আফজাল বারী : বিএনপির চেয়ারম্যান প্রার্থীর ত্রিশঙ্কু অবস্থা। নির্বাচনের জয়-পরাজয় পরের কথা। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- কোনটি বেছে নিবেন? নিজের বউ (স্ত্রী), ভিটেবাড়ি, চাকরি নাকি বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন? এ ঘটনা নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ি উপজেলার গাজীপুর ইউপির।
আসন্ন নির্বাচনে ওই ইউনিয়নে ধানের শীষ প্রতীকে লড়াই করতে আব্দুল মজিদ মাস্টারকে দলীয় মনোনয়ন দেয় বিএনপি। কেন্দ্র থেকে প্রতীক পেয়ে মহাখুশিতে বাড়িতে যান ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদ। ওদিকে বিএনপি তাকে মনোনয়ন দিয়েছে খবর ছড়িয়ে পড়েছে ইউনিয়নজুড়ে। স্থানীয় রির্টানিং অফিসারের কাছে মনোনয়নপত্র দাখিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।
খালিয়াজুড়ি উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান কেষ্ট এবং মজিদের স্বজনরা জানান, একটি ফোনই মজিদের চেয়ারম্যান হবার প্রত্যাশার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আব্দুল মজিদের স্ত্রী সরকারি চাকরিজীবী (ফ্যামিলী প্লানিং)। মজিদ নিজেও হাই স্কুলের টিচার। প্রতিপক্ষের লোকেরা মজিদকেও ভিটেবাড়ি ছাড়া করা, চাকরি থেকে বাদ দেয়ার হুমকি দিয়েছে। তার স্ত্রীকে স্ত্রীর ভাইয়ের (শ্যালক) মাধ্যমে বার্তা দিয়েছিলেন।
স্ত্রীর কাছে বলা পাঠানো বার্তার ভাষা এমন যে, ‘আমরা আপনার ভালো চাই, আপনার স্বামীকে মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে বিরত রাখুন, নির্বাচনে তো জিতবেই না, আর মনোনয়নপত্র দাখিল করলে আপনার সরকারি চাকরিটা চলে যাবে...তার চাকরিসহ এলাকাতেই থাকতে পারবেন না। কথাটি কান্নাকাটি করেই মজিদকে বলেছিলেন তার স্ত্রী। কিন্তু আমলে নেয়নি বহু তদ্বিরে ধানের শীষ প্রাপ্ত মজিদ। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের রাতে তার স্ত্রী শর্ত দিয়েছেন। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। মনোনয়নপত্র দাখিল করবেন না, কথাটি না রাখলে আমাকে ছেড়ে দেন (সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন)। অবশেষে আব্দুল মজিদের মনোনয়নপত্র দাখিলই করা হয়নি। নিজে এখন খালিয়াজুড়ি ছাড়া। মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রেখেছিলেন, খুলেছেন গতকাল রাত ৯টা ২ মিনিটে। কয়দিন ফোন বন্ধ রাখলেও এ ঘটনা এসেছে বিএনপির নীতি নির্ধারকদের কাছে। ফোন খোলামাত্রই এই রিপোর্টরের কল। ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আব্দুল মজিদ ইনকিলাবকে বলেন, আমি এবং আমার বউয়ের চাকরি জন্য হুমকি ছিলো। আরো আছে যা বলার মতো নয়। তবে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি। সে-ই যে এলাকা ছাড়া হয়েছি আমি এখন পর্যন্ত নিজ ইউনিয়নে যেতে পারিনি।
হুমকির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে জানিয়েছে-এ প্রশ্নের জবাবে মজিদ বলেন, হ্যা। আমাদের যে নির্বাচন কমিটির আহ্বায়ক আছেন তার মাধ্যমে রির্টানিং অফিসারকে জানানো হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন সদুত্তর পাইনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন ঘটনার কাছাকাছি ঘটনা ঘটেছে এই নির্বাচন ঘিরে।
আগামী ২২ মার্চ দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম পর্বের ৭৩৮টির মধ্যে ৭১টি ইউনিয়নে মনোনয়ন জমা পড়েনি বিএনপির প্রার্থীর। যাচাই-বাছাইয়ে বাদ পড়েছে আরো ৩০ প্রার্থী। ফলে গড়ে প্রায় সাতটি ইউনিয়নের একটিতেই ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী রইল না। এটিকে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা বলে দাবি করছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেছেন, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বিএনপি তাদের প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের এই অভিযোগ মানতে নারাজ বিএনপি। তবে নিজেদের দুর্বলতার দিকটা স্বীকার করেছেন কেউ কেউ।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রিজভী আহম্মেদ অভিযোগ করেন, মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাঁধা দান, হুমকি-ধামকি, তুচ্ছ অজুহাতে স্থানীয় নির্বাচন কর্মকর্তারা শাসকদলের মদদে বিএনপির ১১৪ জনের প্রার্থিতা বাতিল করেছেন। কারণ নির্বাচন কমিশন সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে একেবারেই মরিয়া।
বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের অনেক এলাকা আছে যেখানে মনোনয়নপত্র সাবমিটই করতে পারেননি। বাগেরহাটের সকল ইউপিতে মনোনয়নপত্র রির্টানিং অফিসারের অফিস থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সাতক্ষীরাতে প্রার্থী বা তার প্রতিনিধিরা ঢুকতেই পারেনি, ফেনীতে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আব্দুল মজিদের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আব্দুল মজিদের ঘটনার পর তেমন সময় ছিলো না যে প্রার্থী পরিবর্তন করে দেয়া যাবে। তার ঘটনা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি।
বিএনপির প্রার্থী বাছাই কমিটির কাজে সম্পৃক্ত মৎসজীবী দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল বলেন, পৌরসভা নির্বাচনের কারচুপির চেয়ে এবার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে সরকার। বিএনপির প্রার্থীর দাখিল করা কাগজপত্র ফাইল থেকে খোয়া যাচ্ছে। শাসক দলীয় নেতাকর্মীরাই কমিশনে গিয়ে তা চুরি করেছে। অন্যদিকে প্রার্থীর প্রস্তাবক কিংবা সমর্থকের বাসা-বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাকে রির্টানিং অফিসারের কাছে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করেছে যে, ‘আমি প্রস্তাবকারী হইনি, স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে; ইত্যাদি কাজগুলো করা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিষয়টিকে একচোখাভাবে দেখছেন না। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, প্রার্থী দেওয়ার মতো একজন না, বহু প্রার্থী আছে। সব প্রার্থী আগ্রহ প্রকাশ করছেন না, ওই একাধিক কারণে। প্রথমত, দাঁড়াইলে মামলা খাবে। তারপর তার টাকাপয়সা নষ্ট হবে। প্রার্থীর পক্ষে যারা কাজ করবেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। বাড়ি বাড়ি পুলিশ গিয়ে তাদের হয়রানি করবে। এগুলো হলো বাস্তব চিত্র।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন