মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সুইপার থেকে শত কোটি টাকার মালিক

ঢামেক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল খালেক

প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : সুইপার থেকে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল খালেক। এজন্য তিনি কর্মচারীদের চাকরি, আবাসন, ফুটপাত বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছেন। কয়েক মাস আগেও খালেকের বিরুদ্ধে কর্মচারীদের বকেয়া বেতনের টাকা থেকে প্রায় ২৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে।
হাসপাতালে অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, আব্দুল খালেক এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রলোভনে বিয়ে করেছেন ৫টি। এই স্ত্রীরা কখনো হাসপাতালে ডিউটি করেন না। তারা মাঝে মাঝে হাসপাতালে এসে ডিউটি রোস্টারে সই করে চলে যান। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালে ঢামেকে আলোচিত বাচ্চা চুরি হওয়া ওয়ার্ডে ডিউটি রোস্টারে নাম ছিল তার ছোট স্ত্রীর। ওই দিন ডিউটিতেই আসেননি তিনি। অথচ ওই ঘটনার জন্য অন্যান্য কর্মচারীদের শাস্তি পেতে হয়। একাধিক কর্মচারী জানান, খালেকের ক্ষমতা বলে এসব স্ত্রীরা হাসপাতালে কোনো কিছুই পরোয়া করেন না। তাদের মতে, শুধু ক্ষমতার লোভেই খালেককে বিয়ে করেছেন সর্বশেষ দুই স্ত্রী। এর মাধ্যমে তারাও ডিউটি ছাড়াই বেতন তুলতে পারছেন। পাশাপাশি খবরদারি চালাচ্ছেন।
সূত্রমতে, হাসপাতালের সাবেক পরিচালকের ছত্রছায়ায় গত প্রায় ৬ বছর বেপরোয়াভাবে হাসপাতালে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন খালেক। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান পরিচালকের সময়েও আধিপত্য বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। একই সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দীর্ঘদিন সভাপতি পদ আঁকড়ে আছেন।
জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারদিকে প্রায় শ’খানেক ফুটপাতের দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা নিচ্ছেন খালেক। হাসপাতালের দালালদের নিজেই পরিচালনা করে থাকেন। এ জন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে মাসিক ৩-৪ হাজার টাকা মাসোহারা পান। এছাড়া খালেককে মাসোহারা দিয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন অনেক কর্মচারী। কর্মচারী সমিতির নিজ অফিস কক্ষকে এয়ার কন্ডিশনারসমৃদ্ধ রুম তৈরি করেছেন। ৬টি দোকানসহ সমিতির অফিস তৈরি করা হয়েছে। এখানে বসেই বিভিন্ন ধরনের টাকা ভাগাভাগি করেন। সহ-সভাপতি আবু সাঈদ ও সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম সাধারণ সম্পাদক এক্ষেত্রে খালেককে সাহায্য করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিকিউরিটি গার্ড মো. আলমকে ওয়ার্ডমাস্টার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। সম্প্রতি নতুন করে ৫৫ জন কর্মচারী নিয়োগের রায় এনেছেন। যাদের থেকে প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। জানা যায়, আগের বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে খালেক ৪ লাখ করে টাকা নিয়েছেন। এখন আবার বেতন থেকে টাকা কর্তন করেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, আবদুল খালেকের মা কমলা বিবি হাসপাতালেই একসময়ে সুইপারের চাকরি করতেন। খালেক অনেকটা বখাটে ছিল। পরে কমলা বিবি তৎকালীন পরিচালকের মাধ্যমে মাস্টার রোলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুইপার হিসেবে খালেককে কাজ দেন। বর্তমানে খালেক কয়েকশ’ কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে করেছেন অঢেল সম্পত্তি। খালেক এ পর্যন্ত ৫টি বিয়ে করেছেন। তাদের নামেও রয়েছে অঢেল সম্পত্তি বলে অভিযোগ উঠেছে।
সূত্রমতে, খালেকের উত্থানের পেছনে ছিলেন হাসপাতালের সাবেক পরিচালক। তিনি দীর্ঘদিন হাসপাতালের পরিচালক থাকায় হাসপাতালের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন খালেক। জানা যায়, সাবেক পরিচালক হাসপাতাল থেকে দায়িত্ব ছেড়ে যাওয়ার দিনও পুরনো মালের নামে হাসপাতালের কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি অকশন করে ২-৩ লাখ টাকায় নিয়ে নেয়। এতে বিভিন্ন নতুন মেশিনারি ও পুরনো খাট দেখিয়ে নতুন খাট নিয়ে নেয়। হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, পুরনো ওটি খাটের নামে নতুন ওটি খাট নিয়ে নিয়েছেন খালেক। অথচ এর দাম কোটি টাকার ওপরে। এর আগেও একই ধরনের কাজ বাগিয়ে নেন খালেক। এমনকি এই অকশনের বিষয়ে কোন পত্রিকায় দরপত্রও আহবান করা হয়নি। সম্পত্তির হিসাব নিতে গিয়ে জানা যায়, কামরাঙ্গীরচরে খালেকের ৬তলা ফাউন্ডেশনের বাড়ির ৪র্থ তলার কাজ চলছে। এখানে কয়েক হাজার কোটি টাকার জমি আছে আবদুল খালেকের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রথম পাঁচ বছরের শাসনামলের শুরুর দিকে ২০০৯ সালে ২৭৪ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রথমে স্থগিত ও পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত সাপেক্ষে বাতিল করা হয়। ওই সময়ে প্রত্যেক কর্মচারীর কাছ থেকে চাকরি দিয়ে দিবে বলে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা আদায় করেন খালেক। পরে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিয়োগপ্রাপ্ত একাধিক কর্মচারী উচ্চ আদালতে একাধিক রিট মামলা দায়ের করেন। কয়েক বছর মামলা শেষে ২০১৩ সালে আদালতের নির্দেশে ২৭৪ জনের সকলেই নিয়োগ পান। ওই নিয়োগের সময়েও প্রত্যেকের কাছ থেকে ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা করে আদায় করেছেন কথিত কর্মচারীবান্ধব খালেক।
হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কয়েক মাস পূর্বে কর্মচারীদের চাকরিতে যোগদানের পর বকেয়া তিন মাসের বেতন আনতে হাসপাতালের প্রশাসনিক ব্লকের অফিস কক্ষে যান। ক্যাশিয়ার বেতন বাবদ তাদেরকে ২৩ হাজার ১৫৯ টাকার ভাউচারে স্বাক্ষর করিয়ে ১৩ হাজার ১৫৯ টাকা দেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মচারী জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মহাহিসাবরক্ষকের কার্যালয় থেকে বকেয়া বেতন তুলে আনার পারিশ্রমিক বাবদ আবদুল খালেক জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা কেটে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি অনেক কর্মচারীকে ডেকে বলেছেন, সরকারি টাকা কীভাবে আনতে হয় আমি জানি। কিন্তু টাকা আনতে জায়গায় জায়গায় ঘুষ দিতে হয়। তাছাড়া আমি যে পরিশ্রম করবো তার পারিশ্রমিক দিতে হবে। আমি নেতা তাই তোমাদের জন্য খাটুনি করছি। এছাড়া ২০১৩ সাল থেকে মামলা চলায় এবং পরবর্তীতে ৩৫৪ জন কর্মচারী মামলায় জিতলে তাদের ২ বছরের বকেয়া বেতন জমা হয় প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। কর্মচারীদের এই টাকা থেকে প্রায় অর্ধেক টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে খালেকের বিরুদ্ধে।
এদিকে খালেকের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা। প্রতিদিন বিক্রি হলেও টাকা দিতে হয়, না হলেও দিতে হয়। একদিকে পুলিশ অন্যদিকে ঢামেক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য। প্রতিদিন কয়েক দফা চাঁদা দিতে দিতে হয়রাণ এই ব্যবসায়ীরা। চাঁদার টাকা যোগাতে কেউ কেউ আবার জড়িয়ে পড়ছেন মাদক ব্যবসার সঙ্গে। শক্তি হিসেবে পাচ্ছেন পুলিশ ও নেতাদের। অন্যদিকে রাস্তার দু’পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো দোকানগুলোয় গড়ে ওঠায় রোগী আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায় বলে জানিয়েছেন অধিকাংশ রোগীর অভিবাবক। এছাড়া কর্মচারীদের বাসা বরাদ্দের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন খালেক। নিজের ইচ্ছামতো টাকার বিনিময়ে বাসার বরাদ্দ দিচ্ছেন।
বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে ঢামেক চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল খালেক ইনকিলাবকে বলেন, আমি কোনো টাকা নেইনি। এটা অনেকে বলে। আসলে নেতামি করি তো, তাই অনেকে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
ফুটপাত বাণিজ্যের বিষয়ে আব্দুল খালেক বলেন, এটা পুলিশ বসায়। তারা এটা নিয়ে ব্যবসা করে। আমি এর সাথে সম্পৃক্ত নই। একই সঙ্গে কর্মচারীদের আবাসনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা প্রায় ২ বছর আগে বরাদ্দ দেয়া হয়। নতুন করে শুধু মৃত্যুবরণকারী কর্মচারী এবং অবসের যাওয়াদের বরাদ্দ দেয়া হয়, যা পরিচালকের কাজ। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করলে তাকে পাওয়া যায়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন