মো. ওমর ফারুক, ফেনী থেকে : ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতাল নামে আধুনিক হলেও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ডিজিটাল যুগেও আধুনিক হতে পারেনি, ফলে জেলার ১৬ লক্ষসহ মোট ৩২ থেকে ৩৫ লক্ষ লোকের আধুনিক চিকিৎসার কেন্দ্রস্থল এ হাসপাতালে রোগীদের কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না। প্রতিদিন ইনডোর ও আউটডোর বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে ফেনী ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলার বারইয়ারহাট, জোরারগঞ্জ, মিরসরাই, নোয়াখালী জেলার বসুরহাট, সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ, সেবারহাট, কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, খাগড়াছড়ির রামগড়, হেঁয়াকোসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ। এক পরিসংখানে দেখা গেছে, ফেনী জেলার সাথে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর বিভিন্ন এলাকার যাতায়াত সহজ হওয়ায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ এ হাসপাতালের চিকিৎসার উপর নির্ভরশীল। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি হলেও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শুক্রবার জরুরি বিভাগ ছাড়া অন্য সকল বিভাগ বন্ধ থাকে। ফলে শনি থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট ৬ দিন ইনডোরে ভর্তিকৃত ও আউটডোরে রোগী দেখতে হয় ডাক্তারদের। এজন্য সরকারের নির্দেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ডাক্তারদের ডিউটি নির্ধারণ করে দিয়েছে। ফলে এ দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে ফেনী সদর হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তাররা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সকাল ৮টার পরিবর্তে সকাল সাড়ে ৯টা, ১০টা, ১১টা আবার অনেকে ১২টার সময়ও কর্মস্থলে আসেন না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মেডিকেল অফিসাররা সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত আউটডোরে রোগী দেখতে হবে। অন্যদিকে সিনিয়র কনসাল্টটেন্ট ও জুনিয়র কনসালটেন্টরা সকাল ৮টায় অফিসে আসার পর ইনডোরে রোগী দেখার পর মেডিকেল অফিসারদের সুপারিশকৃত রোগীদের দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা ও পরামর্শ দিতে হবে। গত কয়েকদিন ধরে উক্ত প্রতিবেদক ফেনী সদর হাসপাতালে ডাক্তারদের উপস্থিতিসহ সার্বিক বিষয়ে অনুসন্ধান করে। এসময় দেখা যায়, বেশিরভাগ ডাক্তারই নির্ধারিত সময়ে হাসপাতালে আসেন না। মেডিকেল অফিসাররা নির্ধারিত সময়ে আউটডোরে না বসার কারণে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের সীমাহীন বেকায়দায় পড়তে হয়। এদিকে সকাল থেকে কাউন্টারে টিকিট বিক্রি না হওয়ায় দীর্ঘলাইন পড়ে যায়। ফলে বিপাকে পড়েন রোগীরা। আগে এলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকিটপ্রাপ্তির নিয়ম না মানায় চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। এদিকে টিকিটম্যান হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা টিকিটের মূল্য ৫ টাকার পরিবর্তে ১০/২০ টাকা নিয়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। আবার কাউন্টারম্যানদের হুমকি-ধামকি দুর্ব্যবহারে সঠিক সময়ে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন না চিকিৎসাসেবা প্রার্থীরা। এদিকে অনেক কষ্টে টিকিট সংগ্রহ করার পরও ডাক্তারের দেখা না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয় রোগীদের। এদিকে ডাক্তার ও কনসালটেন্টরা ব্যস্ত থাকেন বিলাস-ব্যাসনে আর সভা-সমাবেশে। রোগীরা দীর্ঘলাইন ধরে ডাক্তারের প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলেও ডাক্তাররা বিনা কারণে নো টেনশন ভাব নিয়ে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করতে দেখা গেছে। আবার অনেক ডাক্তারের দুর্ব্যবহারের কারণে তাদের কাছে যেতে ভয় পান রোগীরা। এমনি এক ডাক্তার হলেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. রাজিব বিশ্বাস। হাসপাতালে অবস্থানকালে তিনি রোগী দেখেন না বললেই চলে। তবে শহরের একটি ক্লিনিকে তার নামে রোগীর লাইন পড়ে যায়। কারণ প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে তিনি কোনো ত্রæটি রাখেন না। ফেনীর কাজিরবাগ গ্রামের আবদুল হালিম নামে এক ব্যক্তি জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে এক দালালের খপ্পরে পড়ে রাজিব বিশ্বাসের প্রাইভেট চেম্বারে যান। সামান্য সমস্যায় একবার ডাক্তার দেখাতে ৫/৬টি পরীক্ষা ছাড়াও তার খরচ হয়েছে ৭ হাজার টাকা। একই অবস্থা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সাজ্জাদ হোসেনেরও। তিনি জরুরি বিভাগের ডাক্তার হিসেবে ফেনী সদর হাসপাতালে যোগদানের পর থেকে এখানেই তার পদোন্নতি। অদৃশ্য ইশারায় অল্পসময়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পদোন্নাতি পান তিনি। দীর্ঘ ১ বছরেরও অধিক সময় ধরে আল্ট্রা ও এক্সরে মেশিন বিকল পড়ে আছে। ২৫০ শয্যার এ হাসপাতালে পুরনো আমলের একটিমাত্র আল্ট্রা মেশিন রয়েছে। প্রতি বছর এটি মেরামতের চাহিদা দেখিয়ে অর্থবরাদ্দ চাওয়া হয়। কিন্তু মেশিনটি মেরামতের কিছুদিন পর আবার পূর্বের অবস্থায় চলে যায়। পুরনো মডেলের ৪টি সাদাকালো এক্সরে মেশিনের মধ্যে ৩টি বিকল বলে জানা গেছে। বর্তমানে ১টি মেশিনে এক্সরে চালু থাকলেও ডাক্তাররা সেটির কথা বলেন না। ফলে বিনা পয়সায় নিতান্ত সহায়-সম্বলহীন রোগীরা ছাড়া অন্য কেউ এখানে এক্সরে করাতে আসে না। হাসপাতালের প্রবেশ গেইট সংলগ্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বিলবোর্ড লাগিয়েছে ফেনী ল্যাব নামে একটি ক্লিনিক। জানা গেছে, সদর হাসপাতালের ডাক্তার থেকে শুরু করে নার্স, হিসাবরক্ষক, ক্লিনার, আয়া, সুইপার পর্যন্ত সকলেই ফেনী ল্যাবের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লিনিকের কমিশন এজেন্ট। এক্সরে রিপোর্টের সরকার নির্ধারিত মূল্য ৭০ টাকা হলেও ফেনী ল্যাবে রাখা হচ্ছে সাড়ে ৩শ’ টাকা করে। স্বামীর নির্যাতনে হাত ভাঙ্গা রিনা নামের এক মহিলা ফেনী ল্যাবে এক্সরে করালে তার রিক্সাচালক বৃদ্ধ বাবা বহু কষ্টে মোটা আংকের বিল পরিশোধ করেন। ফেনী সদর হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে সিজারিয়ান অপারেশনের পর কন্যাসন্তান প্রসব করেন পারভিন ও তাছলিমা আক্তার। তারা দুজনই জানান, হাসপাতালে আসার পর থেকে দালালরা বহু চেষ্টা-তদবির করেছে প্রাইভেট হাসপাতালে নেয়ার জন্য। বাইরের দালালতো আছেই, হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার, নার্স গাইনি এবং জরুরি বিভাগের কর্মচাররাও দালালির সাথে জড়িত। একটি সিজারিয়ান মহিলাকে প্রাইভেট হাসপাতালে নিলে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা কমিশন পায় দালালরা। গাইনি বিভাগের সিজারিয়ান দুই মহিলা জানান, হাসপাতাল মোড়ে আইসিএসটির নিচে গড়ে ওঠা অবৈধ ফার্মেসিগুলোর দালাল ও মালিকেরা রোগী ধরার ফাঁদ পেতে বসে থাকে। দূর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের পরম আত্মীয় সেজে বাজার মূল্যের চাইতে কয়েকগুণ বেশি মূল্যে ওষুধ বিক্রি করে। ২৫০ শয্যার ফেনী আধুনিক সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার ও নার্সসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো শূন্য থাকায় প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। হাসপাতালের পক্ষ থেকে বার বার মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র প্রেরণ করা হলেও অদ্যাবধি শূন্য পদগুলো পূরণে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে হাসপাতালটিতে সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৬ জন, ফলে বাকি ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে প্রসূতি মহিলারা চিকিৎসা নিতে আসে এখানে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অজ্ঞান করার ডাক্তার না থাকায় কোনো প্রসূতিকে সিজার করার প্রয়োজন দেখা দিলে ফেনী সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। গাইনি কনসালটেন্ট পদে ডাক্তার শংকর কুমার বসাক বদলি হওয়ার ৭ মাস অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি এ পদে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে বাধ্য হয়ে কম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ডাক্তার দিয়ে সিজারিয়ান অপারেশন করানো হচ্ছে। এতে প্রতি মুহূর্তে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে প্রসূতি আর নবজাতককে। এদিকে জুনিয়র কনসালটেন্ট পদে ১১ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৭ জন। ফলে বাকি ৪টি পদ শূন্য রয়েছে। রেডিওলজির জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার কাজী আলম বদলি হওয়ার পর ঐ পদে আর কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এছাড়া প্যাথলজির জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাক্তার জামান আহমদ বদলি হলেও অদ্যাবধি পদটি শূন্য রয়েছে। প্যাথলজির মতো গুরুত্বপূূর্ণ পদে কনসালটেন্ট না থাকায় জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো বিঘিœত হচ্ছে। এদিকে সিনিয়র কনসালটেন্ট পদে বিষয় ছাড়া ১টি, ডেন্টালে ১টি, চক্ষু বিভাগে ১টি, জুনিয়র কনসালটেন্ট রেডিওলজি, গাইনি, প্যাথলজি ও চক্ষু বিভাগে ১টি করে পদ খালি রয়েছে। এছাড়া মেডিকেল অফিসার ও সমমানের মোট ২৬টি পদের মধ্যে ১৫টি পদে ডাক্তার রয়েছে। ফলে বাকি ১১টি পদ শূন্য রয়েছে। জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার পদে ৭ জনের মধ্যে ৩ জন কর্মরত থাকলেও বাকি ৪টি পদ শূন্য রয়েছে। নার্সিং কর্মকর্তার অনুমোদিত ৮২ পদের মধ্যে ৫৬ পদে কর্মরত থাকলেও ২৬ পদ শূন্য রয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর-কর্মচারী পদে ৩৯ পদের বিপরীতে ২০ জন কর্মরত থাকলেও ১৯ পদ শূন্য রয়েছে। চতুর্থ শ্রেণীর ৭৩টি পদের মধ্যে ২৯ পদে নিয়োগ থাকলেও ৪৬টি পদ শূন্য রয়েছে। জানতে চাইলে ফেনী সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. অসীম কুমার সাহা বলেন, পর্যাপ্ত ডাক্তার ও নার্স না থাকায় কর্তৃপক্ষের প্রচুর আন্তরিকতা থাকলেও প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ফেনী জেলা সিভিল সার্জন ও সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত¡¡াবধায়ক হাসান শাহরিয়ার কবির জানান, ইতোমধ্যে শূন্য পদগুলোতে নিয়োগের জন্য বেশ কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধানের চেষ্টা করছেন বলে নিশ্চিত করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন