বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুক্তাঙ্গন

ভুল পাঠ্যপুস্তক বনাম অসাম্প্রদায়িক গোড়ামি

| প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জি কে সাদিক : নতুন বছরে ১ জানুয়ারি সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে সরকার নতুন বই তোলে দেওয়ার মাধ্যমে নবর্ষের যাত্রা শুরু করে। সারাদেশে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের শুরুতে নতুন বই তোলে দেওয়া এটা সরকারের এক বড় কৃতিত্ব এবং প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। তবে এবারের বই উৎসবের পিছু তাড়া করে ভুল পাঠ্যপুস্তকের নামে এক বিতর্ক। তবে এই বিতর্কে কিছু প্রসঙ্গিক ও অপ্রসঙ্গিক বিষয় জড়িত হয়েছে। যেটা বিতর্কটাকে শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমা বদ্ধ রাখেনি। পাঠ্যপুস্তকের যে বিষয়গুলো নিয়ে সমালোচনার ঝড় তোলা হয়েছে তার মধ্যে হলো ১. ভুলে ভরা পাঠ্যবই, ২. সাম্প্রদায়িকতা, ৩. লিঙ্গবৈষম্য, ৪. অপ্রাসঙ্গিকতা ও ৫. রাজনৈতিক প্রচারণার অভিযোগ। এতগুলো অভিযোগ কোনো পাঠ্যপুস্তকের বিষয়ে উঠলে সেটা কোনো মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক হতে পারে না। তবে বড় কথা হলো কিছু বিষয়ে তিলকে তাল বানিয়ে অপপ্রচার ও পরিবেশকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। আবার কিছু বিষয়ে তালকে নাই করে দেওয়া হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক সমালেচনায় কেন্দ্র এক কিন্তু দুটি পক্ষের অবতারণা হয়েছে। একপক্ষের দাবি পাঠ্যপুস্তককে একটা ধর্মের দিকে লক্ষ্য রেখ প্রণয়ন করা হয়েছে এবং আরো অন্যান্য বিষয়ে ভুলের কথা তারা বলেছে। আরেক পক্ষ এখানে ধর্মীয় শিক্ষাকে কেন্দ্র করে পাঠ্যপুস্তক রচনার দাবি তুলেছে এবং অসঙ্গতি ও ভুলগুলোর সমালোচনা করেছে। আসলে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত রাষ্ট্র এবং জনগণের কল্যাণে নৈতিকতা পূর্ণ ও বাস্তবমুখী।
কিছু ভুল আছে যেগুলো মার্জনীয় কথাটাকে অপারগ করে দেয়। এ বছর পাঠ্যবইগুলোতে যে ভুল করা হয়েছে সেগুলোও অমার্জনীয় ভুলের কাতারে শামিল। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতার ভুলটি যেন সম্পাদনা পরিষদ ও সম্পাদক সবাই মিলে প্রুফ করে ভুল করেছে। ভুলগুলো কবিতার ছন্দ পতন ঘটিয়েছে ও প্রত্যয়জনিত ভুলও হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে ঘোষণা হয়ে গেছে, ঘোষণা সমুদ্র বানান প্রয়োজনীয় উপাদান হারিয়ে হয়েছে সমুদ। তৃতীয় শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে লেখা নীতি বাক্য লেখাতে হয়েছে বানানজনিত ভুল। ‘কাউকে কষ্ট দিও না-র ইংরেজি লেখা হয়েছে, উঙ ঘঙঞ ঐঊঅজঞ অঘণইঙউণ.
অন্যদিকে রয়েছে অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়। প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে আম-এর ছবি দিয়ে ছাগলকে গাছে তুলে আম খায়িয়েছে। প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ের পাঠ-১১ এর ৩০ পৃষ্ঠায় রোকনুজ্জামান খানের কবিতা, ‘বাক বাকুম পায়রা’কবিতাটা প্রথম শ্রেণির ছোট শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক তা ভাবার বিষয়। পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদ, ছবি বা কোনো চিত্র ও লেখা আমাদের শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের কতটা সহায়ক হবে সে দিকে লক্ষ্য রেখেই পাঠ্যপস্তুক প্রণয়ন করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের গড়ে তুলবে দেশ-জাতির সম্পদ হিসেবে। কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে বা তাদের দলীয় করে গড়ে তুলবে না এবং পাঠ্যপুস্তক কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পত্তিও নয়। মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে শিক্ষা একটি। কিন্তু ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তক একটা রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্রের পরোক্ষ ভূমিকায় আছে। শিক্ষা খাতটাকে সম্পূর্ণ রাজনীতির বাহিরে রাখতে হবে। কারণ আমাদের দেশের অসুস্থ রাজনীতির ছোঁয়াতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সুস্থ থাকতে পারবে না।
বছরের শুরুতেই পাঠ্যপুস্তকের কয়েকটা বিষয় নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে নাকি সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ রয়েছে। অনেকে সাহস করে সাম্প্রদায়িক না বলে তার মনের চাঁপা ক্ষোভ তথা ইসলামের কথা বলে দিয়েছে। যারা সাম্প্রদায়িক বলেছে তারা একটু চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। যারা এমন উস্কানিমূলক প্রচার ও জোর আন্দোলন করছে তারা না বুঝেছে ইসলাম, না বুঝেছে সাম্প্রদায়িকতা, না বুঝেছে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। প্রথম শ্রেণির পাঠ্য আমার বাংলা বইয়ে ওড়না আর অজু নিয়ে এরা যে ‘অসাম্প্রদায়িক’ গোড়ামি শুরু করেছে তা প্রায় সকল গোড়ামিকে ছাড়িয়ে গেছে। ও’ তে ওড়না চাই, এটাকে তারা ইসলামের দিকে সম্পৃক্ত করে বলছে যে পাঠ্যপুস্তক না কি হিজাবিকরণ করা হয়েছে। বাঙালির আসল সাংস্কৃতিক রূপ সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার জন্য তারা এমন অহেতুক বিতর্কের অবতারণা করেছে। উপমহাদেশের ও বাংলাদেশের হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টানসহ প্রায় সব সম্প্রদায়ের নারীদের মাঝে ওড়নার প্রচলন রয়েছে। এটা শুধু মুসলিম মহিলারা ব্যবহার করেন না সব বাঙালি নারীই তাদের প্রথাগত ও শালীনতার পোশাক হিসেবে ওড়না ব্যবহার করে থাকেন। এটা আমাদের সংস্কৃতি। পশ্চিমা নারীদের ওড়না পরতে দেখা যায় না। কারণ তাদের কালচারে ওড়নার প্রচলন নাই। যেমন ইউরোপ, আমেরিকার দেশসমূহ। ওড়না নিয়ে তারা যে সমালোচনা করেছে তা বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতার একটা দিক।
ইসলামে পবিত্র কুরআনে সূরা আহযাবের ৫৯ আয়াতে ও সূরা নূরের ৩০ ও ৩১ আয়াতে যে হিজাবের কথা বলা হয়েছে এবং পবিত্র হাদিসে যে হিজাবের কথা বলা হয়েছে তার সাথে ওড়নার সম্পর্ক অনেক দূরের। হিজাব মানে হচ্ছে আড়াল করা, ঢেকে নেওয়া। যা সূরা আহযাবের ৫৯ আয়াতের তাফসির পড়লে আরো বিস্তারিত জানতে পারবেন। পাঠ্যপুস্তকে যে ওড়নার কথা বলা হয়েছে সে রকম ওড়না কোনো মহিলা সাহাবি ব্যবহার করতেন না। তাহলে ওড়নাকে ইসলামের দিকে সম্পৃক্ত করে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেওয়া ‘জ্ঞানী’দের উদ্দেশ্য সম্পর্কে খুব একটা ভাবতে হয় না।
শিক্ষার একটা বড় উপাদান হলো ইতিহাস। ইতিহাস আমাদের অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের প্রেরণা যোগায়। কোনো দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রেরণা লাভের এক বিরাট উৎস স্থল। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক ইসলামীকরণ করা হয়েছে এই অপবাদ দিয়ে বাম বুদ্ধিজীবীরা আমাদের অতীত ইতিহাসের সাথে চরম দৃষ্টা দেখিয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে খলিফা হযরাত আবু বকর (রা.); চতুর্থ শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে খলিফা হযরত ওমর (রা.) এবং পঞ্চম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ে শহিদ তিতুমীর সম্পর্কে রচনা সংযোজন করা হয়েছে বলে এরা পাঠ্যপুস্তককে ইসলামীকরণ করা হয়েছে বলে সাম্প্রাদায়িকতার দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এদেশের জনগণ ৮৫ শতাংশ মুসলিম তাদের প্রেরণা ও শিক্ষা লাভের একটা অংশ হলো তাদের ধর্ম অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য। আর ইসলাম কোনো নগণ্য ধর্ম নয়, ইসলামের অতীত শিক্ষাপ্রদ। আর ইতিহাসের একটা সোনালী অধ্যায় জুড়ে আছে মুসলিম খলিফাদের শাসনকাল। অর্ধ-পৃথিবী শাসন করার গৌরব তাদের আছে। তাহলে খলিফাদের জীবনী পাঠ্য করায় শিক্ষার কোন দিক থেকে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে? যারা ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করেছে তাদের কাছে ইসলাম কতটা শিক্ষাপ্রদ ধর্ম তা সহজে অনুমেয়।
আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়, যদি না আমরা ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর পর থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিমদের অবদানের কথা উল্লেখ না করা হয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে স্বাধীনতা আন্দোলনগুলো হয়েছে তার প্রত্যেকটা আন্দোলনে ক্ষেত্রে মুসলিমরাই ছিলেন অগ্রণী। সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন, ওহাবি আন্দোলন, তিতুমীর আন্দোলন, বকসারের যুদ্ধ, ভারতের বালাকোটে প্রান্তরে যুদ্ধ, টিপু সুলতানের যুদ্ধ, মুসলিম লীগ গঠন, বর্তমানের আওয়ামী লীগ গঠন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন- আন্দোলনগুলোর সব ক’টায় মুসলিরা করেছে। তাহলে যারা তিতুমীর সম্পর্কিত রচনা সংযোজন করার কারণে পাঠ্যপুস্তক ইসলামীকরণ করা হয়েছে বলে ভ্রান্ত প্রচার করছে তারা কী আমাদের অতীত ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চায়?
অনেক দেশের রাষ্ট্র ধর্ম আছে এবং সে দেশগুলোতে তাদের ধর্মের আলোকে আইন ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। মালেশিয়ার রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও ইসলামের অনুকরণ অনুসরণ রয়েছে, সেখানে আমাদের মতো এত বিতর্ক নেই। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য লক্ষণীয়। তাহলে আমাদের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম, এখানে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে এতে সমস্যার কী আছে? সরকারের উচিত সকল ধর্মের জন্য তাদরে ধর্মে মূল শিক্ষা অর্জনের ব্যবস্থা করা। মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে অন্য কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হলে তা আমাদের জাতি সত্তার জন্য হবে চরম অবমাননা। যারা ইসলামী ভাব ধারাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু চেতনার বিরুদ্ধে মনে করে তাদের জন্য বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কী ছিলো তা ভালো করে অধ্যায়ন করে দেখার অনুরোধ থাকলো। ইসলামের চেতনা বা মুসলমানিত্ব বাঙালি চেতনার বিরুদ্ধে নয়। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বাঙালিদের বিষয়ে দুটি গুরুত্ব পূর্ণ কথা বলেছেন যেমন, ‘আমাদের বাঙালিদের মধ্যে দুইটা দিক আছে, একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ. ৪৭, মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড) তাহলে যারা বাঙালি চেতনার সাথে ইসলামী চেতনার বিরোধ বাঁধানোর চেষ্টা করে তাদের মুখোশের আড়ালের চিত্র বুঝতে আর বাকি নেই।
ষ লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন