খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : রূপগঞ্জে হাট-বাজার ও পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠেছে দন্ত চিকিৎসার নামে ভুতুরে পরিবেশেই অপচিকিৎসা কেন্দ্র। আর এ অপচিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশিরভাগই দরিদ্র শ্রেণীর ও নি¤œ আয়ের লোকজন। ভেজাল ওষুধ ও ভুতুরে পরিবেশেই অতিরিক্ত ফি আদায় করে রোগীদের সাথে নিত্য প্রতারণা করে আসছে একটি অসাধুু মহল। তারা রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক না হলেও তাদের নামের পূর্বে লেখা হয়েছে ডাক্তার। এছাড়াও বানোয়াট পদ্ধতিতে সালসা নামক ভেজাল কেমিক্যাল মিশিয়ে নামেমাত্র লতাপাতার রসে হাতে তৈরি ওষুধ বিক্রি করছে ওষুধ বিক্রেতারা। এমনই চিত্র দেখা গেছে রূপগঞ্জের বিভিন্ন হাট-বাজারে ও পাড়া-মহল্লায় গড়ে ওঠা দোকানগুলোতে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার মুড়াপাড়া বাজার এলাকায় রয়েছে ইলিয়াস মেডিকেল হল নামে একটি দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্র। এ প্রতিষ্ঠানটির মালিক কথিত ডাক্তার ইলিয়াস ভুঁইয়া। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার দন্ত চিকিৎসা প্রদানে কোনো প্রকার সনদ নেই। তবু দোকানের সাইন বোর্ডে সাঁটিয়েছেন ডাক্তার ইলিয়াস ভুঁইয়া নামে। শুধু তাই নয়, ওষুধ বিক্রির সাথে সাথে দোকানে রয়েছে এলপি গ্যাসের বোতল। তিনি বোতল-গ্যাসের ব্যবসাও করেন। তার দোকানের অভ্যন্তরে রয়েছে ভুতুরে পরিবেশে দন্ত চিকিৎসা দানের অকেজো নানা যন্ত্রাদি। এর মধ্যে রয়েছে ময়লা ও আবর্জনাযুক্ত চেয়ার-টেবিল, তোয়ালে ও দাঁতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত পুরনো ও জংযুক্ত যন্ত্রাদি। একই দোকানে ভেজাল ও হাতে তৈরি ভুয়া পদ্ধতির সালসাও দেখা গেছে। এসব সালসা ৭০টি রোগ নিরাময়ে কাজ করে বলে লোভনীয় লিফলেট সাঁটানো হয়েছে দরজায়। এমন নানা অপচিকিৎসার কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে নিরীহ ও দরিদ্র শ্রেণির রোগী। স্থানীয় মুড়াপাড়া বাজার এলাকায় রয়েছে এমন আরো দুটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটির নেই রেজিস্ট্রার্ড ছাড়পত্র। অভিযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের কেবল নাম-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হতে নেয়া এলএমএএফ নামধারী সনদ। তথাপিও তাদের মাধ্যমেই দাঁতের চিকিৎসার নামে চলছে অপচিকিৎসা। প্রশিক্ষণহীন এসব ভুয়া ডাক্তারদের বেশভুষায় চেনা না গেলেও তাদের অপচিকিৎসার শিকার হয়ে হয়রানির শিকার হয়ে অনেক রোগীই তাদের মূল্যবান দাঁত হারিয়ে প্রতারিত হয়েছেন। এমনই একজন রোগী উপজেলার বানিয়াদির ২৪ বছরের গৃহিনী রুবিনা বেগম। তিনি জানান, গত মাসে তার দাঁতের তীব্র ব্যথা নিয়ে ইলিয়াস মেডিকেল হলে আসেন চিকিৎসা নিতে। ইলিয়াস তার দাঁত দেখে ফেলে দেয়ার পরামর্শ দেন। পরে তিনশত টাকার বিনিময়ে দাঁত ফেলে দিতে বাধ্য হয় সে। পরে অন্য একটি দাঁতের সমস্যা দেখা দিলে গাউছিয়া এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে রেজিস্ট্রার্ড দন্ত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তিনি। রোগী রুবিনার কাছে পূর্বেও দাঁত ফেলে দেয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাননি। তা নিয়ে রুবিনা বেগমের ক্ষোভের শেষ নেই। তবে হয়রানির ভয়ে বিষয়টি নিয়ে কারো কাছে অভিযোগ করেননি তিনি। মুড়াপড়া বাজার পরিচালনা কমিটি সূত্রে জানা যায়, ইলিয়াস মেডিকেল হলের অভ্যন্তরে ওষুধের আড়ালে সালসা বিক্রি ও ভুতুরে পরিবেশে অপচিকিৎসার দায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল ও জরিমানাও করেন। তথাপিও থামছে না এই অপচিকিৎসকের প্রতারণা। সূত্র আরো জানায়, বেশি মুনাফার আশায় ভেজাল সালসা তৈরির জন্য মধুখালী এলাকার প্রতারক কবিরাজ আমিন উদ্দিনের মাধ্যমে সপ্তাহে ২শ’ বোতল সালসা পাইকারিভাবে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে সরবরাহ করে ইলিয়াস মেডিকেল হল। এসব নানা অনিয়মের চিত্র হরহামেশাই ঘটে চলে। এ সময় বিষয়টি বাজার কর্তৃপক্ষ জানলেও প্রশাসনের চাপের মুখে দোকানটি বন্ধ করতে বলে। পরে বিশেষ কৌশলে ম্যানেজ করে ফের চালু রেখেছে তা। ফলে বন্ধ হচ্ছে না প্রতারক ইলিয়াসের অপচিকিৎসা। একই চিত্র দেখা গেছে রূপগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ভক্তবাড়ি এলাকায়। ছোট্ট একটি বাজারে রয়েছে ৫টি দাঁতের চিকিৎসা কেন্দ্র। এদের কারোই চিকিৎসা সনদ না থাকলেও তাদের নামের পূর্বে ডাক্তার উপাধি লেখা হয়েছে। এক সময় চা বিক্রি করত উপজেলার ব্রাহ্মণখালী এলাকার মোশারফ। এসএসসিও পাস করেছেন কোনোমতে। তবে এখন সে দাঁতের ডাক্তার! ভক্তবাড়ি বাজার এলাকায় চেম্বার খুলে চালিয়ে যাচ্ছে অপচিকিৎসা। তার কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও বাজার এলাকায় গড়ে তুলেছেন দাঁতের চিকিৎসা কেন্দ্র। তার নামের পূর্বেও লেখা রয়েছে ডাক্তার (!)। এছাড়াও কাঞ্চণ, বেলদী, হাটাব, ভুলতা, তারাব এলাকায় অর্ধশতাধিক দাঁতের চিকিৎসা কেন্দ্র খুলে সাধারণের সাথে প্রতারণা করে আসলেও প্রশাসনের নজরদারি নেই বললেই চলে। এমন অপচিকিৎসা চলতে থাকায় সচেতন মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে অভিযুক্ত অপচিকিৎসকরা দাবি করেন, তারা কেউ কেউ অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সহকারী ছিলেন, সেখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে খুলেছেন এই দাঁতের চিকিৎসা কেন্দ্র। মুড়াপাড়া ইলিয়াস মেডিকেল হলের ইলিয়াস ভুইয়া জানান, তার এলএমএএফ-এর উপর একটি প্রশিক্ষণ সনদ রয়েছে। তাই সে দাঁতের চিকিৎসা করাতে পারে। এতে কোনো বাধা নেই বলে দাবি তার। সালসা বিষয়ে মধুখালী এলাকার কবিরাজ আমিনউদ্দিনকে দায়ী করেন তিনি। এসব বিষয়ে মুড়াপাড়া বাজার কমিটির সভাপতি ও মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছ বলেন, বাজারে কে বৈধ আর অবৈধ তা শনাক্ত করবে স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন। তাদের মাধ্যমে ভুয়া প্রমাণিত হলে বাজারে এধরনের ব্যবসার অনুমোদন দেয়া হয় না। আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করব। এসব বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার জাইদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে অনুমোদনহীন এবং প্রয়োজনীয় সনদহীন কেউই নামের পূর্বে ডাক্তার উপাধি সংযুক্ত করতে পারবে না। করে থাকলেও তারা প্রতারক হিসেবে গণ্য হবেন। সাধারণ লোকজনের কাছে তিনি দাবি করেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ তাদের সেবায় বসে থাকেন। তারা যেন তাদের পরামর্শ নিয়ে শারীরিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার সমাধান করেন। এ সময় এসব অপচিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান তিনি। কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট ফারহানা ইসলামের সঙ্গে, তিনি জানান, এসব অপচিকিৎসক ও ভুয়া ডাক্তারদের বিষয়ে বেশকিছু তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের অনেককেই জেল জরিমানা করা হয়েছে। তারা এখনো নজরদারিতে রয়েছে বলে জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন