হুমকির মুখে মুহুরী সেচ প্রকল্প : ৪০ হাজার হেক্টর জমির আবাদ ব্যাহত
মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন (ছাগলনাইয়া ফেনী) : ৩০ বছরের গঙ্গা চুক্তির ২০ বছরেও প্রয়োজনীয় পানি দেয়নি ভারত। দু’দেশের অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ভাগবাটোয়ারা এখনো মীমাংসা হয়নি। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিরোধের বাহানায় দীর্ঘদিন থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে তিস্তা চুক্তি। উপরন্তু গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গে সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের সামনে তিস্তা চুক্তির ‘মুলো’ শুধু ঝুলিয়ে রাখেনি; বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ফেনী নদীর পানি গোপনে তুলে নিচ্ছে। বাংলাদেশের নিজস্ব নদী ফেনীর পানি ভাগাভাগির জন্য ভারত সরকার পানি চুক্তি করার চাপ দিচ্ছে। পাউবোর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী খ. ম জুলফিকার তারেক বলেন, কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়া ভারত অন্যায়ভাবে এত বছর ফেনী নদী থেকে পাম্প বসিয়ে পানি নিয়ে গেছে। এখন তারা চুক্তি করতে চায়। অবৈধভাবে পানি তুলে নেয়ার প্রতিবাদে এবারও চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি সমাধান হতে ঢাকা-দিল্লি বৈঠক ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চলের মহুকুমা সাব্রুমের ১৭টি পয়েন্টে ২৬টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প বসিয়ে ফেনী নদী থেকে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড়ে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে বসানো ২৬ পাম্প দিয়ে ভারত পানি তুলে নিলেও বাংলাদেশের প্রতিবাদ প্রতিরোধ কোনো কিছুই কর্ণপাত করছে না।
ফেনী নদীর পানি অবৈধভাবে তুলে নেয়ায় ফেনী জেলা ও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সেচ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাজার হাজার কৃষক। ফেনী নদীর মোহনায় বাঁধ দিয়ে মুহুরী প্রকল্পের মাধ্যমে সেচের জন্য ফেনী নদীতে পানি সঞ্চয় করে রাখছে বাংলাদেশ। সেখান থেকেই ভারত জোর খাটিয়ে অবৈধভাবে পানি উত্তোলন করছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার প্রতিবাদ করার সত্তে¡ও ভারত সরকার কোনো কর্ণপাত করছে না।
বাংলাদেশের নিজস্ব ফেনী নদীতে শুল্ক মৌসুমে সর্বোচ্চ ২৫০ কিউসেক পানি থাকে। তা থেকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সরকার গোপনে নোম্যান্সল্যান্ড মাটির নিচে নদী তীরে পাম্প বসিয়ে একশ’ কিউসেক পানি গোপনে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পানি নেয়ার জন্য তারা নদীর তীরে পাকা স্থাপনা ও টিনের বেড়া দিয়ে ২৬টি পাম্প বসিয়েছে। এসব পাম্প মেশিনে ৬ থেকে ৮ ইঞ্চি সিআই পাইপ লাগানো হয়েছে। এসব মেশিন দিয়ে গোপনে নদী থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে যা আন্তর্জাতিক নদীর পানি বন্টন নীতির চরম লঙ্ঘন। এর আগে ২০১২ সালের দিকে বাংলাদেশের তরফ থেকে পানি উত্তোলনের বিষয়ে বিরোধিতা করা হলে তা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। পরে গোপনে আবার পানি উত্তোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি রামগড় সীমান্তের ওপারে সাব্রুমে অনুষ্ঠিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) যৌথ বৈঠকে নতুন করে ফেনী নদীর পানি তুলে নেয়ার ইস্যুটি সামনে আসে। এই বৈঠকে নোম্যান্সল্যান্ড ভারতের অবৈধভাবে বসানো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ চালিত পাম্প মেশিন তুলে নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিএসএফকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বিজিবি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত ভারতের কোনো জবাব দেয়নি। বৈঠক শেষে দেশে ফিরে লে. কর্নেল এম. জাহিদুল রশীদ সাংবাদিকদের জানান, ভারত ফেনী নদী থেকে ২৬টি পাম্প মেশিনের মাধ্যমে দৈনিক এক শতাধিক কিউসেক পানি নিতে চায়। এখন বাংলাদেশের সাথে চুক্তির মাধ্যমে আরও ১৮২ কিউসেক পানি নিতে চায়। সাব্রæম মহকুমার বাসিন্দাদের পানির চাহিদা মেটাতে তারা ফেনী নদীর পানি নেয়ার এ দাবি করছে। ভরা বর্ষা ছাড়া বছরের বাকি ১০ মাস পানি উত্তোলন হয়। একতরফাভাবে পানি তুলে নেয়ার ফলে শুল্ক মওসুমে ফেনী নদী শুকিয়ে ধূ ধূ বালুচরে পরিণত হয়। এদিকে মৃতপ্রায় এ নদী থেকে ভারত চুক্তির মাধ্যমে আরো ১৮২ কিউসেক পানি তুলে নেয়ার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাম্প মেশিনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভারতের পানি উত্তোলন বন্ধ করার পর ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে পানিবন্টন চুক্তি করতে কোনো আপত্তি নেই। ফেনী নদীর তীরবর্তী জগন্নাথ সোনাপুরের বাসিন্দা আবুল হোসেন জানান, ফেনী নদী উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশ। এ নদীর পানি ভারতকে দেয়ার জন্য চুক্তি কিসের?
১৯৭৪ সালে সম্পাদিত মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে দুই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ফেনী নদীর নাম নেই। পাউবোর চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী খ. ম জুলফিকার তারেক বলেন, কোনো প্রকার চুক্তি ছাড়া ভারত অন্যায়ভাবে এত বছর ফেনী নদী থেকে পাম্প বসিয়ে পানি নিয়ে গেছে। এবারও চিঠি দিয়েছি। বিষয়টি সমাধান হতে ঢাকা-দিল্লি বৈঠক ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমরা বার বার নিষেধ করছি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, এর উৎপত্তি মাটিরাঙ্গার ভগবানটিলায়। নদীর ১০৮ কিলোমিটার কোনো অংশই ভারতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেনি। জানা গেছে, ১৯৬৫ সালে প্রস্তাবিত এবং আশির দশকে স্থাপিত মুহুরী সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি প্রধান ফেনীর ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী, পরশুরাম, ফেনী সদর ও চট্টগ্রাম মিরসরাই উপজেলার ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে শুল্ক মৌসুমে ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে দেশের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম মুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। বছর বছর বোরো আবাদ কমার ধারায় চলতি মৌসুমে বোরো আবাদ অর্ধেকের চেয়ে বেশি কমে গেছে বলে জানা গেছে। সার, ওষুধ, তেল, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে বোরো আবাদ করে লোকসান শুনছেন মুহুরী সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকরা। চলতি মৌসুমে ডিজেলচালিত পাম্প একর প্রতি ৪৫০০ টাকা পানি খরচ এবং বিদ্যুৎচালিত পাম্পের পানি ব্যবহারের জন্য ৩ হাজার ৫শ’ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে। সূত্র আরো জানায়, বোরোর পরিবর্তে কয়েকশ’ হেক্টর জমির কৃষকরা সরিষা, ফেলন, খেসারি, মুসুরিডালসহ শীতকালীন শাক-সবজি লাগানো হয়েছে বলে জানায় তারা। অপরদিকে প্রান্তিক কৃষক মাটি ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। কৃষি কর্মকর্তারা সেচ কমিটির সঙ্গে বোরো লাগানোর ব্যাপারে বৈঠক করে উদ্বুদ্ধ করলেও তেমন সাড়া মিলছে না বোরো আবাদে। বোরো আবাদ কমে যাওয়ার বিষয় জানতে চাইলে ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নে দক্ষিণ হরিপুর স্কিম ম্যানেজার সফিকুর রহমান, ফুলগাজী উপজেলার শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামের কৃষক মোঃ ইদ্রিস মিয়া (৭৫), প্রান্তিক কৃষক আব্দুল হাই ও শরিয়ত উল্যাহ জানান, খরচের চেয়ে ধানের দাম কম হওয়ায় লোকসানের ভয়ে ইরি-বোরো লাগাতে তারা আগ্রহী হচ্ছেন না। ছাগলনাইয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ গোলাম রায়হান দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, বোরো উৎপাদনে কৃষকরা নানাবিদ সমস্যায় ভুগছেন, তবে কৃষকদের বোরো আবাদে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অধিকাংশ জমিতে ইরি বোরো চাষ হচ্ছে না, এটি সঠিক নয়। কিছু জমিতে ইরি বোরো চাষ হয় না এটা স্বাভাবিক। এ অঞ্চলের ৯০ ভাগ জমির মালিক নিজেরা ফসল উৎপাদন করেন না। বেশিরভাগই বর্গা চাষি। যার ফলে উৎপাদন খরচ বেশি হয়। সরকার চাষীদের ইরি-বোরো আবাদ ছাড়াও আউশ ধান আবাদের প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহিত করছে। কৃষি সম্পসারণ বিভাগের ফেনী শাখার উপ-পরিচালক ড. মোঃ খালেদ কামাল দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, এ বছর ইরি-বোরো চাষের লক্ষমাত্রা টার্গেটের চেয়ে বেশি হবে। ফেনী জেলায় ইরি-বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার হেক্টর জমি ছাড়িয়ে যাবে। ইতিমধ্যে প্রায় ২২-২৩ হাজার হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষ আবাদ হয়েছে। সচেতন মহল মনে করেন, বছর বছর মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় ইরি-বোরো আবাদ কমে যাওয়ায় এক সময়ের কৃষি প্রধান ফেনীতে খাদ্য উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমবে, উৎপাদনের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের লক্ষ্য নিয়ে ফেনী অঞ্চলে মুহুরী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের গুরুত্ব হারাবে। অপরদিকে সোনাগাজী উপজেলার ছোট ফেনী নদীর সংযোগস্থল গজারিয়া খালের সাথে তৈরি করা স্লইস গেইটটি মাটিতে দেবে গিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে। ছোট ফেনী নদীর চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদী থেকে শুরু হয়ে নোয়াখালীর স›দ্বীপ চ্যানেল বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। ছোট ফেনী নদীর ফেনীর অংশে কুমিল্লার গুণবতী ব্রিজ থেকে স›দ্বীপ চ্যানেল পর্যন্ত ৬০ কি. মি. নদী এই নদীর সাথে ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার ১ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর চাষাবাদ উপযোগী জমি রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কুঠির হাটসংলগ্ন ছোট নদীর সাথে গজারিয়া খালের সংযোগস্থলে কুঠিরহাট ¯øুইস গেইটের দু’পাশ থেকে পানির কম্পনে মাটি দেবে গেছে। এছাড়া গেইটের উত্তর পাশ নিচের দিকে ও ঢালাই করা ¯েøভ ওয়াল টেকসই কমে গেছে। যার ফলে পানির আঘাতে ইট ও কংক্রিট ওঠে গেছে। স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ১৯৮২ সালে ছোট নদীর সাথে সাগরের পানি না ঢুকতে গজারিয়া খালের মুখে একটি সুইস গেইট নির্মাণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর, বগাদানা, মঙ্গলকান্দি ইউনিয়ন ফেনী সদরের ধলিয়া, লেমুয়া ইউনিয়নসহ আশপাশের হাজার কৃষক এ খালের পানি দিয়ে ইরিসহ সব ধরনের ফসল উৎপাদন করা সহজ হয়। যার ফলে কৃষকরা তাদের চাহিদামত উৎপাদন করে লাভবান হতো। বর্তমানে এ স্লইস গেইটটি হুমকির মুখে পড়ায় স্থানীয় কৃষকরা হতাশা হয়ে পড়ে। স্থানীয় চরমজলিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ হোসেন জানান, কাজিরহাট স্লইস গেইট যখন সচল ছিল, তখনকার সময় ফেনী, সোনাগাজী, দাগনভূঞা ও কোম্পানীগঞ্জ এলাকার হাজার হাজার কৃষক এ নদীর পানি দিয়ে ইরিসহ সকল প্রকার ফসল চাষাবাদ করেছে। কাজিরহাট স্লইস গেইট ভেঙে যাওয়ার নদীতে লোনা পানি প্রবেশের কারণে এ অঞ্চলে সব ধরনের ফসলের উৎপাদন বন্ধ ছিল। বর্তমান মুছাপুরে স্লইস গেইট তৈরি হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা নতুন করে স্বপ্ন দেখছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন