রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ০৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা কোথায়?

প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন : পৌরসভার নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে ভোটের হাওয়া অনেকটা উৎসবে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অধিক নির্বাচনমুখী। এ দেশের মানুষ নির্বাচনকে উৎসবের মতো গণ্য করে। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হলো স্থানীয় সরকারের একেবারে শেষ ধাপ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ না থাকলেও ক্ষমতাসীনরা যেন মরিয়া হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেশ ও জাতির কতটুকু কল্যাণ হবে, আল্লাহ মালুম। তবে এই নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়ার ফলে পাড়া-মহল্লার বিভেদ আরও উসকে দিতে পারে।
গণতন্ত্রের জন্য ইউপি নির্বাচন দলীয়ভাবে করা কতটুকু যৌক্তিক সে প্রশ্ন রয়েছে। তবে দলীয় সরকারের অধীনে দলীয়ভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার রেকর্ড নেই। নিকট অতীতে নির্বাচনের যে চিত্র দেখা গেছে তার পুনরাবৃত্তি হবে না এমন কথা হলফ করে বলতে পারবে না সরকার এবং নির্বাচন কমিশন। তবে প্রথমবারের দলীয় নির্বাচনের ব্যবস্থাপনায় যে খুঁত রয়ে গেছে তা না থাকলে ভালো হতো। এই সরকার তো ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। তার অধীনে সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে পৌরসভার নির্বাচনগুলো ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতির মহোৎসবের মধ্য দিয়ে হয়েছে, যা আজও জনগণকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
যেসময়ে এই লেখাটি লিখছি সে সময়ে শিশু হত্যার মহোৎসব চলেছে সর্বত্র। সামাজিক অবক্ষয়ে মানুষের অধঃপতন কত নিচে গেছে তা কল্পনা করলেই গা শিউরে ওঠে। ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে করাটা কি খুব জরুরি ছিল? দলীয় ভিত্তিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর জয়-পরাজয়ের কারণে সংঘাত যে বাড়বে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? অমর্ত্য সেনের উক্তিটি আবারও স্মরণ করি,“যে দেশে নিয়মিতভাবে নির্বাচন হয়, যেখানে বিরোধী দল প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে পারে, যেখানে সেন্সরশিপ ছাড়া সংবাদপত্রে রিপোর্ট ছাপা যেতে পারে এবং সরকারি নীতির যথার্থতার প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, সেখানে দুর্ভিক্ষ ঘটে না।” উপরোক্ত কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন তার সহজ উত্তর পাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ কতটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করছে তা বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট দেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। প্রতিনিয়ত হত্যা, গুম, ক্রসফায়ার, ধর্ষণ অপহরণের খবরই যথেষ্ট। মানুষের চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেন আজ জলন্ত কড়াইয়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে।
গণতন্ত্র হলো জনগণের সম্মতির শাসন এবং এই সম্মতি অর্জিত হয় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বিশেষত ইউনিয়ন পরিষদ হলো জনগণের দোরগোড়ার সরকার। যেখানে গণতান্ত্রিক স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ রাজনৈতিক দল অদ্যাবধি গড়ে ওঠেনি, সেখানে দলীয় ভিত্তিতে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই কি নিখোঁজ গণতন্ত্রের ঠিকানা খুঁজে পাবে জনগণ? এই সরকারের অধীনে অতীতে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তা বেশির ভাগই ভোট জালিয়াতি, জবরদখল আর সহিংসতার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করা মানে মরা নদীতে জোয়ার আসার শামিল।
ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কয়েক দিন আগে নারায়ণগঞ্জের আলীরটেক ইউনিয়নে বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের সমর্থকদের মধ্যে সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হয়েছে (মানবজমিন, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬)। প্রশাসন ও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর একশ্রেণির দলদাস সদস্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টি করে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য পক্ষপাতদুষ্টতার গুরুতর অভিযোগ থেকে নির্বাচন কমিশনও মুক্ত নয়। অতীতে অধিকাংশ প্রার্থীর দলীয় পরিচিতি থাকলেও ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক ব্যবহৃত হতো না। তাই নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত দলদাস কর্মকর্তারাও তাদের দলীয় প্রার্থীদের প্রতি এক ধরনের নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করতেন, ফলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রসারিত হতো। কিন্তু দলভিত্তিক নির্বাচনে দলকানা কর্মকর্তারা তাদের দল মনোনীত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা তো দূরের কথা উল্টো নিজেরাই ভোট জালিয়াতি আর সিল মারাতে জড়িয়ে পড়ছে, যা নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে বড় বাধা। যে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে কিনা, তা বহুলাংশে নির্ভর করে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও নিষ্ঠার ওপর। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ্ঞাবহ এই নির্বাচন কমিশন এ পর্যন্ত যতগুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছে সবকটিতে তার দক্ষতা ও নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভোটের হাওয়া লাগলেও মাঠে নেই ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। জোটের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশ কারাগারে এবং বাকিরা পুলিশি হয়রানি এড়াতে ভিটেবাড়ি ছেড়ে আত্মগোপনে। সরকার সুকৌশলে ইসির ক্ষমতা কেড়ে নিল। আগে আচরণবিধি লংঘন করলে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা ছিল ইসির। এমন কি রাজনৈতিক দলকে জরিমানার ক্ষমতাও ইসির ছিল। অনিয়মের বিরুদ্ধে ইসির যে কঠোর হওয়ার সুযোগ ছিল তা এবার আর থাকল না। ফলে ক্ষমতাসীনরা ইসিকে ব্যবহার করে ইউপি নির্বাচনেও নিজেদের ইচ্ছামতো কর্তৃত্ব আরোপ করতে পারবে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, ইতিমধ্যে সরকারি দলের প্রার্থীদের সমর্থকদের বাধার কারণে শতাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারেননি। বিএনপি অভিযোগ করেছে, বাধার কারণে তাদের ৭০ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি। ভোটের আগেই ২৫ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তার মধ্যে ২৩টিতেই ‘গায়ের জোর’ খাটানোর তথ্য মিলেছে। বিষয়টি অনেকটা বিগত ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের মতোই হয়ে গেল। সরকারদলীয় কর্মীদের হামলা-মামলার ভয়েই বিএনপির প্রার্থী নেই। এ কথাকে তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হওয়ায় ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে ভয় ও শংকা বিরাজ করছে। কোথাও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের ক্যাডাররা প্রকাশ্যেই প্রতিপক্ষ বিএনপি অথবা নিজ দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীর মনোনয়নপত্র কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে, কোথাও বা হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের বসিয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জোর খাটানোর ঘটনাগুলো ঘটেছে নীরবে ফিল্মি স্টাইলে, যে কারণে লিখিতভাবে কেউ কোনো অভিযোগ দাখিল করেননি। এসব জায়গার নামও জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত এ ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছেন। মনে হচ্ছে, আরও বহু জায়গায় প্রকৃত নির্বাচন হবে না। গোপন সমঝোতা, চাপ ও ‘স্বপ্রণোদিতভাবে’ নির্বাচন থেকেও কৌশলগতভাবে সরে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটবে। তিন স্তরে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচনী প্রাণ থাকবে না। ওইসব ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা বিজয়ী হবে কিন্তু গণতন্ত্র অজানা গন্তব্যে পাড়ি দেবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সংস্কৃতি মোটেও দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না জেনেও গণতন্ত্রের স্বার্থেই তারা ইউপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কেবল বিএনপি নয়, অন্য রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের অনেকে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন। রাজনীতি বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন, দলীয় নির্বাচনে স্থানীয় ও সামাজিক বিভেদ বাড়বে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় নির্বাচনের পর বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের আঘাত এসেছে। আমাদের ভালো একটি নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে শেষ করা হয়েছে। এটা ভালো করার কোনো লক্ষণ দেখছি না। কারও আগ্রহও নেই। ইউনিয়ন পরিষদের যে নির্বাচন হচ্ছে তা কথা বলার মতো না। তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ এখন আর নির্বাচন করতে আগ্রহী হতে চায় না। যেভাবে নির্বাচন হচ্ছে সেটিকে কোনো নির্বাচন বলাও ঠিক হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেছেন, দলীয় প্রতীকের প্রভাবের কারণে যদি নির্বাচন সুষ্ঠু না হয় তাহলে সমাজে ভাগাভাগি বাড়বে। সম্প্রীতি নির্মাণ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে সমাজে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হবে। ইত্তেফাকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। এটি আদৌও পুনরুদ্ধার করা যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বর্তমানে নির্বাচনের নামে প্রহসন চলছে। জনগণ ও ভোটারদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজনীতিবিদ, বিজয়ী প্রার্থী ও প্রশাসনের ওপর মানুষ আস্থা হারাবে। আমাদের দেশে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘মানুষের মুখেই জয়, মানুষের মুখেই ক্ষয়’। এই আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের অতীত রেকর্ডই বলে দেয় তাদের অধীনে সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশা করা মানে শিয়ালের কাছে মুরগি পাহারা রাখা। ভোট শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হবে কিনা, সবাই নিজের ভোট নিজে দিতে পারবে কিনা সে প্রশ্নও অনেকের মনে জাগছে। নির্বাচন কমিশন ইউপি নির্বাচনকে কতটা বিতর্কমুক্ত রাখতে পারে, সেটা দেখার অপেক্ষা করছে দেশের মানুষ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন