শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে : ২০১৫ সালে এসএসসি পাস করেছে মৌসুমী। এইচএসসিতে ভর্তিও হয়েছে। কিন্তু দেড় দু’বছরেও কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা গ্রামে নিজ বাড়িতে যাওয়ার সাহস পায়নি। মেলেনি স্বজনদের হত্যার বিচার। ২০১৪ সালের ১৪ জানুয়ারির গভীর রাতে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা। মৌসুমী তার বাবা-মা সহ ৫জনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে দুর্বৃত্তরা সটকে পড়ে। কিন্তু এই ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় একমাত্র মৌসুমী। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহাবুদ্দিন ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, জমি দখলের আশায় সুলতান মিয়ার বড় ভাই মনতাজ মিয়ার পরিকল্পনায় রাতে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে মৌসুমীর বাবা সুলতান মিয়া, মা হাজেরা বেগম, ভাইয়ের মেয়ে রোমানা ও বোনের ৬ বছরের মেয়ে আনিকাকে উপর্যপুরি কুঁপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে যায় দুর্বৃত্তরা। ঘটনাস্থলে মারা যায় সুলতান, রোমানা ও আনিকা। হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যায় মা হাজেরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টানা দুই মাস চিকিৎসা নিয়ে কোন রকম সুস্থ হয় মৌসুমী। এ ঘটনায় অজ্ঞাত আসামি করে ভূরুঙ্গামারী থানায় মামলা করে মৌসুমীর ঢাকায় বসবাস করা বড় ভাই হাফিজুর রহমান। ঘটনার পর থেকে আজও বাড়ি ফেরা হয়নি মৌসুমীর। দুর্বৃত্তদের চিনে ফেলায় তার জীবন এখনও হুমকির মুখে। সিলেটে অবস্থানরত বোন ও দুলাভাইয়ের কাছে থেকে কিছুদিন পড়ালেখা করে। ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল মৌসুমী। সে ধলডাঙ্গা দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা বাণিজ্য বিভাগ থেকে অংশ নেয়। জিপিএ ৪.৬ পয়েন্ট পেয়ে পাস করে। ভুরুঙ্গামারী মহিলা কলেজে এইসএসসিতে ভর্তি হয়েছে। ঢাকা হতে বড় ভাই ছয় মাস আগে নিজ এলাকায় এসেছেন। বর্তমানে ভাইবোন মিলে থাকছেন অজ্ঞাত আত্মীয়ের বাড়িতে। গত সোমবার খোঁজ নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে দেখা হয় মৌসুমী ও হাফিজুরের। মৌসুমী সেই রাতের বিভৎসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন, ঘুম থেকে জেগে শুনি মায়ে বলতাছে মিয়াভাই হেতো তোমার ভাই। ওনারে ছাইড়া দেন। অন্য দুইজনরে বলতাছে ওরা ছোট মানুষ ওরা কি ক্ষতি করেছে তোমগো। ছেড়ে দেও। কিন্তু মুখোশ পড়া লোকগুলো সবাইরে এলোপাতাড়ি কোপাচ্ছে। আমি উইঠাই মনতাজের (জেঠা) মুখোশ টাইনা খুলি। এতে আমার মাথায়-কাঁধে কোপ মারে কয়েকটা। আমি পইরা যাই। এরপর আর কিছুই জানি না। ঘটনার দিন পুলিশ মনতাজ মিয়াকে আটক করে। চারদিন থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়। কিছুদিন পর আবারো আটক করে ছেড়ে দেয়। দেড় বছরের পুলিশ হত্যার ক্লু বের করতে পারেনি। শেষে গত বছরের ২০মে একই উপজেলার পাগলাহাট বাজারের আব্দুল মোতালেব চাঁদ কাপড় ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মোবাইলে পরিবারের কাছে ১০লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। তিন দিন পর বগুড়ার মন্ডল ধরনের ধান ক্ষেত থেকে ওই ব্যবসায়ীর গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। এ মামলার দু’মাস পর জড়িত নজরুল ইসলাম মজনুসহ ৭জনকে নরসিংদী থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মজনুর বাড়ি উপজেলার কামাত আঙ্গারিয়ায়। কয়েক বছর আগে ভিটে বিক্রি করে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে আন্তঃজেলা ডাকাত দলে সম্পৃক্ত হয়। মনতাজ ভাইয়ের পরিবারকে হত্যার জন্য মজনুকে চুক্তি করে। গ্রেফতারের পর দু’টো ঘটনায় জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছে মজনু। পরে মনতাজ মিয়াকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায় পুলিশ। মৌসুমীর বড় ভাই হাফিজুর রহমান বলেন, জায়গা-জমির কারণে পরিকল্পনা ছিল আমাদের পুরো পরিবারকে শেষ করে দেয়া। ওই রাতে ঢাকা থেকে আমার বাড়ি আসার কথা ছিল; কিন্তু আসিনি। এক বোন ছিল। দু’দিন পরে যেত। আমি না আসায় চলে যায়। এসব খুনিরা জানতনা। পুলিশ আগেই জেনেছে। কিন্তু আসামি ধরে ছেড়ে দিয়েছে। জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি করেন তিনি। কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার তবারত উল্লাহ্ জানান, ভুরুঙ্গামারীর একই পরিবারের ৪ জন হত্যার ঘটনার যথেষ্ট অগ্রগতি রয়েছে। এর পরবর্তীতে ঐ এলাকায় এক কাপড় ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে হত্যার ঘটনায়ও ফোর মার্ডারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। বেশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকা-ে ভাড়াটিয়ে কিলারও ছিল। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সকল আসামিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন