শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ক্ষমা করো অগ্নিদগ্ধ তাহমিনা

যৌতুক এবং আমাদের নেত্রীগণ

প্রকাশের সময় : ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টালিন সরকার : সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার এই দেশে নারীরাই সর্বেসর্বা। গারো-হাজং পরিবারে যেমন কর্তাব্যক্তি ‘নারী’ তেমনি আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নারীরাই কর্তৃত্ব করছে। রাজনৈতিক দল, জাতীয় সংসদ, সরকার এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নারীদের হাতেই। হাজার হাজার এনজিও’র নামে নারীরা বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা এনে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে। সারাদেশে মাকরসার জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এনজিও। তারপরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না, যৌতুক ছাড়া নারীর বিয়ে হচ্ছে না। নারী ও শিশু ধর্ষণ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে। যৌতুকের বলী হতে হচ্ছে নারীদের। রংপুরে আগুনে ঝলসানো তাহমিনার মতো দেশের গ্রামগঞ্জে হাজারো নারীকে যৌতুকের জন্য নিত্যদিন নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। কখনো তাহমিনা বেগমের মতো কেউ মিডিয়ায় খবর হলে নৃশংসতার চিত্র মানুষ জানতে পারে। কিন্তু দায়িত্বশীলদের কারো টনক নড়ে না। এনজিওর টাকায় প্রায়ই নারীর স্বাধীনতার নামে কিছু সুবিধাভোগী নারী নেত্রী তর্জন-গর্জন করেন; বিদেশী অর্থ ছাড়ে সুবিধার জন্য সে চিত্র মিডিয়ায় প্রচার করেন। অথচ কেউ যৌতুকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক নিয়েছেন এমন খবর নেই। শুধু তাই নয়, নারী চালিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যৌতুকের বিষয়ে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কোনো আওয়াজ উচ্চারিত হয়নি। অথচ অন্যান্য কারণে ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি নেত্রীদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়। ১৯ শতকের প্রথমার্ধে নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের জন্ম নেয়া রংপুরের এক অজপাড়াগাঁয়ে তাহমিনা বেগমকে যৌতুকের আগুনে ঝলসে দেয়া হয়েছে; হাসপাতালে আগুনে ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতরানো তাহমিনা বেগমের কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। ক্ষমা করো তাহমিনা! এ সমাজ তোমাদের জন্য এখনো আশীর্বাদ নয়, অভিশাপই রয়ে গেছে।
খবরে প্রকাশ, রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের দাদন গ্রামের অগ্নিদগ্ধ তাহমিনা রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে কাতরাচ্ছে। যৌতুকের দাবিতে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তার গায়ে কিরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়। তাহমিনার মা মরিয়ন বেগম জানান, ১৩ বছর মান্নান নামের একজনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এই দীর্ঘ সময় যৌতুকের জন্য প্রায়ই তাহমিনাকে চড় থাপ্পড় সহ্য করতে হতো। গরীব বাবা কাছে যৌতুকের টাকা আনতে না পারায় এভাবেই চলছিল সংসার। সব শেষে স্বামী ও শাশুড়ি মিলে আগুন দিয়ে ঝলসে দেয় তাকে। হাসপাতালে এখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তাহমিনা। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দাদন গ্রামের অগ্নিদগ্ধ গৃহবধূ তহমিনার পরিবার এমন অভিযোগ করেছেন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে এ ঘটনা ঘটে। পরদিন শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। শনিবার সকালে নেওয়া হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। তার বুক থেকে কোমর পর্যন্ত এবং দুই হাতসহ শরীরের ৫০ শতাংশ অগ্নিদগ্ধ। তহমিনার বাড়ি পীরগাছা উপজেলার পূর্ব চিলপুর গ্রামে। বাবা তৌফিকুর রহমান ইটভাটার শ্রমিক। একই উপজেলার ফল ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নানের সঙ্গে ১৩ বছর আগে তার বিয়ে হয়। তাদের মুন্নী বেগম (১২) ও মুক্তা বেগম (৮) বছর বয়সী দু’টি কন্যা সন্তান রয়েছে।
দাদন গ্রামের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। গাছগাছালি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা ওই গ্রামের রাস্তা দিয়ে বহুবার রিক্সায় চলাফেরা হয়েছে। চৈত্রের প্রচ- রোদে চলতে ফিরতে গাছের নীচের চায়ের দোকানে চা খাওয়ার আগে রাস্তার টিউবলের নলে মুখ দিয়ে পানি খাওয়ার স্মৃতিও জ্বলজ্বল করছে। সেই গ্রামের গৃহবধু তাহমিনার ঝলসানো শরীর টিভিতে দেখে আঁতকে উঠেছি। এ কেমন বর্বরতা! ওরা মানুষ না পশু! দেশের গ্রামে-গঞ্জে হাজার হাজার তাহমিনাদের যৌতুকসহ নানা কারণে চড়-থাপ্পড়ের মধ্যেই ঘর-সংসার করতে হচ্ছে। অসংখ্য তাহমিনাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে-হচ্ছে। যে খবর মিডিয়া তুলে ধরে শুধু সেগুলোই ভদ্র (!) সমাজের মানুষের চোখে আসে; অন্যগুলো থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। যৌতুকের বলী নারীরা স্বামী-শাশুড়ির চড়-থাপ্পড়কে মনে করেন নিয়তি। আসলে কি গরীব ঘরে নারী হিসেবে জন্ম নেয়া পাপ! গত বছর শরিয়তপুর ও মাদারীপুরের চরের অর্ধশতাধিত গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি গ্রামে ৬ থেকে ১০ জন বিবাহযোগ্যা মেয়ে। যৌতুক যোগাড় করতে না পারায় বাবা-মা মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না। কন্যা দায়গ্রস্ত ওই সব বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকানো যায় না। ওই চিত্র দেখে ইনকিলাবে প্রকাশিত ‘যৌবন পোড়ে বালির তাপে’ শিরোনামের রিপোর্টে ব্যাপক লাইক পড়েছিল। যৌতুকের কারণে যে দেশের হাজার হাজার বিবাহ যোগ্যা মেয়ের বিয়ে হয় না; আইবুড়ি হয়ে বাবার ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হন সে দেশের জন্য জাতিসংঘের ‘নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ’ আর ‘মধ্যম আয়ের দেশের’ সার্টিফিকেট কি খুবই সম্মানের? প্রশ্ন হলো নারী শিক্ষার অগ্রগতির এ দেশে তাহমিনাদের কেন এভাবে যৌতুকের বলী হতে হবে?
’৯০-এর পট-পরিবর্তনের পর নারী নেতৃত্বই পর্যায়ক্রমে দেশ শাসন করছে। দেশের দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একক নারী নেত্রীর ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নারী, গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা নারী, জাতীয় সংসদের স্পীকার নারী, সংসদ উপনেতা নারী, কয়েকজন মন্ত্রী নারী। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বর্তমানে মাঠের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত দলের নেতাও নারী। জাতীয় সংসদে প্রায় শতাধিক নারী এমপি প্রতিনিধিত্ব করছেন। মন্ত্রিসভা, হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সচিব, সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এমন পদে নারীর সংখ্যা বর্তমানে নেহায়েত কম নয়। পুলিশ প্রশাসনেও নারী কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক। আর এনজিওর নামে শত শত নারী নেত্রীর সৃষ্টি হয়েছে যারা নারীর অধিকার, নারীর স্বাধীনতা ও সমাজে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই করছেন বিদেশ থেকে শত শত কোটি টাকা এনে। তারা শিশু মৃত্যু, মা মৃত্যুর সংখ্যা কমানোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। কিন্তু কোনো নারী নেত্রী ও এনজিওর নেতৃত্ব দেয়া উঁচু তলার নারীরা কি যৌতুকের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন? নারী স্বাধীনতা কি শুধু কিছু নারীর পুরুষের মতো করে রাস্তায় চলাফেরা করা এবং অফিস-আদালতে কাজকর্ম করার সুযোগ সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ? সংরক্ষিত ৫০ আসনে মহিলা এমপিসহ প্রায় শতাধিক নারী বর্তমান সংসদে রয়েছেন। তাদের কেউ কি দেশে যৌতুক প্রথা বিলুপ্তির জন্য কোনো বিল সংসদে উত্থাপন করেছেন? জনগুরুত্বপূর্ণ বা বিশেষ অধিকার প্রস্তাবের মাধ্যমে সমাজের অভিশাপ যৌতুকের বিরুদ্ধে সংসদে আলোচনার প্রস্তাবনা দিয়েছেন? এ সব নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন? মিডিয়ার প্রচরণার কারণে দেশে নারীর প্রতি এসিড নিক্ষেপ ও ইফটিজিং কিছুটা হলেও কমেছে। এনজিওর মাধ্যমে নারীদের আইনী সহায়তার নামে এডিস নিক্ষেপের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে কিছু এনজিও নেত্রীকে কথা বলতে শোনা যায়। কিন্তু গ্রাম বাংলায় এখনো নারীর জন্য সবচেয়ে বেদনা দায়ক যৌতুক প্রথা বিলুপ্তি বা যৌতুকের প্রতি মানুষকে নিরুসাহিত করতে কোনো কর্মসূচি কি গ্রহণ করেছেন? এসি রুমে বসে দু’একটি সেমিনার সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কি? অভাব-অনটনের কারণে গ্রামের মেয়েরা গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। প্রায় ৪০ লাখ নারী গ্রার্মেন্টস শিল্পে কাজ করে নিজেদের গার্মেন্টস কন্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিতই করেননি; তারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। গ্রামের একটি অশিক্ষিত-অল্প শিক্ষিত মেয়ে দেশের অর্থনীতিতে যে ভাবে ভূমিকা রাখছেন নারী নেত্রী ও এনজিওর গালাবাজী করা উঁচু তলার শিক্ষিত নারীরা কি সে ভূমিকা রাখতে পারছেন? প্রশ্ন হলো নারীর সম-অধিকারের নামে রাস্তা-ঘাটে আটোসাঁটো পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা, সম্ভ্রম-আকিদা না মেনে চলাফেলা করা, বেলেল্লাপনা করা, রাত বিরাতে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা? তথাকথিত আন্দোলন, রাজপথে মিছিল, বিদেশীদের টাকায় বড় বড় হোটেলের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করে প্রচারণা পাওয়া যায় এবং কিছু শিক্ষিত নারীর ইচ্ছা-মত চলাফেরার অধিকার নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু গ্রামের অবহেলিত বঞ্চিত, শরিয়তপুর-মাদারীপুর চরের যৌতুকের কারণে বাবার ঘরে বসে থাকা এবং রংপুরের বিয়ের পর যৌতুকের কারণে ঘর-সংসারে নিত্যদিন চড়-থাপ্পড় ও অগ্নিদগ্ধ হওয়া তাহমিনাদের অধিকার কি নিশ্চিত হয়? তাহমিনার মতো হাজার হাজার নারী জীবন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে শুধু যৌতুকের কারণে; অথচ নারী নেত্রী ও এনজিওর টাকায় নারী স্বাধীনতার আন্দোলনকারীরা যেন ঘুমিয়েই রয়েছেন। নারী নেত্রীদের এই মরার ঘুম ভাংবে কবে?

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
সাব্বির ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৫:১৭ এএম says : 0
ওরা শুধু স্বার্থের জন্য কাজ করে নারী বা দেশের জন্য নয়।
Total Reply(0)
সাইফুল ইসলাম ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৫:১৮ এএম says : 0
ঠিক বলেছেন। ক্ষমা চাওয়া আর প্রতিবাদ করা ছাড়া আমরা আর কি-ই বা করতে পারি ?
Total Reply(0)
আলমগীর ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৫:১৯ এএম says : 0
এসব তিক্ত সত্য কথা তুলে ধরায় লেখককে মোবারকবাদ।
Total Reply(0)
Munna ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ৫:১৯ এএম says : 0
kisu bolar nai............................
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন