বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

এমপি লিটন হত্যার নেপথ্যে ডা. কাদের

প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুরের ডিআইজি

| প্রকাশের সময় : ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১০ দিনের রিমান্ডে
গাইবান্ধা জেলা ও সুন্দরগঞ্জ সংবাদদাতা : গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থ যোগানদাতা সুন্দরগঞ্জের সাবেক এমপি কর্নেল জাপা (এ) নেতা (অব.) ডা. আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় বগুড়া শহরের রহমান নগর জিলাদারপাড়ার নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে রাতে গাইবান্ধায় নিয়ে আসা হয়। এছাড়া মঙ্গলবার সকালে গাইবান্ধা শহরের ব্রিজ রোড এলাকা থেকে তিন খুনি কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর সমস কবিরাজপাড়া গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২), উত্তর সমস বেকাটারি গ্রামের ওসমান গণির ছেলে শাহীন (২৩) এবং কাদের খানের গাড়ি চালক বগুড়ার শাহজাহানপুর থানার কামারপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে হান্নানকে (২৭) গ্রেফতার করা হয়। অপর খুনি রানাকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে সক্ষম না হলেও শীঘ্রই সে ধরা পড়বে বলে জানানো হয়েছে।
বুধবার সকালে গাইবান্ধা পুলিশ সুপার কার্যালয় চত্বরে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এসময় রংপুর রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি বশির আহমেদ, গাইবান্ধা পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম, এডিশনাল এসপি (এ সার্কেল) রবিউল ইসলাম, এডিশনাল এসপি (হেড কোয়ার্টার) খায়রুল আলম, সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান, গাইবান্ধা থানার অফিসার ইনচার্জ একেএম মেহেদী হাসান ও মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু হায়দার মোঃ আশরাফুল ইসলামসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া প্রেস ব্রিফিংয়ে এমপি লিটন হত্যা মামলার বাদী তার বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী, লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি এবং পরিবারের অন্যান্য লোকজন, গাইবান্ধা পৌরসভার মেয়র অ্যাড. শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলনসহ জেলা আওয়ামী লীগ, অন্যান্য দল নেতৃবৃন্দ ও জেলা কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়
প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি জানান, পুলিশ ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে এক মাস ২০ দিনের তদন্ত শেষে ২১ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) চাঞ্চল্যকর এই লিটন হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। এমপি লিটনকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় ওই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার মোহেই সাবেক এমপি কাদের খান এক বছর আগে থেকেই এই হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি তার ঘনিষ্ঠ ৪ সহচর মেহেদী হাসান, শাহীন, হান্নান ও রানাকে প্রলুব্ধ করে এবং নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাদের ৬ মাসব্যাপী নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। তার ছক অনুযায়ী ইতোপূর্বে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আসার পথে এমপি লিটনকে গত অক্টোবর মাসে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা ব্যর্থ হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী রাস্তায় প্রথমে তার গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এতে গাড়ি থামিয়ে লিটন বের হয়ে আসা মাত্রই গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে ওই কিলাররা। কিন্তু সে মিশনও ব্যর্থ হয়।

লিটন হত্যা মিশন
সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হয়। লিটন হত্যা মিশনে ৩ জন অংশ নেয়। তারা হলো- মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নান। এরমধ্যে ৫ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে মেহেদী হাসান। প্রথমে ৩ খুনি লিটনের সাথে জরুরী কথা আছে এ কথা বলেই তার সাথে বৈঠকখানা ঘরে ঢোকে। সেখানে ঢুকেই তাকে সালাম দিয়েই ১ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে মেহেদী। যা লিটন হাত দিয়ে আঁটকানোর চেষ্টা করে। ফলে সে গুলিটি হাতে লাগে। যেহেতু এই খুনিরা পেশাদার কিলার ছিল না, সেজন্য প্রথম গুলিটি ব্যর্থ হলে খুনি মেহেদী ঘাবড়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে এলোপাথারি পরবর্তী ৪ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে। হত্যাকা- শেষে তাদের ব্যবহৃত ডাইং ব্রাউন্সার রানার ১০০ সিসির কালো রংয়ের মোটর সাইকেলটিতে চড়ে দ্রুত পালিয়ে যায় তারা। খুনে ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি কাদের খানের নামে রেজিস্ট্রেশনকৃত এবং রেজিঃ বাবদ প্রদত্ত ফি জমা করা হয়েছে এমডি আলী নামে। যা পুলিশ জব্দ করেছে। এরপর রাস্তায় অপেক্ষমাণ কাদের খানের গাড়িতে কিলাররা বগুড়ায় তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পরে খুনিরা বাসে ঢাকায় গিয়ে কাদের খানের সহযোগিতায় আত্মগোপন করে থাকে।

যেভাবে কিলাররা শনাক্ত হয়
এমপি লিটনের কিলাররা গত ২ জানুয়ারি গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ধোপাডাঙ্গায় হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ওই পিস্তলটি ব্যবহার করে ভয় দেখিয়ে ফাইম নামে এক যুবকের কাছ থেকে তার মোবাইল ও টাকা-পয়সা ছিনতাই করে। ছিনতাই শেষে তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে পিস্তলের ৬ রাউন্ড বুলেটের ম্যাগাজিনটি তাদের অগোচরে রাস্তায় পড়ে যায়। যা স্থানীয় জনগণের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পুলিশ উদ্ধার করে। এই পিস্তলের বুলেট পরীক্ষা করে দেখা যায় এমপি লিটনের শরীর থেকে অপারেশন করে বের করা এবং তার বাড়িতে হত্যার পর প্রাপ্ত বুলেটের খোসার সাথে ওই ম্যাগাজিনের বুলেটের মিল রয়েছে। পরে এই সূত্র ধরে খুনিদের আটক করা হয় এবং পিস্তলটির ব্লাস্টিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।

খুনিদের স্বীকারোক্তি
গ্রেফতারকৃত ৩ খুনি মঙ্গলবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করে এবং এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থ যোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও আব্দুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে। এদিকে খুনিরা কাদের খানের পিস্তলটি ব্যবহার করেছিল বলেই বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে ঢাকা থেকে প্রাপ্ত ব্লাস্টিক পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার পর তারা চূড়ান্ত হবেন বলে ধারণা করছেন। এদিকে সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান খুনিদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক কাদের খানের পিস্তল এবং বুলেট জব্দ করে। কিন্তু ৪০ রাউন্ড বুলেট ক্রয় করলেও কাদের খান পুলিশকে মাত্র ১০ রাউন্ড বুলেট জমা দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ৩০ রাউন্ড বুলেটের হিসাব সে দিতে পারেনি।

মামলার বাদী ও লিটনের স্ত্রীর সন্তোষ
পুলিশ কর্তৃক লিটনের হত্যার পরিকল্পনাকারী ও খুনিদের গ্রেফতার করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী লিটনের বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী। তিনি এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও এই খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে নিয়োজিত পুলিশ ও বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান এবং খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতিও অনুরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে
জেলা জজ আদালতে সরকার পক্ষের পিপি অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম শফি বলেন, চাঞ্চল্যকর এমপি লিটন খুনের মামলাটি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দ্রুত বিচারের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সে কারণেই এই মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

কাদের খানের ১০ দিনের রিমান্ড
বুধবার দুপুরে পুলিশ কাদের খানকে গাইবান্ধার অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। শুনানি শেষে আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক মইনুল হাসান ইউসুফ।

কাদের খানের বাড়িতে ফের তল্লাশি
বগুড়া অফিস : মঙ্গলবার সুন্দরগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল (অব,) ডা. কাদের খানকে গ্রেফতারের পর বগুড়াস্থ ‘গরীব শাহ ক্লিনিক কাম বাড়িতে’ ওই রাতেই তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। মধ্যরাত ১২টা থেকে ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তল্লাশি চালানো হয়।
গরীব শাহ ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটার ইনচার্জ মোহাম্মদ ওয়াহেদ আলী জানান, রাত ১২টায় গাইবান্ধার সহকারী পুলিশ সুপার রেজিনুর রহমানসহ ৮/১০ জন ক্লিনিকে এসে তল্লাশি চালানোর কথা বলে। এ সময় স্যারের (ডাঃ কাদের) স্ত্রী ডা. নাসিমা তাকে তল্লাশী কাজে সহযোগিতা করেন। ক্লিনিক কাম বাসা চতুর্থ তলায় বেডরুমসহ অন্য একটি রুমে তল্লাশি চালানো হয়। রাত সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এই তল্লাশি চলে। তল্লাশি শেষে ডা. নাসিমার মোবাইল ফোনসহ ক্লিনিকের কর্মি নূরী, রোবেজা, শেফালীর মোবাইল ফোনও নিয়ে যায়। এছাড়াও দু’টি ল্যাপটপ এবং সিসি ক্যামেরার ডিভিআরসহ হার্ডডিক্স নিয়ে যায়। তারা দু’একদিনের মধ্যে মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে। তবে তল্লাশি শেষে তারা স্যারের (ডাঃ কাদের) মাইক্রোবাসটিও নিয়ে যায়।

কাদের খানের গ্রামের বাড়িতে পুলিশের অভিযান
গ্রেফতারকৃত জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি কর্নেল (অব.) ডা. আঃ কাদের খাঁনের গ্রামের বাড়িতে অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।
গতকাল (বুধবার) দুপুর পৌনে ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত জেলা ও থানা পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট উপজেলার ছাপরহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপরহাটি (খাঁনপাড়া) গ্রামে আঃ কাদের খাঁনের বাড়িতে অভিযান পরিচালনা করেন। তবে এ সময়ে কোনো অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘তার গ্রেফতারের পর গ্রামের বাড়িতে অস্ত্র ও গুলি আছে এমন আশঙ্কায় পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা অভিযান শুরু করেছে। পুরো বাড়িটি পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধারের অংশ হিসেবে কাদের খানের মালিকানাধীন তার বাড়ির চারিপাশে ৫/৬টি পুকুর সেচ দিয়ে অস্ত্র খোঁজা হচ্ছে। তবে বুধবার বিকেলে একটি পুকুর সেচ দেয়া হলেও সেখানে অস্ত্র পায়নি পুলিশ। এরপর আরেকটি পুকুরে সেচ মেশিন লাগানো হয়েছে। সেই সাথে রংপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ডুবুরি দলকেও ডাকা হয়েছে। এসময় রংপুরের অতিরিক্ত ডিআইজি বসির আহম্মেদ, গাইবান্ধা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম, সুন্দরগঞ্জ থানার ওসি আতিয়ার রহমান অস্ত্র উদ্ধার কাজে নেতৃত্ব ও বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দেন।
সাংসদ লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী সাবেক সাংসদ কর্নেল কাদের খানের বাড়ি তল্লাশিকালে ছবিটি তোলা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন