এম এম খালেদ সাইফুল্লা : একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছে ‘দেশে উৎপাদিত উন্নতমানের সুতার তুলনায় সুচিন্তিতভাবে দাম কমিয়ে দেওয়ার ফলে টেক্সটাইল, উইভিং ও স্পিনিং কারখানাগুলোও ভারতীয় সুতার ব্যবহার বাড়িয়ে চলেছে। এর ফলে বিক্রি কমে যাচ্ছে দেশীয় সুতার। হাজার হাজার টন দেশীয় সুতার পাহাড় তৈরি হচ্ছে গোডাউনগুলোতে।’
এখানে আপত্তির কারণ হলো, ভারতের এসব সুতা অত্যন্ত নিম্নমানের। কিন্তু দাম কম হওয়ায় শিল্পকারখানার মালিকরা ভারতীয় সুতা দিয়েই কাপড় তৈরি করছেন। এর ফলে দেশীয় বস্ত্র তথা কাপড় তার মান হারাচ্ছে এবং এসব কাপড় দিয়ে তৈরি করা পোশাক আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হচ্ছে না। পরিণতিতে সামগ্রিকভাবে দেশের গার্মেন্ট শিল্পও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে, বস্ত্রখাতের শিল্প মালিকরা ভারতীয় সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। তারা অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপসহ এমন কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন, যাতে ভারতের সুতা বাংলাদেশে ঢুকতে এবং বিক্রি না হতে পারে। বৈধ আমদানির ক্ষেত্রে সুতার মান নিশ্চিত করার জন্যও দাবি জানিয়েছেন শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা। প্রসঙ্গক্রমে তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ভারত নানা নামের শুল্ক ও অশুল্কগত বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে কত বিচিত্র পন্থায় বাংলাদেশী পণ্যের আমদানিকে বাধাগ্রস্ত করে থাকে। এসব কারণে বাংলাদেশের সবচাইতে মানসম্পন্ন পণ্যও যে ভারতে ঢুকতে এবং বাজার পেতে পারে না সে কথাটাও বলেছেন তারা।
আমরা বস্ত্রখাতের শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি ও বক্তব্যের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করি। আমাদের উদ্বেগের প্রধান কারণ আসলে দেশীয় শিল্প। প্রসঙ্গক্রমে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, বিশ্বের সব দেশই জাতীয় পুঁজি ও শিল্পের বাধাহীন বিকাশের স্বার্থে অন্য দেশের এমন কোনো পণ্য আমদানি করতে দেয় না, যে পণ্য দেশের ভেতরেই যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হয়। এর কারণ, একই পণ্য আমদানি করার সুযোগ দেয়া হলে দেশীয় পণ্য প্রচার-প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে। এ ধরনের অবস্থায় রফতানিকারক রাষ্ট্র প্রায় ক্ষেত্রেই তার পণ্যের দাম কমিয়ে থাকে, এমনকি লোকসান দিয়ে হলেও। ফলে ক্রেতা তথা ব্যবহারকারীরা আমদানিকৃত পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং পর্যায়ক্রমে সে পণ্যের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে বাজার হারায় দেশীয় পণ্য। এভাবে চলতে চলতে এক সময় পণ্যটির সম্পূর্ণ বাজারই রফতানিকারক রাষ্ট্রের দখলে চলে যায়। ওই রাষ্ট্রটি তখনই শুরু করে তার আসল ব্যবসা। ধীরে ধীরে, কখনো আবার রাতারাতি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। ওদিকে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় দেশীয় পণ্যের উৎপাদন যেহেতু বন্ধ হয়ে যায় এবং বাজারে যেহেতু পণ্যটি আর পাওয়া যায় না, সেহেতু রফতানিকারক রাষ্ট্রের বেঁধে দেয়া দামেই ক্রেতা ও ব্যবহারকারীরা কিনতে বাধ্য হয়।
বিভিন্ন দেশে এভাবেই অনেক জাতীয় বা দেশীয় পণ্য বাজার হারিয়েছে। দেশের ভেতরে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বহু পণ্যের উৎপাদন তথা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে চাকরি হারিয়েছে দেশটির শ্রমিকরা। শিল্প মালিকরাও বিপুল ক্ষতির মুখে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেননি। মূলত এজন্যই দেশপ্রেমিক কোনো সরকারই তার দেশে সাধারণত এমন কোনো পণ্য আমদানি করতে দেয় না, যে পণ্য দেশেই উৎপাদিত হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশে চলছে সম্পূর্ণ বিপরীত কার্যক্রম। ‘সোনালী আঁশ’ পাটের পর এ সম্পর্কিত সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবেই এসেছে সুতার প্রসঙ্গ। চাহিদা পূরণের মতো যথেষ্ট পরিমাণ সুতা দেশের ভেতরে উৎপাদিত হলেও সরকার একই সুতা ভারত থেকে আমদানি করার লাইসেন্স ও অনুমতি দিয়েছে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে ভারতীয়রা। এর ফলে মাঝখান দিয়ে দেশীয় সুতা শুধু বাজার হারাচ্ছে না, সুতা উৎপাদনকারী মালিকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় পুঁজি ও শিল্প। অথচ ভারতীয় সুতা আমদানি করতে না দেয়া হলে জাতীয় শিল্পের বিকাশ তো ঘটতোই, চাকরি হারানোর পরিবর্তে আরো কয়েক হাজার মানুষ চাকরিও পেতে পারতো। সব মিলিয়েই উপকৃত হতো দেশ এবং দেশের অর্থনীতি।
আমরা মনে করি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকারের উচিত অবিলম্বে ভারতীয় সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করা। সরকারকে একই সঙ্গে এমন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে যাতে কারো পক্ষেই চোরাচালানের পথে সুতা আমদানি ও বিক্রি করা এবং নিম্নমানের ভারতীয় সুতা মজুত বা ডাম্পিং করা সম্ভব না হয়। দেশের টেক্সটাইল, উইভিং ও স্পিনিং কারখানাগুলো যাতে কেবল বাংলাদেশের সুতাই ব্যবহার করতে বাধ্য হয় সে ব্যাপারেও সরকারকে তৎপর হতে হবে।
ষ লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, কেন্দ্রীয় কমিটি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন