রাজধানীর উত্তরায় গ্যাসের চুলার আগুনে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের দু’জন মারা গেছে। অপর তিনজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। খবরে প্রকাশ, উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর বাড়ির সপ্তম তলায় এক ফ্ল্যাটে কয়েকদিন আগে ওঠেন স্ত্রী ও তিন পুত্রসহ মার্কিন দূতাবাসের প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ। ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটে পাঁচ সদস্যের এই পরিবারের সংসার গোছানোর কাজ যখন চলছিল, তখনই ঘটেছে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা। শুক্রবার সকালে গৃহকর্ত্রী গ্যাসের চুলায় দেয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালাতেই বিকট আওয়াজে বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিবারের সকল সদস্যই মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়। সবাইকে হাসপাতালে নেওয়ার পর পরিবারের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ছোট ছেলে মারা যায়। শাহনেওয়াজ ও তার স্ত্রীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে মধ্যম ছেলেটি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে। ধারণা করা হচ্ছে, গ্যাসের চুলা খোলা থাকার কারণে কিংবা পাইপ লাইনে ছিদ্র থাকায় বন্ধ ফ্ল্যাটে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় আগুন জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে সব ঘরে আগুন লেগে যায়। শাহনেওয়াজ নিজে যা বলেছেন, তাতে দ্বিতীয় কারণটিই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি জানিয়েছেন, গ্যাস লাইনে ছিদ্র ছিল এবং তিনি সেকথা বাড়ির মালিককে জানিয়েছিলেন। বাড়ির মালিক এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি।
গ্যাস লাইনে ত্রুটি থাকতে পারে, ছিদ্রও হতে পারে কোনো কারণে। বাড়ির মালিকের উচিত ছিল নতুন ভাড়াটে ওঠার আগেই গ্যাসের লাইন পরীক্ষা করে ত্রুটি বা ছিদ্র থাকলে সারিয়ে দেয়া। তিনি সেটা করেননি। জানানোর পরও তিনি এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেননি। তার এই অবহেলা ও দায়িত্বহীনতায় গোটা পরিবার আজ মহা বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। দ্বিতীয়ত, গ্যাস লাইনে ছিদ্র থাকার বিষয়টি জানার পরও শাহনেওয়াজ ও তার স্ত্রী যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করেননি। যদি তারা সতর্ক ও সাবধান হতেন তাহলে হয়তো এতবড় করুণ পরিণতির সম্মুখীন তাদের হতে হতো না। গ্যাস লাইনের ছিদ্র না সারানো পর্যন্ত তাদের চুলা ব্যবহার থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। তাছাড়া তাদের এটা জানা থাকার কথা, গ্যাস লাইনের ছিদ্র দিয়ে নির্গত গ্যাস বদ্ধ ঘরে জমে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগেই জানালা ও দরজা খুলে ফ্যান ছেড়ে গ্যাস বাইরে বের করে দেয়া উচিত ছিল। সেটা তারা করেননি। করলে এই দুর্ঘটনা নাও ঘটতে পারত। অবশ্য এসব কথা বলে এখন কোনো লাভ নেই। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। তবে এ দুর্ঘটনা থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে। বাড়ির মালিক যে কাজটি করেছেন, সেটা কোনো বাড়ির মালিকেরই করা উচিত নয়। এই যে হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা ঘটল, তার দায় তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। এই যে দু’টি কচিপ্রাণ ঝরে গেল, এর কি কোনো সান্ত¦না আছে? শাহনেওয়াজ, তার স্ত্রী এবং একমাত্র জীবিত পুত্রের যে কষ্ট-যন্ত্রণা তা কি দেখার মতো? বেঁচে থাকলেও তাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এভাবে একটি আনন্দময় সুখী পরিবার শেষ হয়ে গেল। এর কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে না।
অসতর্কতায় গ্যাসের চুলা খুলে রাখা যেমন নতুন কিছু নয়, তেমনি গ্যাস লাইনে ত্রুটি ও লিকেজের কারণে গ্যাস নিঃসরণও বিরল নয়। এই উভয় কারণে এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যতটা সতর্কতা ও সাবধানতা থাকার কথা, অনেকের মধ্যেই সেটা দেখা যায় না। কখনো কখনো শিশুরা চুলা জ্বালায়। ক্ষেত্রবিশেষে তারা চুলা নেভাতে ভুলে যায়। পরিবারের বড়রা খেয়াল না করলে দীর্ঘক্ষণ চুলা জ্বলতে থাকে। আবার অনেক সময় শিশুরা চুলা জ্বালিয়ে পরে নিভিয়ে দিলেও গ্যাস নিঃসরণ পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে কিনা পরখ করে না। এসব ক্ষেত্রে বড়দেরই, বিশেষত গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর অধিক সচেতন হওয়া প্রয়োজন। অসচেতনতা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ডেকে আনতে পারে। আমরা দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলতেই অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের চারপাশে এমন দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটতে দেখা যায়, যার কারণ সতর্কতা ও সাবধানতার অভাব। যেমন বিদ্যুৎ লাইনে ত্রুটি থাকার কারণে কিংবা শর্ট সার্কিটের কারণে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণহানি ও সম্পদহানি হয়। অথচ সংশ্লিষ্ট সবাই যদি সতর্ক হন, দায়িত্ববান হন, তাহলে এসব দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। যা হোক, আমরা আশা করব, গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যাপারে সবাই একটু বেশি সতর্ক হবে। পরিশেষে, আলোচ্য দুর্ঘটনায় যে দুই শিশু মারা গেছে, আমরা তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। সেইসঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। আমরা আরও আশা করব, দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করে তদন্তের রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। আর কিছু না হোক, এতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন