মাওলানা মুহাম্মদ রেজাউল করিম : গোটা উনিশ শতক ধরে উপমহাদেশের অগণিত মানব সন্তানের ভাগ্য বহু বিচিত্র ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন ও আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যদিয়ে চলেছে। কিন্তু এ শতকেই বহু প্রতিভাদীপ্ত মনীষী এ উপ মহাদেশে জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহর জীবন ধারাকে নানাভাবে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাদের মধ্যে ড. আল্লামা ইকবাল (রহ.) অন্যতম। তিনি স্বীয় বিপ্লবাত্মক শিক্ষা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি, অভ্রান্ত নেতৃত্ব, নির্মল চরিত্র, ক্ষুরধার লিখনী, মেধা-মনন, চিন্তার গভীরতা, প্রজ্ঞা ও কর্ম বলে মানুষকে সত্য, সুন্দর, সুচিময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের প্রতি আহŸান জানান। তার এ আহŸান গোটা মুসলিম উম্মাহর জড়তা ও হীনম্মন্যতা দূর করে তাদের ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা জোগায়।
মুহাম্মদ ইকবাল ১৮৭৩ সালের ২২ ফেব্রæয়ারি শিয়ালকোটে জন্ম গ্রহণ করেন। ইকবালের পিতা নুর মোহাম্মদ একজন ধর্মনিষ্ট সূফী ও মাতা বিদূষী রমণী ছিলেন। এ মহান মনীষী ১৯৩৮ সালে মাওলায়ে হাকীকীর ডাকে সাড়া দেন।
আল্লামা ইকবাল (রহ.) প্রথমে মাদরাসায় ও পরে স্থানীয় মিশন স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধ আলেম মীর হাসান বালক ইকবালের মানসকে ইসলামি শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছিলেন। শিয়ালকোট থেকে ইকবাল লাহোরের সরকারি কলেজে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ এবং ১৮৯৯ সালে দর্শনে এম, এ ডিগ্রী লাভ করেন। ইকবাল জামার্নীর মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি এবং লন্ডন থেকে ব্যারিষ্টারি পাস করেন।
কর্মজীবনে তিনি লাহোরের ওরিয়েন্টাল কলেজ ও পরে সরকারি কলেজে প্রথমে ৬ বছর এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি ভাষায় অধ্যাপনা করেন।
ড. আল্লামা ইকবাল (রহ.) বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি আছরারে খুদী, রমুজে বেখুদী, পায়ামে মাশরিক, বাঙইদারা, যরবে কালীম, শেকওয়া-যাওয়াবে শেকওয়া, বালে জিব্রিল ও কুল্লিয়াতে ইকবালসহ অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন।
ইকবালের দর্শনের মূল কথা হলো ‘খুদী’ বা ঝবষভ অথবা ঊমড় তথা আত্মা। ইকবালের ‘খুদী’ অমর ও অবিনশ্বর। ইকবালের মতে, ‘খুদী’র বিলুপ্তি ইসলামের পরিপন্থি। ইকবাল বলেন, অতীন্দ্রিয় অনুুভ‚তির (কাশফ) মাধ্যমে আমরা খুদীকে সরাসরি জানতে পারি। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বিরাট কাজ ও গভীর অনুভ‚তির সময়ে খুদীর অস্থিত্ব প্রত্যক্ষ করা যায়। আমাদের সকল ক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেই খুদীর প্রকাশ। আমাদের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, বিচার, বিবেচনা সিদ্ধান্তের মধ্যে খুদীই ক্রিয়াশীল। খুদীকে কোন মাধ্যম ছাড়া আমরা সরাসরি প্রত্যক্ষ করি। খুদী স্বীয় ক্রিয়াবলীর মাধ্যমে নিজের মূল্যায়ন করে। কাজেই খুদীর স্বরূপ হলো মূল্যায়নমূলক। অর্জন ছাড়া মূল্যায়ন নেই, আর লক্ষ্য ছাড়া অর্জন নেই। কাজেই খুদী বা আত্মা সবসময় কোন একটা দিকে অগ্রসর। খুদী ইচ্ছা বা আত্মা প্রেমের মাধ্যমে বলীয়ান হয়। প্রেম ইচ্ছাকে শক্তিদান ও খুদীকে সুরক্ষিত করে। এ জন্যই বলা হয়, ঞযব ঊমড় রং ভড়ৎঃরভরবফ নু ষড়াব ধহফ ওংয়য.বস্তুত, মূল্য ও আদর্শের সৃষ্টি এবং রূপায়ন প্রয়াস খুদীর সর্বোচ্চ রূপ। খুদী কেবল স্বাধীন নয় বরং অবিনশ্বরও বটে। কিন্তু খুদীর এ অবিনশ্বরতা অর্জন স্বাপেক্ষ। নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ অমরতা অর্জন সম্ভব। ইকবাল বলেন, ‘অমরতা আমাদের অধিকার নয়; ব্যক্তিগত চেষ্টার দ্বারা একে অর্জন করতে হয়।’ যেমন তিনি বলেন, ‘মানুষ আল্লাহর খলীফা’। খুদীর পূর্ণ বিকাশের মাধ্যমেই মানুষ ইনসানে কামেল বা পূর্ণ মানুষ হয়ে খেলাফতের এ অসীম গুরুত্ববহ দায়িত্ব পালন করতে পারে।
ইকবালের লিখনীতে আগাগোড়া পাঠক ও শ্রোতাকে লক্ষ্য অর্জনে সদা সচেষ্ট, পরিশ্রমী ও কর্মমুখর রাখার প্রেরণায় পরিপূর্ণ। তিনি মুসলমানদের কথায় পটু হবার চেয়ে কাজে পটু হতেই অধিক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তার ‘খুদী’ দর্শন তথা দুর্জয় মনোবলের দ্বারা আত্মশক্তি ও ব্যক্তিত্বকে বলীয়ান করার মধ্যদিয়ে তিনি মানুষকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করার আহŸান জানিয়েছেন। তিনি মানুষকে এ দর্শনের মাধ্যমে এটাই বুঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষ যেন নিজের সুপ্ত প্রতিভার ব্যাপারে সচেতন হয় এবং একে জাগ্রত করে আপন সকল সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়। নিজের পরিচয় নিজের কাছে স্পষ্ট থাকার প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রতিটি মানুষের মধ্যে যেসব যোগ্যতা ও সম্ভাবনা রয়েছে, আল্লামা ইকবালের মতে সে সকল যোগ্যতা ও সম্ভাবনাকে নিজ নিজ চরিত্রে প্রোজ্জ্বল করে তুলতে হবে। নিজ ‘খুদী’ (আত্মা) ও ব্যক্তিত্বকে জ্ঞান, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা দ্বারা এ পরিমাণ উন্নত করতে হবে যে, আল্লাহ যেন তার বান্দার যাবতীয় যোগ্যতা, গুণ-বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করেন, ‘বলো বান্দা তুমি কী পেলে খুশী হও?’ আল্লামা ইকবাল বলেন,
আমল সে যিন্দেগী বনতী হায় জান্নাত ভী জাহান্নামভী
ইয়েহ্ খাকী আপনি ফিৎরৎ মে
না নূরী হায়, না নারী।
দার্শনিক ও চিন্তানায়ক ইকবাল জাতির পতনোন্মুখ অবস্থা লক্ষ করে প্রথম তাদের আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে ব্রতী হন। জীবনের প্রতি আস্তাহীন, হতাশাগ্রস্ত জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করার জন্য তিনি প্রথমেই শক্তিহীন ও কর্মহীনরূপে সৃষ্টিকারী সূফীবাদের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। কারণ এরূপ সূফীবাদকে তিনি কুরআনে বর্ণিত জিহাদ, কর্মতৎপরতা, ভাগ্যান্বেষণ ও সৃষ্টিশীলতার মূলদর্শন বিরোধী মনে করতেন। তিনি তকদীরবাদেরও নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইউরোপে অবস্থানকালে ইকবাল ‘আধ্যাত্ম দর্শনের ক্রমবিকাশ’ ও মুসলিম সূফীবাদের উপর গবেষণা করেন। তাতে তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, ইসলাম আরবের সীমান্ত অতিক্রম করে যখন অনাবর এলাকায় বিস্তার লাভ করে, তখনই প্রকৃত ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসে অনেক অনৈসলামিক ভাবধারার অনুপ্রবেশ ঘটে এবং কুরআন সুন্নাহর মূল লক্ষ্যের বাইরে মুসলমানরা একপ্রকার ‘সূফীবাদ’ তথা মায়াবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। যার ফলে মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত সূফীবাদের স্থলে কুরআন ও সুন্নাহতে নিন্দিত ‘রোহবানিয়াত’ (সংসার ত্যাগের) ভাবধারার জন্ম নেয়। মুসলমানরা কালের প্রবাহের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়ে জীবন বিমুখ সূফীবাদের আশ্রয় নেয়। তারা কাজ করে এবং কিছু না পেয়েও মানসিক সান্ত¦না লাভের পন্থা তালাশ করে। তাদের কথা হলো জীবন ক্ষণস্থায়ী। আল্লাহ ছাড়া সবকিছু মায়া। চেষ্টা-তদবীর করে কোন লাভ নেই। তকদীরে যা লিখা তা-ই হবে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো। আল্লামা ইকবালের মতে, ‘কর্মহীন এহেন তাওয়াক্কুল কুরআনে বর্ণিত তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি। তাই তিনি ঘোষণা করলেন,
খুদী কো কার বুলান্দ ইৎনা কেহ হার
তকদীর সে পহ্লে
খোদা বন্দে সে খোদ্ পূঁছে-বাতা তেরী
রেযা কেয়া হ্যায়।
‘তুমি আপন আত্মা ও ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে সুদৃঢ় করে তোলো, যেন আল্লাহ তকদীর সৃষ্টির পূর্বেই নিজে তোমাকে জিজ্ঞেস করেন, বলো বান্দা, তাকদীর কী রকম হলে তুমি খুশী হও?’ ইকবাল সূফীদের সংসার বিমুখিতা এবং মায়াবাদের বিরুদ্ধে এক বিরাট অভিযান চালিয়ে গেছেন। জীবন ও জগতের রহস্য বুঝাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, বস্তু জগত মায়া নয়; এটা বাস্তব। মানুষের উন্নত ব্যক্তিত্ব (খুদী) বা আত্মা সকল লয়ের ঊর্ধ্বে। উন্নত আত্মা স্থায়িত্বের অধিকারী। ইহ জগত থেকে এর প্রস্থান সাময়িক। আত্মিক শক্তিকে কর্মের দ্বারা যে যত বেশি শক্তিশালী করবে, সে ইহ ও পরকালে ততোধিক মর্যাদার অধিকারী হবে। ইকবালের মতে, ‘জীবন মরণের সংজ্ঞা আলাদা। প্রাণ থাকলেই জীবন হয় না। প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে প্রাণ বিসর্জন করাই প্রকৃত জীবন। মানবতার জাগরণে ইকবালের তাকদীর সংক্রান্ত ব্যাখ্যার বিরাট অবদান রয়েছে। ‘তাকদীর পূর্ব থেকেই আল্লাহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত আল্লামা ইকবাল তা সরাসরি স্বীকার করেন না। এ অজুহাতে দুর্বলমনা লোকেরা কষ্ট পরিশ্রম এবং বিপদ আপদের ঝুঁকি হতে অব্যাহতি পেতে চায়। তিনি এ ধারণা পরিবর্তনকল্পে তাকদীর সম্পর্কে যা বলেন, ‘তা হলো, মানুষের কাছে যদি কোন তাকদীর পছন্দনীয় না হয় সে আল্লাহর কাছ থেকে অন্য তাকদীর বেছে নিতে পারে। কারণ আল্লাহর কাছে রয়েছে অসংখ্য তাকদীর। ‘তাদবীর সে তাকদীর টলতী হ্যায়’- কর্ম ও চেষ্টা- পরিশ্রমের পর তাওয়াক্কুল করার মধ্যদিয়ে তাকদীর পরিবর্তন হয়।
আল্লামা ইকবালের কথার তাৎপর্য এটাই। ইকবালের মতে, মুমিন কোনো সময় তাকদীরের অধীন নয়। বৃক্ষলতা, জড় বস্তুই তাকদীরে অনুগত। মুমিনের কর্ম ও ইচ্ছা অনুসারেই আল্লাহ তার তাকদীর সৃষ্টি করেন বা নির্ধারিত করেন। ইকবালের কথা হলো, তাকদীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ অর্থহীন। তুমি নিজেই কর্মের পর তাওয়াক্কুলের দ্বারা তাকদীর রচয়িতা হলে না কেন? এমনিভাবে তিনি তাকদীরের প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে নিজের ক্ষুরধার লিখনী চালিয়ে মুসলিম পুনর্জাগরণে সচেষ্ট ছিলেন।
মুসলিম জাতি ও এর চিন্তা শক্তিকে দুর্বলকারী আরও বহু প্রচলিত ধারণাকে আল্লামা ইকবাল খÐন করে এ শক্তিকে বলবীর্যে ও আধ্যাত্মিক শক্তিতে দুর্জয় মনের অধিকারী করতে চেয়েছেন। ইসলামের এই মহান সংস্কারক প্রকৃত সূফীবাদ যাকে কুরআনের পরিভাষায় ‘তাসকিয়া-এ নাফ্স’ বলা হয়- তাকে অস্বীকার করেননি। অবশ্য, তার সূফীদর্শন ফানাফিল্লাহ তথা আত্মাকে আল্লাহর মাঝে বিলীন করা নয়; আত্মাকে উন্নত করে আল্লাহকে তার মধ্যে স্থাপনেরই শিক্ষা দেয়।
ষ লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া,
ষোলশহর, চট্টগ্রাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন