রফিকুল ইসলাম সেলিম : মাদকেই সর্বনাশ, ধ্বংসের পথে যুবসমাজ। নেশার নীল ছোবলে বিপদগামী হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা, পরিবারে অশান্তি; আর বিশৃঙ্খলা বাড়ছে সমাজে। কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না মাদকের এ আগ্রাসন। থামছে না নেশার জোয়ার।
সীমান্তে কড়া পাহারা, সড়ক, রেল, সাগর আর পাহাড়ী পথে অভিযান চলছে নিয়মিত। তবুও থামছে না মাদকের জোয়ার। মিয়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা। সাগর, পাহাড় আর সড়ক পথে ধরা পড়ছে অনেক চালান। ভারত থেকে সীমান্ত পথে আসছে ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইনসহ হরেক রকমের মাদক।
ফেনী, কুমিল্লা হয়ে ট্রেনে, বাসে এসব চালান আসছে চট্টগ্রামে। পাহাড় থেকে আসছে বাংলা মদ। পাচারকালে প্রায়ই ধরা পড়ে মাদকের চালান। তবে ধরা পড়ে না নেপথ্যের নায়কেরা। মাদক পাচার ও ব্যবসার ভিত এখন অনেক শক্ত।
দেশ, সমাজ ও জাতি বিধ্বংসী এই ব্যবসায়ী ও পাচারকারী সিন্ডিকেটও এখন চরম বেপরোয়া। এ সিন্ডিকেটে আছে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা, রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তান, জনপ্রতিনিধি। বাদ নেই মাদক প্রতিরোধের দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরাও।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, মাদক সেবনের জন্য গড়ে উঠছে অসংখ্য নিরাপদ আস্তানা। গেস্টহাউজ, রেস্টহাউজ, মিনি চাইনিজ, আবাসিক হোটেল আর অভিজাত বাসা-বাড়িতেও বসছে মাদকের আসর। এসব আসরে মাদকের সাথে মিলছে নারীও। টাকার বিনিময়ে সেখানে যেমন খুশি তেমন ফুর্তি করার সুযোগ আছে। আলো-আঁধারিতে রঙিন এ নেশার জগতের স্বাদ নিতে পঙ্গপালের মতো ছুটছে উঠতি যুবক ও কিশোরেরা। কেউ সঙ্গ দোষে, কেউ আবার কৌতুহলবশে আসরে যাচ্ছে। তবে একবার যাওয়ার পর আর ফেরা হচ্ছে না ওই দুনিয়া থেকে।
স¤প্রতি নগরীর অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে হানা দিয়ে এমন একটি গেস্টহাউজের সন্ধ্যান পায় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ইয়াবা গেস্টহাউজ নামে পরিচিত বাড়ির মালিক খুলশী থানার সাবেক ওসি মাইনুল ইসলাম। সেখানে ইয়াবা সেবন আর অসামাজিক কর্মকাÐের দায়ে বেশ কয়েকজনকে সাজাও দেয় ওই ভ্রাম্যমাণ আদালত।
নগরীর বেশ কিছু আবাসিক হোটেল ও মিনি চাইনিজেও রয়েছে অবাধে মাদকসেবন আর ফুর্তি করার ব্যবস্থা। নগরীর অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ‘ফয়স লেক’ এলাকার কয়েকটি আবাসিক হোটেল ও মিনি চাইনিজ রেঁস্তোরায় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। আটক করা হয় কয়েক ডজন তরুণ-তরুণীকে।
চট্টগ্রামে মাদকের ভয়াল আগ্রাসন চলছে দীর্ঘদিন থেকে। র্যাব-পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করে। জোরদার অভিযানে প্রায় ধরা পড়ছে মাদকের চালান। নানা কৌশলে মাদকের চালান নিয়ে আসছে মাদক ব্যবসায়ীরা। অভিযানের মুখে তাদের পাচারের ধরনও পাল্টাচ্ছে। অভিযানের মুখেও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদক পাচার।
চোরাচালান প্রতিরোধে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক টাস্কফোর্স, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিন পুলিশ ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে মাদক বিরোধী অভিযান। নগর জেলা পুলিশের থানাপর্যায়ে মাদক উদ্ধার অভিযান উৎসাহিত করতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে।
যেসব পুলিশ কর্মকর্তা মাদক উদ্ধার করছেন তাদের বিশেষ পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। এত কিছুর পরও মাদকদ্রব্য আসছে। মাদকের হাটগুলোতে চলছে জমজমাট কেনা-বেচা। মাদক ব্যবসাকে ঘিরে প্রায়ই সংঘাত-সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। মাদকাসক্তির কারণে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতাও। নেশার টাকা জোগাড় করতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর তরুণরা। নেশার টাকা না পেয়ে স্ত্রীকে খুন করছে স্বামী, সন্তানের হাতে খুন হচ্ছে পিতা-মাতা। পারিবারিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা।
জেলা প্রশাসন মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, সাম্প্রতিককালে নগরীতে ব্যাপকহারে মাদক সেবনের আসর বসা শুরু হয়েছে। রেস্টহাউজ, গেস্টহাউজ, আবাসিক হোটেল এমন কি- বিশেষ কিছু বাসা-বাড়িতেও এ আয়োজন চলছে। মাদক সেবনের সাথে সাথে এসব আসরে চলে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। এসব আসরে যারা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগ ছাত্র এবং উঠতি যুবক ও কিশোর। এতে করে নতুনপ্রজন্ম বিপথগামী হচ্ছে। স¤প্রতি নগরীর অভিজাত খুলশী এলাকার একটি গেস্টহাউজে এমন একটি মাদক সেবন ও অসামাজিক কর্মকাÐের আস্তানা আবিষ্কার করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। কথিত ওই গেস্টহাউজে চলত ইয়াবাসহ মদ আর দেহব্যবসা। বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীরা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ওই গেস্টহাউজে মিলিত হতো ভোগসম্ভোগে। আর এ গেস্টহাউসের মালিক নগরীর খুলশী ও সদরঘাট থানার সাবেক ওসি মাইনুল হক ভ‚ঁইয়া। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমানের নেতৃত্বে খুলশীর হাবিব লেনের ওই বাড়িতে মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ‘ইয়ারা গেস্টহাউজ’ নামে এ বাড়িতে মাদক, দেহব্যবসা হয়। সদরঘাট থানার বহিষ্কৃত সাবেক ওসি মাইনুল এর মালিক। এ গেস্টহাউজ থেকে চার বোতল ভদকা, বিশ পিস ইয়াবা, ইয়াবা ও সীসা সেবনের সরঞ্জাম এবং এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার নয়শত নব্বই টাকা উদ্ধার করা হয়। ইয়াবা ব্যবসা, সেবন ও অসামাজিক কার্যক্রম চালানোর জন্য ১৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ দেয়া হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্টেট জানান, ইন্ডিয়ান ভিসা সেন্টারের পাশের গলি হাবিব লেন। এই লেনের শেষ মাথায় পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ইয়ারা গেস্টহাউজ। নিচতলায় অফিস, দুই থেকে পাঁচ তলায় বিভিন্ন রুমে চলে দেহব্যবসা। প্রতি রুমে পাওয়া যায় ইয়াবা তৈরি ও সেবনের সরঞ্জাম।
সেখানে পাওয়া যায় বিভিন্ন সময় এ গেস্টহাউজে আসা ব্যক্তিদের তালিকা। কলগার্লের তালিকা, বিভিন্ন তারিখে তাদের দেয়া টাকা ও টোকেন। হোটেলের মেয়েদের সাথে কথা বলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। তারা জানায়, প্রতি পুরুষের কাছ থেকে ম্যানেজার এক হাজার টাকা করে নেয়, আর মেয়েদের দেয়া হয় ৫০০ টাকা করে। সেখান থেকে এগার তরুণীকে আটক করা হয়। যাদের বয়স ২০ থেকে ২৬ বছরের মধ্যে। জানা যায় মহানগরীতে এ ধরনের আরো অনেক গেস্টহাউজ রয়েছে।
আবাসিক হোটেলেও চলছে মাদক সেবনের কারবার। আবাসিক হোটেল ও মিনি চাইনিজের আলো-আঁধারিতে চলে অসামাজিক কার্যক্রমও। স¤প্রতি নগরীর ফয়’স লেক এলাকায় দিনের বেলায় আকস্মিক অভিযান চালিয়ে ৪৫ যুবক-যুবতীকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এদের মধ্যে রয়েছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীসহ চাকরিজীবী এবং ব্যবসায়ীও ছিলেন। তাদের মধ্যে সাজা দেয়া হয়েছে সাত জনকে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিলুর রহমান ও সাবরীনা রহমান এ অভিযান পরিচালনা করেন। তাদের সহযোগিতা করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর নবম এপিবিএন এবং আনসার-ব্যাটালিয়নের সদস্যরা। আদালত দেখতে পায়, মোটেল সিক্স সোনালী (আবাসিক), মোটেল ফাইভ লেকসিটি, লেক ভিউ রিসোর্ট, রিয়েল পার্ক, হিল ভিউ রিসোর্টসহ প্রায় ৫০টি মিনি চাইনিজে মাদকের ও দেহ ব্যবসার আসর বসে। প্রতিকক্ষে জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতীর সন্ধান পায় অভিযানকারী দল। সেখান থেকে বিভিন্ন বয়সের ৪৫ জন ছেলে-মেয়েকে আটক করা হয়।
আদালত পরিচালনাকারী একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, সেখানে বেড়াতে আসা ছেলে মেয়েদের হোটেলের বয়েরা তাদের হোটেলে ডেকে নিয়ে আসে। তাদের ‘এখানে নিরাপদ’ বলে, বিভিন্ন দামে হোটেলের রুম ভাড়া দেয়। ঘণ্টা হিসেবে আদায় করা হয় হোটেল ভাড়া। হোটেলের রুম ও মিনি চাইনিজের রুমগুলো অন্ধকার ও কালো গøাসে ঢাকা। এখানে মাদক ও অসামাজিক কার্যক্রমের আস্তানা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন