শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

কালীদাস বৈদ্যের বই এবং আমাদের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে

| প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সঞ্জীব চৌধুরী : দৈনিক ইনকিলাবে গত ১৫ মার্চ ২০১৭ ডা. কালীদাস বৈদ্যের একটি বই নিয়ে মোস্তফা আনোয়ার খানের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। লেখাটি পড়ে আমি এ ব্যাপারে দু-চারটি কথা বলার তাগিদ বোধ করছি।
আমি ডা. কালীদাস বৈদ্যের নাম জানলেও তার সঙ্গে আমার কোনো দিন দেখা হয়নি। যতদূর মনে পড়ে অবিভক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে চিত্তরঞ্জন সুতার, ডা. কালীদাস বৈদ্য, মলয় কুমার ভৌমিকসহ আরও কয়েকজন মিলে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে একটি হিন্দু সম্মেলন ডেকে মূলত তফসিলি হিন্দুদের নিয়ে জাতীয় গণমুক্তি দল নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। দেশের এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে শুধু হিন্দুদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা অদৌ সঙ্গত হবে কিনা তা নিয়ে সম্মেলনে তুমুল বিতর্ক হয়। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপ্লবী অতীশ রায়, অ্যাডভোকেট সুধীর হাজরা প্রমুখ হিন্দু দল গঠনের তীব্র বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় গণমুক্তি দল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে প্রার্থী দিয়ে একটাতেও জিততে পারেনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৃশ্যত এই দলের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় গণমুক্তি দল ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে একপর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ সময় এই দলের দুই কাÐারি চিত্তরঞ্জন সুতার এবং কালীদাস বৈদ্য কলকাতায় অবস্থান করতে থাকেন; যদিও তারা মাঝে-মধ্যে বাংলাদেশে আসতেন। একপর্যায়ে চিত্তরঞ্জন সুতার জাতীয় গণমুক্তি দলের মায়া পরিত্যাগ করে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাÐের পর তারা আর বাংলাদেশে আসেননি। এরপর থেকে চিত্তরঞ্জন সুতারের নাম তেমন একটা শোনা না গেলেও স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন গড়ে তোলে কালীদাস বৈদ্য পাদপ্রদীপে চলে আসেন। তার স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ভারত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ভারতকে দিয়ে বাংলাদেশকে হিন্দু বাংলা ও মুসলমান বাংলা নামে দুই টুকরা করে ফেলা। এর জন্য তিনি মূলত ভারতে যাওয়া শরণার্থী যুবকদের নিয়ে বঙ্গসেনা নামে একটি ব্যক্তিগত বাহিনী গড়ে তোলেন। এই বাহিনী মাঝে মাঝে পশ্চিমবঙ্গে মিছিল-মিটিং করত। এমনকি বেনাপোল সীমান্তের ওপারে ভারতের হরিদাসপুরে এসেও হৈচৈ করত। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। তিনি যে ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’ নামে একটি বইও লিখে ফেলেছেন তা আমার জানা ছিল না।
মোস্তফা আনোয়ার খানের লেখা পড়ে আমি বইটি সম্পর্কে আগ্রহী হই। কিন্তু বিভিন্ন বইয়ের দোকানে খোঁজ করে বইটি পাইনি। শুনেছি কম্পিউটার খুলে বিশেষ বিশেষ জায়গায় বোতাম টিপলে বইটি সহজেই পাওয়া যায়। আমি কম্পিউটার চালাতে জানি না। তাই বইটি পড়া দূরে থাকুক, দেখাও হয়নি। তবে মোস্তফা আনোয়ার সাহেব তার লেখা বইটি থেকে যেসব উদ্ধৃতি দিয়েছেন তাতে আমি স্তম্ভিত। শেখ মুজিবের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বতা আছে; ফলে তার প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনাও কম হয় না। তাই বলে ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে শেখ মুজিবের পরামর্শে লে. জেনারেল টিক্কা খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করেছিল; এমন কুৎসিত মিথ্যা এর আগে কেউ উচ্চরণ করেনি। জনাব খানের লেখা থেকে জানতে পারলাম কালীদাস বৈদ্য ’৪৭-এ দেশভাগের সময় কলকাতায় ছিলেন। ’৫০-সালে তিনি পাকিস্তান ভাঙার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় আসেন। এর অর্থ হচ্ছে, বাঙালির স্বাধীনতা স্পৃহা, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের অত্যাচার, মহান মুক্তিযুদ্ধÑ এসবই গুরুত্বহীন বিষয়। আসল কথাÑ ‘কালীদাস বৈদ্য আর তার দোসরদের ক‚ট বুদ্ধিতে ঠাহর দিতে না পেরে বেকুব বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান ভেঙে ফেলেছে’। এই ঘৃণ্য তত্ত¡ মেনে নিলে জাতি হিসেবে আমাদের গর্ববোধ, লক্ষ লক্ষ মানুষের আত্মাহুতির মূল্য ধূলায় মিশে যায়। দেখা যাচ্ছে কালীদাস বৈদ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে চরমভাবে ঘৃণা করতেন। একই সঙ্গে তিনি ঘৃণা করতেন ইসলাম ধর্মকে এবং এই ধর্মের অনুসারী মুসলমানদের। তিনি তার বইয়ে কোরআনের আয়াতের অপব্যাখ্যা করে যেভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন তা হিটলারের প্রচারমন্ত্রী গোয়েবলসকেও হার মানায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, কালীদাস বৈদ্য এসব অপকর্ম করতে গেলেন কেন! এর কারণ বের করতে গেলে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, শুধু কিছু সংখ্যক মুসলমান রাজনীতিক নয়, পাশাপাশি কিছু সংখ্যক তথাকথিত হিন্দু এদেশের নিরীহ হিন্দুদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়। এই তথাকথিত হিন্দু নেতারা মনে করে, দেশে হিন্দুবিরোধী রক্তাক্ত দাঙ্গা বেঁধে গেলে তাদের নেতৃত্ব পোক্ত হবে। তারা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত শক্তিকে ভয় পায়। তাই তারা চায় বিভেদ। নইলে মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাঙালির বিজয় যখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তখন কালীদাস বৈদ্যদের কেন মনে হবে যে, তাদের ‘সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ’ হয়ে গেছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় যাদের ‘সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ’ করে দেয়, তাদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কারণ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে কালীদাস বৈদ্যদের সব প্রচেষ্টা ছিল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর।
এখন আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি। মুক্তিযুদ্ধে চ‚ড়ান্ত বিজয় অর্জিত হওয়ার প্রাক্কালে কালীদাস বৈদ্যরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ছুটে বেড়িয়েছিলেন হিন্দু শরণার্থীদের এ কথা বোঝাতে যে, হিন্দুদের জন্য কিছু একটা না করা পর্যন্ত তারা যেন দেশ স্বাধীন হলেও দেশে ফিরে না যায়। হিন্দু শরণার্থীরা তাদের কথায় কান দেয়নি। তারা বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখেছে। মুসলমান শরণার্থীদের পাশাপাশি তারাও দেশে ফিরে এসেছে। এভাবে জয় হয়েছে বাঙালিত্বের। পরাজিত হয়েছে কালীদাস বৈদ্যদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি। যে কারণে আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের ঘৃণা করি। ঠিক একই কারণে সমপরিমাণ ঘৃণা কালীদাস বৈদ্যদেরও প্রাপ্য।
 লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
দুলাল সরখেল ৩ এপ্রিল, ২০২১, ৫:৩৬ পিএম says : 0
“যতদূর মনে পড়ে অবিভক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে চিত্তরঞ্জন সুতার, ডা. কালীদাস বৈদ্য, মলয় কুমার ভৌমিকসহ আরও কয়েকজন মিলে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে একটি হিন্দু সম্মেলন ডেকে মূলত তফসিলি হিন্দুদের নিয়ে জাতীয় গণমুক্তি দল নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। দেশের এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে শুধু হিন্দুদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা অদৌ সঙ্গত হবে কিনা তা নিয়ে সম্মেলনে তুমুল বিতর্ক হয়। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপ্লবী অতীশ রায়, অ্যাডভোকেট সুধীর হাজরা প্রমুখ হিন্দু দল গঠনের তীব্র বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন।” সন্জীব বাবুর লেখার এই অংশে তথ্যগত ভুল রয়েছে। ১৯৭০ সালে বার কাউন্সিলে ডাকা হিন্দু মহা সম্মেলনটি মুলত বানচাল হওয়ার অবস্থায় পর্যবসিত হয়। সুধির হাজরা এবং চিত্ত সুতারের পোষা কিছু উচ্ছৃংখল লোক (যার মধ্যে কার্তিক ঠাকুর নামক জাতির ছেলেও ছিল) সাবেক মন্ত্রী ভবানী শংকর বিশ্বাসকে সম্মেলনে যোগদানে বাঁধা প্রদান করে। দুইদিন ব্যাপী এই সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন লাল কুঠিতে অনুস্ঠিত হয়। সেখানে ভবানী শংকর বিশ্বাসের জোরালো বক্তব্যের প্রেক্ষিতে হিন্দু দল গঠন ছাড়াই সম্মেলন শেষ হয়। সেদিন সুধির হাজরারা সেখানে ভয়ে উপস্থিত হয়না। এর পরবর্তি সময়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে চিত্তরঞ্জন সুতার, ডা. কালীদাস বৈদ্য, মলয় কুমার ভৌমিকসহ আরও কয়েকজন মিলে গণমুক্তি দল গঠন করে এবং মাত্র ২টি আসনে প্রার্থী মনোনয়ন করে। এর একটি ছিল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী - মুকসুদপুর নির্বাচনী এলাকা। প্রার্থী ছিল কার্তিক ঠাকুর (ওড়াকান্দির ঠাকুরদের বংশধর নয়)। কিন্তু দুর্ভাগ্য আওয়ামীলীগের নৌকার জোয়ারে গণমুক্তি সহ চিত্ত সুতার, কালিদাস গং ভেসে যায়। তার পরের কথা আরো মজার । সংগে সংগে চিত্ত বাবু ভেল পাল্টে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন এবং কার্তিক ঠাকুর সহযোগে মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা করার জন্য গোপালগন্জ এর নম:শুদ্র এলাকা থেকে তহবিল সংগ্রহ শুরু করেন। কিন্তু এ অন্চলে খান সেনাদের আক্রমণ শুরু হলে তহবিল সমেত ভারতে পাড়ি যমান। তারপর সে তহবিলের ভাগ্যে কি ঘটেছিল কেউ জানে না।
Total Reply(0)
pritom ১১ নভেম্বর, ২০২১, ৬:৪৯ পিএম says : 0
প্রয়াত সন্জ্বীব চৌধুরীকে যথাযথ সন্মান দিয়ে বলছি, দাদু এভাবেই তো সারা জীবন দালালী করে গেলেন কি পেলেন জীবনে, হিন্দুদের জন্য একটি নিরাপদ ভূমি চাওয়া কি অন্যায়!!!?
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন