বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

আরব বসন্ত, গাদ্দাফি হত্যা ও মোবারকের মুক্তির পেছনে সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা

| প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ আবদুল গফুর : সাম্রাজ্যবাদের কুটকৌশল বোঝা যে এক দুরূহ ব্যাপার তা নতুন করে প্রমাণিত হলো। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে আরব বিশ্বে বিশেষত উত্তর আফ্রিকার মিশর প্রভৃতি আরব দেশে যে যুগান্তকারী গণঅভ্যুত্থান শুরু হয় তার লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্ব থেকে হোসনি মোবারকদের মতো গণবিরোধী একনায়কদের চিরতরে উৎখাত করা। এই গণবিরোধী একনায়করা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় বহাল থাকতে সক্ষম হন তাদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের সমর্থনের সুযোগে। সেই নিরিখে ওই গণঅভ্যুত্থান সারা বিশ্বে আরব বসন্ত নামেও আখ্যায়িত হয়। ধারণা করা হয়েছিল এই আরব বসন্তের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ সমর্থিত দেশীয় গণবিরোধী একনায়কদের অপশাসনের চিরঅবসান হবে। আরব বিশ্বের এসব দেশ মুক্তি, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার এক নতুন ইতিহাসের পথে যাত্রা শুরুর সুযোগ পাবে।
মুক্তিকামী জনগণের এ আশাবাদের যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ গণঅভ্যুত্থানের ১৮ দিনের মাথায় ১১ ফেব্রæয়ারি তারিখে ক্ষমতাচ্যুত হন একনায়কতন্ত্রবাদী প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। মুক্তিকামী মিসরীয় জনগণ হোসনি মোবারকের এ ক্ষমতাচ্যুতির খবরে সারা দেশের সর্বত্র উল্লাস-উৎসবে মেতে ওঠে। পরবর্তীকালে এ গণঅভ্যুত্থান চলাকালে হোসনি মোবারকের নির্দেশে যেসব বিক্ষোভকারী নিহত হয় তাদের স্বজনরা আদালতের আশ্রয় নিলে আদালতের পক্ষ থেকে হোসনি মোবারক যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হন। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, এই কারাদন্ডের বিরুদ্ধে আপিল করায় হোসনি মোবারক সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন।
একনায়ক শাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে শুধু যে গণঅভ্যুত্থানকালে বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগই উত্থাপিত হয় তা নয়, তার দীর্ঘ স্বৈরশাসনকালে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও উত্থাপিত হয় তার বিরুদ্ধে। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে আততায়ীর গুলিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত নিহত হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন হোসনি মোবারক। স্বাভাকিভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আততায়ীর গুলিতে আনোয়ার সাদতের নিহত হওয়ার পেছনে হোসনি মোবারকের কোনো পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা ছিল কিনা। এ প্রশ্ন ওঠে এ কারণে যে, যিনি তার একনায়কতন্ত্রী শাসন অব্যাহত রাখতে বিক্ষোভকারী জনগণের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে পারেন, ক্ষমতা লাভের লক্ষ্যে সাবেক প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার পেছনেও তার ভ‚মিকা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এখানে আরও উল্লেখ্য, আরব বসন্ত তথা আরব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের ক্ষমতাচ্যুতির পর মিসরে যে সাধারণ নির্বাচন দেয়া হয়, তাতে মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড নামক সাম্রাজ্যবাদ- বিরোধী ইসলামী রাজনৈতিক দল বিজয়ী হয় এবং মিসরের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসি। তিনি (মোহাম্মদ মুরসি) যাকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগ দান করেন, তিনি অতীতে হোসনি মোবারক কর্তৃক সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ফলে যে প্রেসিডেন্ট মুরসি তাকে প্রধান সেনাপতি পদে নিয়োগদান করেন, সেই প্রেসিডেন্ট মুরসিকেই ক্ষমতাচ্যুত করে একপর্যায়ে প্রধান সেনাপতি সি. সি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন।
মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার এসব পালাবদলের পেছনে সক্রিয় ছিল সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মূলত মিসরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনগণের সৃষ্ট আরব বসন্তকে অযৌক্তিকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় প্রতিবেশী দেশ লিবিয়ায়। লিবিয়ায় তখন চলছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জনসমর্থনধন্য মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির শাসন। আরব বসন্তকে লিবিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে সাম্রাজ্যবাদের একটাই লক্ষ্য ছিল, তেল সম্পদসমৃদ্ধ লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফির শাসনের অবসান ঘটানো।
এ লক্ষ্য সাধনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি দীর্ঘ সময় অপচয় করতে রাজি ছিল না। কারণ গাদ্দাফি ছিলেন বিপুল জনসমর্থনধন্য একজন আদর্শ শাসক। তিনি এককালের সাম্রাজ্যবাদ-কবলিত তেল সমৃদ্ধ লিবিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের অবসান ঘটিয়ে লিবিয়ার প্রতিটি অধিবাসীকে রাষ্ট্রীয় সম্পদে একটি করে বাসগৃহ নির্মাণের যে কর্মসূচি হাতে নেন, তা ছিল লিবিয়ার মতো অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাসকারী বেদুইন অধ্যুষিত দেশে রীতিমতো একটা বৈপ্লবিক ও অকল্পনীয় ব্যাপার। গাদ্দাফির এ পরিকল্পানা ঘোষিত হওয়ার পর অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গাদ্দাফির পিতা গাদ্দাফির কাছে তার (গাদ্দাফির পিতার) জন্য একটি বাসগৃহের অনুরোধ জানালে গাদ্দাফি তার স্বভাবসুলভ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে পিতাকে জানান, লিবিয়ার সকল অধিবাসীর মধ্যে শেষ বাড়িটি পাবে আপনার পুত্র (অর্থাৎ গাদ্দাফী) এবং সর্বশেষ বাড়ির আগেরটি পাবেন আপনি।
এহেন আদর্শবাদী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অথচ জননন্দিত শাসককে অধিকতর সুযোগ দান আরব বসন্তের মূল নায়ক সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি তাদের লক্ষ্যের নিরিখে নিরাপদ মনে করেনি। আরব বসন্তের প্রভাব লিবিয়ায় ছড়িয়ে দেয়ার প্রথম সুযোগেই এই আদর্শবাদী নেতা মুয়াম্মার আল গাদ্দাফিকে হত্যার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। অন্যদিকে যার তিরিশ বছরের স্বৈরতন্ত্রী অপশাসনকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে আরব বসন্ত তথা আরব গণঅভ্যুত্থানের সূচনা, সেই স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের নামে বাঁচিয়ে রাখা হয়। অথচ হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে দীর্ঘ তিরিশ বছরের স্বৈরশাসনকালে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি ২০১১ সালের গণঅভ্যুত্থান কালে তার নির্দেশে অসংখ্য বিক্ষোভকারী হত্যারও অভিযোগ ছিল।
মিসরের হোসনি মোবারক, লিবিয়ার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি এই দুই আরব শাসকের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গিই বলে দেয় তথাকথিত আরব বসন্তের মূল হোতাদের আসল লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব পাকাপোক্ত করা এবং আরব বিশ্বের ওই এলাকা থেকে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি নির্মূল করা। সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির যে লক্ষ্য হাছিলের জন্য তথাকথিত আরব বসন্ত সৃষ্টি করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত ‘সার্থক’ হয়েছে। কারণ তথাকথিত আরব বসন্তের নামে সংশ্লিষ্ট ওইসব দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির সম্ভাবনা বহুদিনের জন্য বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব হয়েছে।
মিসর, লিবিয়া প্রভৃতি আরব দেশে তথাকথিত আরব বসন্তের নামে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি যে ভ‚মিকা পালন করেছে তার কারণ খুঁজে পেতে হলে আমাদের ইতিহাসের দ্বারস্থ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ১০৯৫ থেকে ১২৭১ সাল পর্যন্ত মুসলমানদের হাত থেকে ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা বারংবার যে অভিযান চালায় সেটাই ইতিহাসে ক্রুসেড তথা খ্রিস্টানদের ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত হয়ে আছে। সেই সাম্রাজ্যবাদী খ্রিস্টান শক্তির এখন নেতৃত্বদান করছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মন-মগজে ক্রুসেডীয় ঐতিহ্যের এই মুসলিমবিদ্বেষী চিন্তাধারা কতটা স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে, তার সর্বশেষ প্রমাণ পাই আমরা সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বে পশ্চিমা শক্তির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে মুসলিম উম্মাহকে বিবেচনা করার কুখ্যাত হান্টিংটন তত্ত¡ থেকে। আসলে মুসলিম বিদ্বেষী এ হান্টিংটন তত্তে¡র মূল প্রোথিত রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের ক্রসেডীয় চেতনায়। ক্রুসেডের পরবর্তীকালীন যাবতীয় খ্রিস্টান-মুসলিম সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর মূলে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের এ ক্রুসেডীয় চেতনা।
এমন কি ইতিহাসে দেখা যায় দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে পলাশী বিপর্যয়ের অনেক আগে থেকেই ইউরোপ থেকে আগত বণিকবেশী ইংরেজরা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাহর দরবারের রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ প্রমুখ অমুসলিম নেতাদের সঙ্গে গোপন আঁতাতে মিলিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা পলাশী বিপর্যয়ের বহু আগে থেকেই কট্টর মুসলিমবিরোধী নেতা শিবাজীসহ মারাঠি নেতাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ স্থাপনেরও চেষ্টা করেছিলেন।
দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক নেতাই পশ্চিমা বিশ্বের মুসলিমবিরোধী এ ইতিহাসের যেমন খবর রাখেন না, তেমনি তাদের সঙ্গে মুসলিমবিদ্বেষী অসংখ্য নেতার আঁতাতের ক্ষতিকর দিক সম্বন্ধেও সম্যক সচেতন নন। এর প্রতিক্রিয়ায় আমাদের তথাকথিত বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্রে এমন সব নেতারও আবির্ভাব ঘটেছে যারা অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানদের মসজিদে মূর্তি স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন। বাংলাদেশের মত মুসলিমপ্রধান দেশে জাতীয় ঈদগাহের পাশে দেবীর মূর্তি স্থাপনের পেছনেও এদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্ররোচনা রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
এ প্রসঙ্গে একটি কথা আমরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে রাখতে চাই যে, বাংলাদেশ ও ভারত দুটি বন্ধুপ্রতিম দেশ। এ দুটি দেশে প্রচুর সংখ্যক হিন্দু-মুসলমানের বাস। আমরা আন্তরিকভাবেই কামনা করি, এ দুটি প্রতিবেশীর মধ্যে যেন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। আমরা আরও কামনা করি দুই দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেও যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অব্যাহত থাকে। তা রাখতে যেমন মসজিদে মূর্তি স্থাপনের মতো মুসলিমবিদ্বেষী চিন্তা বাদ দিতে হবে, তেমনি জাতীয় ঈদগাহের পাশে কোনো দেব-দেবীর মূর্তি স্থাপনের মতো প্ররোচনামূলক ভ‚মিকার চিন্তাও মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। সেটাই হবে আন্ত:ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নির্ভর করে তার নিজস্ব বিশ্বাস মতে ধর্ম পালনের অধিকারের ওপর। অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে বা ধর্ম পালনে বাধা দেয়া বা বিপত্তি সৃষ্টি করার অধিকার রাষ্ট্রের কোনো নাগরিকেরই নেই, তা সে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠ যে সম্প্রদায়ের লোকই হোক না কেন। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান, তা আমাদের দেশের গৌরব। এই গৌরবের মূলে রয়েছে এদেশের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের ধর্ম ইসলামের অনুসারী হওয়ার কারণে। এই গৌরবজনক ঐতিহ্য আমরা কখনও হারাতে চাই না। আর হারাতে চাই না বলেই আমরা আশা করি মাতৃভ‚মির গৌরবের স্বার্থে আমাদের সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভাইবোনেরাও এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন