহিদুল ইসলাম ও রাশেদুল ইসলামকে অফিস সহায়ক হিসেবে পদ পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ওয়ার্ডবয় ছাইফ উদ্দিনকে ওয়ার্ড মাস্টার হিসেবে পদ পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া সহকারি বাবুর্চী রাশিদা পারভীনকে অফিস সহায়ক হিসেবে, টেবিল বয় হানিফ মোল্লাকে ওয়ার্ড বয়, প্রজেক্টর অপারেটর মো. শাহজালালকে স্টোনেগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটার হিসেবে পদ পরিবর্তন করেছেন পরিচালক। পৃথক পৃথক চিঠিতে তিনি এসব আদেশ দেন। এছাড়া একই দিনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক নির্দেশিত নিজ বেতনে অফিস সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত অপরোজ আলী মোল্লা এবং মোহাম্মদ আজিজুল বারীকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করেন। হাসপাতাল প্রশাসন সূত্র জানায় এরা সবাই বাহারের অনুগত।
এসব বিষয়ে জানতে ওয়ার্ডমাস্টার বাহার উদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে  যোগাযোগ করলে প্রথমে সালাম বিনিময় করলেও প্রতিবেদকের পরিচয় জানার সাথেই মুঠোফোনটি বন্ধ করে দেন। এরপর একাধিকবার তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
দোকান বরাদ্দ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. এ কে এম সাইদুর রহমান বলেন, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতালের ক্ষেত্রে পরিচালক একটি ওষুধের দোকান বসানোর অনুমতি দিতে পারেন। তবে তা শর্ত সাপেক্ষ। কিন্তু এছাড়া অন্যকোন ধরনের দোকান বসানোর অনুমোদন প্রদানের ক্ষমতা হাসপাতাল পরিচালকের নেই।  
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১৯৮৫’র নিয়োগবিধি অনুসারে প্রজেক্টর অপারেটর বা ড্যাটাএন্ট্রি অপারেটর থেকে স্টোনোগ্রাফার হিসেবে পদপরির্বতনের কোন সুযোগ নেই। উক্ত বিধিমালায় অফিস সহায়ক বা এমএলএসএস পদে সরাসরি নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ অন্যপদ থেকে এই পদে পরিবর্তন হয়ে আসার কোন সুযোগ নেই।
যদিও প্রফেসর ডা. এস টি এম আবু আজম ইনকিলাবকে বলেন, সব নিয়ম মেনেই কর্মচারীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে মুঠোফোনটি রেখে দেন। পরে আবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে প্রফেসর আবু আজম মুঠোফোনটি কেটে দেন।
এদিকে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেরেবাংলা নগরের প্রধানমন্ত্রী বাসভবন থাকায় তার নিরাপত্তার স্বার্থে উক্ত এলাকার সকল হাসপাতালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ সময় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব প্রশাসন বাসুদেব গাঙ্গুলী উক্ত এলাকায় যেন আর কোন স্থাপনা গড়ে উঠতে না পারে সেজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারপরেও হৃদরোগ হাসপাতালের দক্ষিণ দিকে দেয়াল ভেঙ্গে হাসপাতালের জায়গায় প্রায় অর্ধশত দোকান গড়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিরাপত্তায় হুমকী স্বরূপ এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) বাসুদেব গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয়। এ সময় মন্ত্রণালয় থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আবাসনের সকল অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে নির্দেশ দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ এতোদিনেও কেন বাস্তবায়িত হয়নি জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব বাসুদেব গাঙ্গুলী বলেন, উচ্ছেদ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে অভিযানের সময় হাসপাতাল পরিচালককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন