বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

ইসলামী ইবাদতের চতুর্থ রোকন : হজ

সত্যালোকের সন্ধানে

| প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান মুন্্শী
 (পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পবিত্র মক্কা এবং কাবা
হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং হযরত মূসা (আ.)-এর শরিয়ত মোতাবেক এটা অত্যাবশ্যক ছিল যে, যে স্থানে কোরবানির বস্তু প্রদক্ষিণ করানো হবে, সেখানে কোনও কোরবানগাহও হতে হবে এবং বাইতুল্লাহও থাকতে হবে। বিশেষ করে এ জন্যও যে, যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর ইবাদত করেছেন এবং সিজদাহ করেছেন এবং কোরবানগাহ বা বাইতুল্লাহ যেন এমন মশহুর হয় যেন সাথের সহচরদেরকে বলা যায় যে, তোমরা এখানে অবস্থান কর, “আমি সেখানে ইবাদত করে ফিরে আসছি।” সুতরাং এই বৈশিষ্ট্যগুলো কাবা শরীফ ভিন্ন অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এমনকি ইহুদি ও নাসারাগণও এর সমতুল্য কোনও স্থান প্রমাণস্বরূপ পেশ করতে পারবে না। আর এই মহত্ত্বর ঘটনার কোনও স্মৃতিচিহ্ন হযরত ইসহাক (আ.)-এর বংশেও ছিল না। তাছাড়া বাইতুল মুকাদ্দাস অথবা ঈসা মসীহ (আ.)-এর সার্বিক কর্মকা-ে এ ঘটনার কোনও চিহ্ন বা সংশ্লিষ্টতা ছিল না এবং বর্তমানেও নেই। পক্ষান্তরে বনু ইসমাঈল অর্থাৎ ইসমাঈলি আরবদের মাঝে এই কোরবানি এবং এর বৈশিষ্ট্যাবলীর এক একটি স্মৃতিচিহ্ন হাজার বছর ধরে সংরক্ষিত হয়ে চলছিল। যদিও এর মাঝে দীর্ঘকালের পরিক্রমায় এবং বিবর্তনের মাধ্যমে কোনো প্রকার কম-বেশি বা পরবর্তীকালের গোমরাহীর জন্য এর মাঝে অংশীবাদিতার কোনও সংস্পর্শ সংযোজিত হয়ে পড়েছিল। তবুও এর মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অটুট ছিল। আরবে মূর্তি পূজারি যেমন ছিল, তেমনি কাফির এবং মুশরিক ও তারকা পূজারিও ছিল। এমনকি খ্রিস্টান এবং ইহুদিও ছিল। কিন্তু আরবের প্রাচীন কবিতার দ্বারা প্রমাণিত যে, তাদের কাছে খানায়ে কাবা এবং হজের বিধি-নিষেধের গুরুত্ব সমভাবেই বিদ্যমান ছিল। শুধু তাই নয়, আরব খ্রিস্টানরাও এগুলোর শপথ বাণী উচ্চারণ করত। আর সম্ভবত এ কারণেই খানায়ে কাবাতে তৎকালে অংশীবাদীদের মূর্তির সারি বিদ্যমান ছিল এবং একই সাথে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর, হযরত ঈসা (আ.)-এর এবং হযরত মরিয়ম (আ.)-এর মূর্তিও স্থাপিত হয়েছিল। (আখবারে মক্কা : আজরাকী; ফতহুল বারী, ইবনে হাজার; সীরাতে ইবনে হিশাম) কাবা হচ্ছে সেই মোকাম যা মুসলিম আরেফদের খেয়াল মোতাবেক আরশে ইলাহীর ছায়া এবং তাঁর রহমত ও বরকতের কেন্দ্রবিন্দু। সৃষ্টির প্রারম্ভ হতেই এ স্থানটি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীর কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। “প্রথম গৃহ যা আল্লাহর ইবাদত নিষ্পন্ন করার খাতিরে মানুষের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল।” (সূরা আলে ইমরান : রুকু-১০)মক্কা এবং কা’বার অধিষ্ঠান তাই ছিল। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পূর্বে পথভ্রষ্ট পৃথিবীর অধিবাসীরা তার কথা বিস্মৃত হয়ে এর নাম ও নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর দ্বারা আল্লাহপাক যখন এই অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীর বুকে তাওহিদের সমুজ্জ্বল চেরাগ সমুন্নত করলেন, তখন হুকুম দেয়া হলো যে, “কাবা গৃহের চারটি দেয়াল উঁচু করে দুনিয়ার বুকে তাওহীদের ভিত্তি প্রস্তর পুনর্বার গ্রথিত করা হোক।” সুতরাং কোরআনুল কারীমের বর্ণনা মোতাবেক (সূরা হজ ৩, ৪) কাবা শরিফ হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর আমলেও ‘আল বাইতুল আতীক’ বা পুরাতন গৃহ হিসেবে পরিচিত ছিল। এটা কোনো নতুন গৃহ ছিল না। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ও হযরত ইসমাঈল (আ.) উভয়ে তত্ত্ব-তালাশ করে এর পুরাতন ভিত্তিমূল উদ্ধার করেন এবং এর চার দেয়াল নির্মাণ করেন। আল কোরআনের ঘোষণা : “ইব্রাহীম (আ.) যখন এই গৃহের ভিত্তি প্রস্তর সমুন্নত করে ছিলেন” দ্বারা বোঝা যায় যে, এই গৃহের স্থান পূর্ব হতেই নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত ছিল। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এবং হযরত ইসমাঈল (আ.) সেই চিহ্নের ওপরই নতুন করে দেয়াল নির্মাণ করেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) ইরাক, শাম, মিসর প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করে পরিশেষে দীর্ঘকালের অজ্ঞাত স্থানটির সন্ধান লাভ করেন, যা ঐশ্বর্যশীল রাজন্যবর্গ, মূর্তি পূজারিদের আড্ডাখানা ও তারকা পূজারিদের সীমারেখা হতে বহু দূরে অবস্থিত, চারদিকে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় অবস্থিত ছিল। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “আমি ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্য এই গৃহকে ঠিকানা নির্ধারণ করে ছিলাম, যেন আমার সাথে কখনো অংশী স্থাপন করা না হয়।” (সূরা হজ : রুকু-৪) এ আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে, এই পবিত্র গৃহের স্থানটি ছিল পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু কালের করাল গ্রাসে এর দেয়ালগুলো ধসে পড়েছিল। আল্লাহপাক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে এর ঠিকানা শনাক্ত করে দিয়েছিলেন। যেন এ গৃহটি তাওহীদ পন্থিদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে বরিত হয় এবং মূর্তি পূজারিদের হাত হতে নিরাপদ থেকে সত্য ধর্মের তাবলিগের কাজ সূচারুরূপে পরিচালিত করা সহজতর হয়। তৌরাতের ভাষ্য হতেও জানা যায় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর পূর্ব হতেই এই ইবাদতের স্থানটি মজুদ ছিল। কেননা শামী পদ্ধতি মোতাবেক এটা আবশ্যকীয় ছিল যে, যে স্থানে আল্লাহর কোরবানি অথবা নজর অথবা ইবাদত করা হয়, এটা যেন কোনও ইবাদতের স্থান বা কোরবানগাহ হয়। এই নিরিখে সেই স্থান যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং যে সম্পর্কে তিনি স্বীয় খাদেমদের বলেছিলেন যে, আমি সেখানে গমন করে ইবাদত সম্পন্ন করার পর ফিরে আসছিÑ সেখানে অবশ্যই ইবাদতগাহ থাকবে। এ জন্য কোরআনুল কারীমে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর প্রতি সে গৃহকে নতুন নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয়নি বরং নতুন সংস্কার ও পবিত্রকরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, “আমার গৃহকে ইবাদতগুজার বান্দাহদের জন্য পবিত্র কর।” আর  তখনো পর্যন্ত সেই ভূখ-ের জন্য আরব শব্দটিরও উৎপত্তি হয়েছিল না। কেননা ‘আরব’ শব্দটি সম্মিলিত তৌরাতের মাঝে হযরত সুলাইমান (আ.)-এর জমানায় পাওয়া যায়। এর পূর্বে এই স্থানটির নাম পূর্ব অথবা দক্ষিণ দেশ বলে অভিহিত ছিল। কেননা এই স্থানটি সিরিয়ার দক্ষিণে বা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। কখনো কখনো এর নাম ছিল ‘মরু এলাকা’ বা বিয়াবান। পরিশেষে এই বিয়াবান এলাকাটির নাম ‘আরব’ রাখা হয়। মূল আরব শব্দটির অর্থ হচ্ছে বিয়াবান বা বিস্তৃত মাঠ (আরদুল কোরআন, ১ম খ., ৫৭-৬০ পৃ. দৃষ্টব্য)। এ জন্য হযরত ইব্রাহীম (আ.) যখন বলেছিলেন, হে আমাদের পরওয়ারদিগার! আমি আমার কিছু সংখ্যক সন্তান-সন্তুতিকে এমন এক ভূখ-ে বসত করিয়েছি, যেখানে ক্ষেত-ফসল মোটেই নেই।” (সূরা ইব্রাহীম : রুকু-৬)
মক্কা শব্দটি প্রাচীন ভাষাসমূহের বিশেষজ্ঞদের মতে, বাবুলী অথবা কালদানী শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে গৃহ বা আবাস। (তারীখুল আরব কাবলাল ইসলাম : জরজি যয়নুদ্দীন, ২৪৪ পৃ.)  
এই বিশ্লেষণের দ্বারা দুটি হাকিকত বেরিয়ে আসে : (১)  এটা সুস্পষ্ট যে, এ স্থানটি ছিল বাবুল ওকালদান সম্প্রদায়ের কাফেলাসমূহের ভ্রমণ স্থল। এর দ্বারা হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সম্পর্কে একটি আভিধানিক সম্পর্কও প্রতিষ্ঠিত হয়। (২) আর এই শহরের আবাদি সে গৃহটির অস্তিত্বের কারণেই হয়েছিল। এর দ্বারা এই খানায়ে কাবার পবিত্রতা এবং প্রাচীনত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এবং আরব অধিবাসীদের বর্ণনার সত্যতাও প্রমাণ করে।   হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর স্মৃতি : পবিত্র মক্কার ‘বাক্কা’ নামটি সর্বপ্রথম যাবুর কিতাবে পরিদৃষ্ট হয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার যে, প্রাচীন শামী ভাষায় ‘বাক’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে আবাদি অথবা শহর। যেমনÑ আজও শামের একটি প্রাচীন শহরের নাম ‘বায়ালবাক’। অর্থাৎ বায়াল-এর শহর। (বায়াল একটি দেবতার নাম) এতেও এ শহরটির প্রাচীনত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর কা’বার প্রাথমিক নির্মাণের সময় এই নামটিই আল কোরআনে উক্ত হয়েছে, ‘অবশ্যই প্রথম গৃহ যা মানুষের ইবাদতের জন্য বাক্কাতে নির্মাণ করা হয়েছে”।
কা’বা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে চতুষ্কোণাকৃতি। কারণ এই ঘরটি চতুষ্কোণাকৃতিতে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখনো এর আকৃতি অবিকল তা-ই রয়ে গেছে। ্এজন্য গৃহটি কা’বা নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। গ্রিক ইতিহাসেও কা’বার উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। গ্রিসের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ‘থিওডোরস’ যিনি হযরত ঈসা (আ.)-এর এক শতাব্দী পূর্বে জীবিত ছিলেন, তিনি আরব প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন : সামুদ সাবা বংশীয়দের মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি বিখ্যাত ইবাদাতখানা আছে। যার নাম আরবগণ অত্যন্ত সম্মানের সাথে স্মরণ করে। (গীবন : রোমানদের উত্থান-পতন: পঞ্চদশ অধ্যায়) সামুদ গোত্রের অধিবাস ছিল শাম এবং হিজাজ অঞ্চলে, আর সাবা গোত্রের বসতি ছিল ইয়েমেনে। এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, এ দু’টি অঞ্চলের মধ্যবর্তী স্থান হিজাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং এখনকার খ্যাত ইবাদত গৃহ যার নাম আরবগণ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, তাহলো “খানায়ে কা’বা।”
তাছাড়া রোমানদের ইতিহাসেও খানায়ে কা’বার উল্লেখ পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক প্রাদকোপাস লিখেছেন : ৫৪১ খ্রিস্টাব্দে রোমান সেনাপতি ‘ব্লিজির’ স্বীয় অধীনস্থ সেনাপতিদের একটি অধিবেশন আহ্বান করেন। এতে শাম দেশের দু’জন সেনা অফিসার দাঁড়িয়ে বলল, “তারা আগামী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। কেননা তারা যদি নিজেদের স্থান পরিত্যাগ করে তাহলে আরবের রাজা তীয় মুনজির’ অকস্মাৎ হামলা করে বসবে”। তাদের কথা শুনে সিপাহসালার বললেন : “তোমাদের এই ভয় অমূলক। অতিসত্বর সেই মওসুম এসে যাবে, যার দু’টি মাস আরবগণ ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখে। এ সময় তারা সকল প্রকার অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখে।” (নাতায়েজুল আকহাম ফী কবীমিল আরবে কাবলাল ইসলাম : মাহমুদ পাশা ফুলকী, পৃ. ৩৫ এবং ফ্রান্স এশিয়াটিক জার্নাল, এপ্রিল ১৮৮৩ খৃ.)। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এ সময়টি ছিল হজ্জের সময়।
উপরোল্লিখিত প্রমাণাদির দ্বারা বোঝা যায় যে, আরবের অধিবাসীরা কিংবা বনী ইসমাঈল সর্বদাই নিজেদের পৈতৃক অনুষ্ঠানাদি পালন করত। আর এ সকল অনুষ্ঠান পূর্ণ বৈশিষ্ট্যসহ তাদের মাঝে বিদ্যমান ছিল। তাই দেখা যায়, জাহিলিয়াত আমলে, রচিত কাব্য কবিতায় হজের কথা এবং হজের আরকানের কথা বহুলভাবে আলোচিত রয়েছে। (আল আনআম ফী আকছামিল কোরআন : মাওলানা হামিদ উদ-দীন)। শুধু তা-ই নয়, আরবের খৃস্টান কবিরাও সম্মানের সাথে হজের কথা তুলে ধরেছে। এমনকি আরবের বাজারসমূহে এবং মেলাসমূহের জমজমাট অবস্থা কায়েম রাখার জন্যই হজের মৌসুমটি ছিল একটি উত্তম সহায়ক। (কিতাবুল আমকিনাহ ওয়াল আজমানাহ : ইমাম মারকুজী পৃ. ১৬১) এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দাওয়াত ও তাবলীগ হিজরতের পূর্বেই আরবের দূর-দূরান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। এবং ইয়েমেন ও বাহরাইনে তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছিল। কেননা হজের মওসুমে আরবের সকল গোত্র মক্কা উপত্যকায় তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অনুষ্ঠানগুলো আদায় করার জন্য একত্রিত হতো। হযরত ইব্রাহীম (আ.) স্বীয় ছেলের কোরবানি সংক্রান্ত যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং ‘লাব্বায়েক’ বলে সম্মতি জানিয়েছিলেন, যার পরিপূরণের জন্য তিনি এই দূর-দারাজ স্থানে আগমন করেছিলেন। যখন তিনি পুত্রকে কোরবানি করার জন্য ছুরি চালাতে উদ্যত হলেন এবং প্রাণপ্রিয় পুত্রও আল্লাহর নির্দেশের সামনে স্বীয় মস্তক অবনত করেছিল, ঠিক তখনই ধ্বনিত হলো, “হে ইব্রাহীম (আ.)! তুমি স্বীয় স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ এবং এভাবেই আমি পুণ্যবানদেরকে বিনিময় প্রদান করি....। সুতরাং আমি একটি বৃহত্তর কোরবানির বিনিময়ে তার ছেলেকে বিমুক্ত করলাম”। (সূরা সাফফাত : রুকু-৩) ্এ ঘোষণার সাথে সাথে হযরত ইব্রাহীম (আ.) বুঝতে পারলেন যে, তার স্বপ্নের তাবীর হলো স্বীয় ছেলেকে আল্লাহর ঘরের খেদমতের জন্য এবং তাওহীদের প্রচার বুলন্দ করার জন্য সুনির্দিষ্ট করা। এবং এরই প্রেক্ষিতে “খানায়ে কা’বাকে” বিশ্বের বুকে আল্লাহর ইবাদতের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং সেই সময়কে স্মরণ কর যখন কা’বা গৃহকে মানব জাতির মিলন কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল করেছিলাম এবং বলেছিলাম, তোমরা ইব্রাহীম (আ.)-এর দাঁড়াবার স্থানকেই সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর। এবং ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ.)-কে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকুকারী ও সিজদাকারীদের জন্য আমার ঘরকে পবিত্র রাখতে আদেশ দিয়েছিলাম।”
স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম (আ.) বলেছিল, “হে আমার প্রতিপালক” একে নিরাপদ শহর কর, আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদেরকে ফলমূল হতে জীবিকা প্রদান কর।” তিনি বললেন, যে কেউ সত্য প্রত্যাখ্যান করবে তাকেও কিছুকালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দেব। তারপর তাকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করব এবং তা কত নিকৃষ্ট পরিণাম! “স্মরণ কর, যখন ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ.) কা’বা গৃহের প্রাচীর তুলছিল, তখন তারা বলেছিল, হে আমাদের প্রতিপালক। আমাদের এই কাজ গ্রহণ কর, নিশ্চয় তুমি সর্বজ্ঞাতা।” “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার একান্ত অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার এক অনুগত উম্মত কর; আমাদেরকে ইবাদত-বন্দেগির নিয়ম-পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হও। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” “হে আমাদের প্রতিপালক। তাদের মধ্য হতে তাদের নিকট এক রাসূল প্রেরণ কর, যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের নিকট আবৃত্তি করবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে, তুমি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” যে নিজেকে নির্বোধ করেছে সে ছাড়া ইব্রাহীম (আ.)-এর ধর্মাদর্শ হতে আর কে বিমুখ হবে? পৃথিবীতে তাকে আমি মনোনীত করেছি, আর পরকালেও সে সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর, সে বলেছিল, জগৎসমূহের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।” (সূরা বাকারাহ : রুকু-১৫-১৬) অন্য এক আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : “এবং স্মরণ কর, যখন আমি ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম সেই গৃহের স্থান, তখন বলেছিলাম, আমার সাথে কোন অংশী স্থির করো না এবং আমার গৃহকে পবিত্র রেখো, তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাতে দাঁড়ায় এবং রুকু করে ও সিজদাহ করে।” আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট পদব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটসমূহের পিঠে চড়ে আসবে। যাতে তারা তাদের কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু হতে যা রিযক হিসেবে দান করেছেন, এগুলোর উপর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে; তারপর তোমরা উহা হতে আহার কর এবং দুস্থ, অভাবগ্রস্তকে আহার করাও। তারপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাদের মানত পূর্ণ করে এবং প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে।
এটাই বিধান এবং কেউ আল্লাহ কর্র্তৃক নির্ধারিত পবিত্র অনুষ্ঠানগুলোর সম্মান করলে তার প্রতিপালকের নিকট তার জন্য ইহাই উত্তম।” (সূরা হজ : রুকুু-৪)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন