নাছিম উল আলম : নদ-নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনছে সড়ক ও সেতু। গত কয়েক দশকে সীমিত আকারে হলেও সড়ক ও সেতু নির্মাণের ফলে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তবে এখনো সড়ক এবং সেতুর মত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে সারা দেশের সাথে দক্ষিণাঞ্চল অনেক পিছিয়ে। দেশের একমাত্র রেল যোগাযোগবিহীন বিভাগ বরিশালকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার এ ঘোষণা অদূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হলে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থাসহ অর্থনীতিতেও সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল। তবে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ রক্ষাকারী বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করণের বিষয়টি এখনো অনেক পিছিয়ে। অথচ পদ্মা সেতু নির্মাণের আগেই এ মহাসড়কটি উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞগণ।
২০১৮’র মধ্যে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের যে আশার কথা সরকার বলছেন, তা বাস্তবায়িত হলে গোটা দক্ষিণাঞ্চল রাজধানী ঢাকাসহ সন্নিহিত এলাকার অনেক কাছে চলে আসবে। গত বৃহস্পতিবার খুলে দেয়া হয়েছে বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের কলাপাড়া ও হাজীপুরে শেখ কামাল ও শেখ জামাল সেতু। এর ফলে পর্যটন কেন্দ্র, সাগর সৈকত কুয়াকাটাও সারা দেশের অনেক কাছে চলে এসেছে। দেশের অন্যতম অকর্ষণীয় ওই পর্যটন কেন্দ্রটিতে পৌঁছতে মানুষের দুর্ভোগের লাঘব হয়েছে অনেকটাই। পাশাপাশি বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে লেবুখালীতে অবশিষ্ট একমাত্র সেতুটির নির্মাণ কাজের ঠিকাদার বাছাই চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করলেও প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিজনিত তহবিলের সংস্থান হলে চলতি অর্থ বছরেই ওই সেতুটির নির্মাণ কাজও শুরু করা যেতে পারে। ফলে ২০১৮’র শেষ ভাগে পদ্মা সেতু পার হয়ে সারা দেশ থেকে ফেরিবিহীন সড়ক পথে সরাসরি কুয়াকাটায় পৌঁছান সম্ভব হবে। এরফলে রাজধানী ঢাকা থেকে কক্সবাজারের আগেই কুয়াকাটায় পৌঁছান সম্ভব হবে।
অনাদিকাল থেকে নৌ যোগাযোগই দক্ষিণাঞ্চলের গণপরিবহন ব্যবস্থার মূল নিয়ামক ছিল। বৈঠা আর পাল তোলা গয়না নৌকার পরে ইঞ্জিন চালিত একতলা মোটর লঞ্চ এ অঞ্চলের পরিবহন ব্যবস্থায় গতি সঞ্চার করে। মোট পরিবহন ব্যবস্থার প্রায় শতভাগই এক সময় ছিল নৌপথ ও নৌযান নির্ভর। সেখানে সড়ক পরিবহন ইতোমধ্যে ৭০ভাগ স্থান দখল করেছে। বৃটিশ যুগে ব্যক্তি মালিকানাধীন তৎকালীন ফ্লোটিলা কোম্পানীর সাথে সরকারীÑআধা সরকারী আইজিএন ও আরএসএন কোম্পানী বাষ্পচালিত প্যডেল জাহাজ প্রবর্তনের মাধ্যমে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধান নদী বন্দর কোলকাতার পরেই ছিল বরিশালের অবস্থান। আর ব্যবসা-বাণিজ্যে রাজধানী কোলকাতার পরে অবস্থান ছিল ঝালকাঠীর। সে জন্য বৃটিশরা ঝালকাঠিকে দ্বিতীয় কোলকাতা হিসিবে চিহ্নিত করতেন।
বরিশাল নদী বন্দর থেকে বিপুল সংখ্যক প্যাডেল জাহাজ সুদূর কোলকাতা ছাড়াও খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, মাদারীপুর, পটুয়াখালী, খেপুপাড়া, কলাপাড়াসহ নানা রুটে চলাচল করত। তবে ছোট ও ফিডার রুটগুলোতে ব্যক্তি মালিকানাধীন একতলা ইঞ্জিন চালিত মোটর লঞ্চ বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে গয়না নৌকার স্থান দখল করে।
কিন্তু কালের বিবর্তনে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সারা দেশের মত গোটা দক্ষিণাঞ্চলেও বিপ্লব ঘটাতে শুরু করে দেশ স্বাধীনের পরে। ফলে অনেক নৌপথেই সরকারী-বেসরকারী লঞ্চ-স্টিমার চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও ১৯৬০ থেকে ’৬৫ সালের মধ্যে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা মহাসড়ক নির্মিত হয়। তবে একাধিক ফেরি নির্ভর ঐসড়কের তেমন কোন ব্যবহার ছিলনা দেশ স্বাধীনের আগে। মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা মহাসড়কের বেশ কিছু সেতু ও রাস্তার ক্ষতি হয়। স্বাধীনতার পরে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কে মেরামত দ্রুত সম্পন্ন হলেও ফরিদপুরের বাখুন্ডায় ক্ষতিগ্রস্ত সেতুটির স্থলে নতুন একটি সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮৭ সালে। ইতোমধ্যে ১৯৭৮ সাল থেকে ’৮২ সালের মধ্যে বরিশাল-পাটুয়াখালী সড়ক নির্মিত হয়। প্রথমে ৫টি ফেরি পার হয়ে ঐ সড়কে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। পরবর্তীতে তেলিখালী ও মৌকরনে ছোট দুটি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বিড়ম্বনা কিছুটা লাঘব হয়। ২০০১-০২ থেকে ২০০৫-০৬ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থে পটুয়াখালী শহর সংলগ্ন লোহালিয়া নদীর ওপরে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ইতোমধ্যে পটুয়াখালী-কলাপাড়া-কুয়াকাটা এবং কলাপাড়া-আমতলী বরগুনা মহাসড়কের নির্মাণ কাজও শেষ হয়।
অপরদিকে বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটির প্রশস্ততা ১২ফুট থেকে ১৮ফুটে উন্নীত হয় ১৯৯০ সালের দিকে। আর ঐ মহাসড়কের দীগনগর সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ’৮৮ সালের দিকেই। উপরন্তু টেকেরহাটের সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয় ১৯৯০-এর ৪ডিসেম্বর।
কিন্তু এর পরেও মহাসড়কটির বরিশাল প্রান্তে শিকারপুর ও দোয়ারিকাতে মাত্র দেড় কিলোমিটারের ব্যবধানে সন্ধ্যা নদীর দুটি ভাগ দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক পরিবহনে বড় অন্তরায় হিসেবে থেকে যায়। কারণ, বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কটির ওপরই গোটা দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সারা দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা বাহুলাংশে নির্ভরশীল। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে কুয়েত সরকারের অর্থায়নে শিকারপুর ও দোয়ারিকাতে দুটি প্রী-স্টেসড কংক্রিট গার্ডার সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০৪ সালের মার্চে। এ সেতু দুটি সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। শিকারপুর ও দোয়ারিকা সেতুরই ধারাবাহিকতায় কুয়েত উন্নয়ন তহবিল বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের দপদপিয়াতে কির্তনখোলা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করে। ২০০৬ সালে শুরু হয়ে ২০১০সালে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। পরবর্তীতে একই ধারাবাহিকতায় ঐ মহাসড়কের লেবুখালীর পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে অর্থায়নে কুয়েত রাজী হলেও দীর্ঘ কালক্ষেপণে প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে । ফলে অতিরিক্ত প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার সংস্থান নিয়ে বাস্তবায়ন কাজটি শুরু হচ্ছে না।
তবে ইতোমধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ করণ তহবিল ও বাংলাদেশ সরকারের পৌনে ২শ’ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয়ে নির্মিত কলাপাড়া, হাজীপুর ও মহীপুর/আলীপুরে ৩টি সেতু চালু হবার মধ্যে দিয়ে নদ-নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের সূচনা হল। এসব সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়ায় বরিশাল থেকে কুয়াকাটা সাগর সৈকতে পৌঁছতে মাত্র আড়াই ঘণ্টা সময় লাগছে।
২০০৬ সালে প্রণীত কলাপাড়া, হাজীপুর ও মহিপুর সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরুর লক্ষ্যে দরপত্র আহবান করা হয় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে। আর ঐসব সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশী সময় পরে। ফলে ১৫৪কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় ১৭৪কোটিতে উন্নীত হয়েছে। নদী শাসন সহ আরো কিছু আনুষঙ্গিক কাজ যুক্ত করে প্রকল্প ব্যয় ২শ’ কোটি টাকা অতিক্রম করবে বলে জানিয়েছে দায়িত্বশীল মহল। প্রকল্পটির আওতায় কলাপাড়াতে ৮৯১.৭৬মিটার, হাজীপুরে প্রায় ৪৮৩.৭২মিটার দীর্ঘ অপর সেতু দুটির নির্মাণ কাজ গত নভেম্বরে শেষভাগে ও ডিসেম্বরের প্রথমভাগেই শেষ হয়েছে।
এদিকে ১৯৮৫ থেকে ৯০ সালের মধ্যে খুলনা-বাগেরহাট পিরোজপুর মহাসড়ক নির্মাণের পরে পিরোজপুরের বলেশ্বর ও বাগেরহাটের দড়াটানায় দুটি সেতু নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে। ২০০২-০৫ সালের মধ্যে বরিশালÑপিরাজপুরের সংক্ষিপ্ত সড়ক পথের রাজাপুরÑপিরোজপুর অংশের সড়কটি চালু করা হয়। তবে দেশের দুটি বিভাগের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ অন্যতম বড় বাধা হয়ে আছে পিরোজপুরের বেকুঠিয়াতে বলেশ্বর নদী। ঐ নদীর ওপর ৮ম মৈত্রী সেতু নির্মাণের লক্ষ্যে অতি সম্প্রতি চীন সরকারের সাথে লেটার অব এক্সচেঞ্জও স্বাক্ষরিত হয়েছে সম্প্রতি। চীন সরকার সম্পূর্ণ নিজস্ব তহবিলে সেতুটি নির্মাণে চূড়ান্ত সম্মতি প্রদান করেছে। আগামী অর্থ বছরের মধ্যেই বেকুঠিয়া সেতুর বাসতব অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে সড়ক অধিদফতরের দায়িত্বশীল মহল আশাবাদী। এসেতুটি নির্মিত হলে দেশের ৩টি সমুদ্র বন্দর সহ চট্টগ্রাম-বরিশাল ও খুলনার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ আরো সহজতর হবে। ঐ মহাসড়কের গাব খান নদীর ওপর বাংলাদেশÑচীন ৫ম মৈত্রী সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০২ সালে। ২০০১ সালে বরিশাল-ভোলা ও ২০০৭সালে ভোলাÑলক্ষ্মীপুর ফেরি সার্ভিস চালুর মাধ্যমে চট্টগ্রামের সাথে লক্ষ্মীপুরÑভোলাÑবরিশাল হয়ে খুলনা-মোংলা ও বেনাপোলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯০সালের দিকে বরিশালÑরাজাপুরÑভান্ডারিয়াÑমঠবাড়ীয়া-পাথরঘাটা এবং ২০০৫Ñ০৬ সালে বরিশাল-বাকেরগঞ্জ-বরগুনা মহাসড়কের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
এসব সড়ক ও মহাসড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সহ দক্ষিণাঞ্চলের আর্থÑসামাজিক ব্যবস্থায়ও নতুন নতুন মাইল ফলক স্থাপন করছে। তবে বরিশালÑফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চার লেন-এ উন্নীত করার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞগণ। কারণ পদ্মা সেতু চালু হবার পরে রাজধানী সহ সন্নিহিত এলাকার সড়ক পরিবহন বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। সে ধরনের যানবাহন পরিবহনের ক্ষমতা এ মহাসড়কের থাকবে না। বিষয়টি নিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দেন দরবার চললেও বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। তবে এলক্ষ্যে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বশীল মহল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন