আফতাব চৌধুরী : নারী নামের দু’অক্ষরের ছোট্ট শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে এক সম্ভাবনাময় পৃথিবী। অতীতকাল থেকে আরম্ভ করে বর্তমান সময় পর্যন্ত কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় এক বিশেষ আসন দখল করে আছে নারী সমাজ। এক সময় নারীর ধর্মবুদ্ধি বিক্রম এবং কলা-কৌশল জগতের শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। সে সময় নারী ফুলের চেয়ে কোমল কিন্তু প্রয়োজনে বজ্রের চেয়েও কঠোর হওয়ার মতো জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত প্রচুর আছে। প্রাচীনকালের বিভিন্ন নারীর শ্রেষ্ঠ অবদানের কথা বাদ দিয়ে থাকলেও ঐতিহাসিক এবং আধুনিক যুগে রাজনীতি, যুদ্ধ বিগ্রহ, দেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়ে এ অঞ্চলের নারীদের প্রতিভার মহৎ উদাহরণ পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে একটি কথা আছে যে, নারীর কোনো স্বতন্ত্র অধিকার নেই। নারী স্বরাজের অনুপযুক্তা। নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভর করেই জীবন ধারণ করতে হয়। এভাবে শুধু বাংলাদেশেই নয় পাক ভারত উপমহাদেশের সর্বত্রই নারীকে পুরুষের অধীন বলে বিবেচনা করা হয়। নারীকে শিশুকালে মা-বাবার ওপর, যৌবনে স্বামীর ওপর এবং বৃদ্ধাবস্থায় পুত্রের ওপর ভরসা করেই থাকতে হয়। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে সকলকেই জীবন গ্রহণ এবং জীবনের সূচনা এমনকি জীবন ধারণের জন্য নারীর উপরেই ভরসা করতে হয়। একজন নারী শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যৌবন এবং প্রৌঢ় ও বৃদ্ধাবস্থায় পরিণত হতে হয় চিরন্তন গতিতে। ভোরের রক্তিমাক্ত সূর্য মধ্যাহ্নে প্রখর উত্তাপ ছড়িয়ে দিনান্তে যেমন গাছের ছায়া দীর্ঘতর হতে থাকে তেমনি জীবনে শৈশব ও উদ্দীপ্ত যৌবনের মধ্য দিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় গতি করে এ নারী অজান্তে এবং গোপনে। জীবন থাকলে বার্ধক্য থাকবেই এটা শাশ্বত সত্য। এ সত্যকে না মেনে উপায় নেই।
এভাবে একজন নারী জীবনের শৈশব অতিক্রম করে যৌবনের মধ্যদিয়ে যখন বৃদ্ধাবস্থায় পরিণত হন তখন বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিবেশে বৃদ্ধা নারীটির ভূমিকাও বিভিন্ন ধরনের হতে দেখা যায়। যেমন মাতৃপ্রধান সমাজ। এ সমাজে বৃদ্ধা মায়ের ভূমিকা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। কেননা সমাজে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠা হিসাবে বৃদ্ধা মা সকল ধরনের ধন সম্পদের অধিকারী তথা পরিবারের যে কোন পদক্ষেপে এ বৃদ্ধামার সক্রিয় পরামর্শ থাকে। তদুপরি সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ, বিবাহ বা অন্য যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বৃদ্ধা মাতৃর ভূমিকা অতি আবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হতেও দেখা যায়।
কেবল মাতৃপ্রধান সমাজেই যে বৃদ্ধা নারীর ভূমিকা পরিবারের সদস্যরা আবশ্যকীয় বলে ভাবেন তা নয়। আমাদের সমাজে বর্তমানে ও এমন বহু পরিবার আছে যেখানে বৃদ্ধা নারীকে প্রচুর সম্মান প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। তাই পরিবারের প্রতিটি কাজ কর্মে তথা সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদির সঙ্গে বৃদ্ধা নারীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখনীয়। মাতৃপ্রধান হোক আর পিতৃপ্রধানই হোক আমাদের সমাজের প্রত্যেক পরিবারে বৃদ্ধা নারীর ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। আমাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে বৃদ্ধা মহিলা পরিবার থেকে প্রকৃত মর্যাদা পাচ্ছেন কি না। আমাদের সমাজে এমন বহু ঘটনা আছে যে বৃদ্ধা নারীর দায়িত্ব নেয়া ও সম্মান দেয়া দূরের কথা তাদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে অবসম্মানিত করে উড়িয়ে দিচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের কিছু যুবক-যুবতীরা। ফল স্বরূপ বৃদ্ধারা হƒদয়ে আঘাত পান এবং নীরবে চোখের পানি ফেলে বসে থাকতে বাধ্য হন। একটি কথা মনে রাখা উচিত যে বৃদ্ধ পুরুষের তুলনায় বৃদ্ধা নারীরাই আর্থিক চিন্তা সন্তান-সন্তুতির ভবিষ্যৎ ইত্যাদির চিন্তায় বেশি অস্থির হয়ে পড়েন এবং তখনই বৃদ্ধাদের জীবন থেকে সবুজ রং হারিয়ে যায়। এ সময় তারা অনুভব করেন সাংসারিক ঘাত প্রতিঘাত, জীবন যন্ত্রণা। প্রকৃতির ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের পরিবর্তন চলতে থাকে। প্রবর্তিত জীবনযাত্রার মানুষের মানসিক মূল্য এবং চিন্তা ধাবার পরিসর সঙ্কুচিত হচ্ছে। তাই যৌথ পরিবারের ধারণা আজকের জীবন যাত্রার এক অবাস্তর পরিকল্পনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে আধুনিক সমাজের পরিবার বলতে অনুমিত হয় মা-বাবা আর তাদের এক জোড়া সন্তান। সাধারণত দেখা যায় যৌবন প্রাপ্তির পর সন্তান-সন্তুতিরা এক নিজস্ব মনোজগত সৃষ্টি করে নেয়। অন্যদিকে আর্থিক স্বাবলম্বিতার স্বার্থের সন্তানেরা বৃদ্ধা মায়ের থেকে দূর থাকার ফলে চিন্তা চর্চা তথা সংস্কারের রূপে এক বংশগত ব্যবধানের সৃষ্টি হচ্ছে। জীবনের দুঃসহ বোঝায় একই শহরে থাকা সন্তানকে বৃদ্ধা মায়ের থেকে দূরে রেখে দেয়। সুতরাং এমন অবস্থায় বৃদ্ধা নারীরা অভিমান না করে উত্তর পুরুষের সমস্যাগুলোকে সহানুভূতিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে হƒদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করা উচিত। কেননা প্রত্যেক মানুষের জীবনের এক নিজস্ব বৃত্ত আছে। সে নিজস্ব বৃত্তের মধ্যে থেকেও প্রত্যেক প্রত্যেকের হƒদয়কে অনুভব করার চেষ্টা করে উদার মনোবৃত্তিতে সুখের সন্ধান করলে বৃদ্ধাবস্থায় নিঃসঙ্গতা জীবনকে গিলে ফেলতে পারে না। আজকের যান্ত্রিক সময়ে মানবিক সম্পর্কক্রমে এক গতানুগতিক সৌজন্যতায় পরিণত হয়েছে। এমন সময় সমাজের অনেক ব্যক্তির জন্য বৃদ্ধাবস্থা হয়ে পড়েছে এক অভিশাপ। বিশেষ করে পুরুষদের থেকে নারীরাই বৃদ্ধাবস্থায় কোনো কোনো পরিবারে বোঝাস্বরূপ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। এটা হওয়া উচিত নয় বরং হয়ে থাকলে তার পরিবর্তন হওয়া বাঞ্চনীয় কারণ সবাইকে মনে রাখতে হবে বউ হয়ে শাশুড়ি হতে হয়, ছেলে হয়ে বাবা হতে হয়। বেঁচে থাকলে এর ব্যতিক্রম হয় না বা হওয়ার কথাও নয়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন