মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন : কালস্রোতে সব কিছু হারিয়ে গেলেও গ্রন্থাগার মানুষের জীবনে এক শাশ্বত আলোক উৎস। মানুষের অগ্রগতিতে পাঠাগার এক আলোক দিশারী। তাই যুগের পর যুগ পেরিয়ে মানুষ এগিয়ে চলেছে আরো এক আলোকিত সভ্যতার দিকে। গ্রন্থাগার একাধারে আদিম ও চিরন্তন, চিরপুরাতন ও চিরনতুন। সভ্যতার প্রয়োজনে পাঠাগারের উন্মেষ, জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে গ্রন্থাগারের নাম স্পষ্টভাবে উচ্চারিত। মানুষ আলোক পথচারী। আলোর পথে এগিয়ে মানুষ হতে চায় আলোকিত মানুষ। সুন্দরের তৃষ্ণা তার বুকে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অহিংসা এবং ভালোবাসার মন্ত্রে সে নবযুগের ঋত্বিক। সে আজ নিজেকে বিশ্বপথিকরূপে চিহ্নিত করতে চায়। মানুষের এই আলোকিত জীবন-সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান অগ্নিফুলিঙ্গ সে পাঠাগার থেকে আহরণ করেছে। সভ্য মানুষের জ্ঞানপিপাসার চিরন্তন আধার পাঠাগার। পাঠাগার মানুষের আকাঙ্খায় একটি আলোকিত রতœভা-ারের মতো সেখান থেকে একটি একটি করে নিটোল রতœ তুলে সে নিজেকে সম্পদশালী বলে প্রতিপন্ন করে, নিজেকে আলোকিত করে। তাই আলোকিত মানুষ তৈরিতে চাই পাঠাগার।
একজন আলোকিত মানুষের আত্মা হয় প্রসারিত, উন্মোচিত। তিনি বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন, জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত তার আত্মা। রাষ্ট্র, সমাজ, গণতন্ত্র, ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা সব চেতনায় সমৃদ্ধ তার হৃদয়। তিনি শাশ্বত আলার পথের যাত্রী। তার এই পথের দিক নির্দেশক পাঠাগার। পাঠাগার গড়ে তোলে আলোকিত মানুষ। গ্রন্থাগার হচ্ছে প-িতের পা-িত্য অর্জনের তীর্থস্থান, জ্ঞান সাধকদের গবেষণাগার, ধার্মিকদের ধার্মিকতার দূত, লেখক, কবি-সাহিত্যিকের জনক, সমাজের প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা, অন্ধজনের চোখের আলো এবং নির্মল আত্মা নিয়ে স্রষ্টার কাছে যাওয়ার বাহন। একজন মানুষকে পূর্ণ করে তোলে পাঠাগার। আর আলোকিত মানুষেরা পূর্ণ করে তোলেন সমাজকে। তাই পাঠাগার ছাড়া আমাদের সমাজ অসম্পূূর্ণ। তাই বলা হয়, ‘একটি পাঠাগারবিহীন সমাজ, একটি আলোকবিহীন অন্ধকার বনের মতো’।
আপাতদৃষ্টিতে পাঠাগার একটি স্থিতিশীল বস্তু মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার মধ্যে একটি সজীব গতিময় সত্তা রয়েছে, কেননা গ্রন্থেই মানুষের উপলব্ধির ধারক ও বাহক, গ্রন্থের মাধ্যমেই মানুষের প্রতিভার স্পন্দন অনুভূত হয়। গ্রন্থের আকর্ষণ আদিম আকর্ষণের মতোই দুর্বার। কিন্তু সেখানে আবিলতা নেই, আছে অনাবিল পবিত্র এক আলোক দীপ্তি যা মানুষের মনকে অনির্বাচনীয় আনন্দে ভরে তোলে। কিন্তু এই অলৌকিক আনন্দের পথে পাঠকের হাত ধরে নিয়ে যাবে যেখানে শুধু অসীম আকাশ আর অপরূপ আলোকবন্যা। এক্ষেত্রে পাঠাগার অপরিহার্য। সমাজনীতি, নাগরিকতা, গণতন্ত্র, ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা সব ক্ষেত্রের পূর্ণতা আনয়নে পাঠাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাঠাগার অচেতন প্রয়োজনটাকে সচেতন করে তোলে, নাগরিকদের জাতীয়নীতির প্রতি আস্থাশীল করে এবং সামাজিক ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ করায় গ্রন্থাগার, গ্রন্থের মাধ্যমে যোগাযোগ করে পাঠকদের সঙ্গে। পাঠাগারের এই যোগাযোগ জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে প্রসারিত করে ও দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করে। সংস্কৃতি বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ পালন করে। পাঠাগার মানুষকে মানুষের মতো বাঁচতে সাহায্য করে, যে যেমন ব্যক্তি তাকে তেমনিভাবে সাহায্য করে। পাঠাগার সংস্কৃতির বিকাশ সাধন ও জ্ঞান অর্জনের পথকে সুগম করে তোলে। সমাজের কেউ যেন জ্ঞানের আলো হতে বঞ্চিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখে আলোকিত পাঠাগার। গ্রন্থাগার আনন্দের মধ্য দিয়ে জীবনমুখী শিক্ষাবিস্তার করে। নিরুৎসুক মানুষকে উৎসুক করে তোলা এবং আগ্রহী পাঠককে জ্ঞানার্জনে বেশি উৎসাহিত করা এর অন্যতম কর্তব্য।
আধুনিক সমাজে স্বাদ এবং সাধনা স্বাধীনতাকেন্দ্রিক। আধুনিক সমাজের আদর্শগুলো গণতান্ত্রিক বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত। গণতান্ত্রিক চেতনা উন্মেষে স্বাধীনতা শব্দটির একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। চিন্তার স্বাধীনতা, জ্ঞানের প্রসারের স্বাধীনতা এবং শিক্ষা বিস্তারের স্বাধীনতা। উদার এবং সচেতন মানুষের পবিত্র স্বাধীনতার এই বোধটি উজ্জ্বীবিত হতে পারে একমাত্র পাঠাগারের মধ্য দিয়ে।
পাঠাগার মানুষের চিরকালের সঙ্গী চিরায়ত পাথেয়। মানুষের সমস্ত জীবনই পাঠাগারের আলো-আঁধারের পরিবেশে হাসি-কান্না, দুঃখ-সুখের পৌষ-ফাগুনের পালার মতো দোলায়মান। তার আত্মিক, আধ্যাত্মিক এবং সার্বিক প্রগতির নির্ধারক এবং নিয়ন্ত্রক।
সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং সামাজিক প্রয়োজনে পাঠাগারের অবদান অপরিসীম। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঠাগার জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে নারী-পুরুষ, শিশু সমাজের সর্বস্তরের অধিবাসীদের মধ্যে সেবা পৌঁছে দিতে পারে।
আমরা বর্তমানে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করছি, রাষ্ট্রীয় বোর্ড/বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব পাঠক্রম প্রণয়ন করছে, প্রকৃত বিবেচনায় এটা শিক্ষার একটা খ-িত অংশ মাত্র। মেধার যথার্থ বিকাশে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাকে আগে প্রসারিত এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে পাঠাগার। পাঠাগার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অবাধ যাতায়াতের মাধ্যমে জ্ঞানের আলো উন্মেচিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আত্মিক সমৃদ্ধির জন্য যে বই, তা বিদ্যালয় বহির্ভূত বললেও চলে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, মানিক বন্দোপাধ্যায় অন্তত এসব বাঙালি লেখক সেভাবেই তাকে আয়ত্ত করেছিলেন এবং মানস-মুক্তির পথ, জীবনের জাগৃতির পথ খুলে দিয়েছিলেন। এসব বই আত্মার ক্ষুধা মেটায়, জ্ঞানের তৃষ্ণা নিবারণ করে, আনন্দের, অনুভূতির মুঞ্জরণ করে। ফলত অনাবশ্যক বই থেকেই আত্মার প্রসারণ ঘটে। আর এই অন্যাবশ্যক বইয়ের সমাহার ঘটে পাঠগারে।
পাঠাগার মানুষকে যে আনন্দ দেয়, সে আনন্দ সর্বপরিব্যাপ্ত, সৃজনধর্মী এবং চেতনা উন্মেষকারী। এই আনন্দ মানুষের আত্মাকে করে তোলে আলোকিত, মহিমায় উদ্ভাসিত, বেতার, চলচ্চিত্র, টেলিভিশনের মাধ্যমে মানুষ আনন্দ আহরণ করে। কিন্তু এর ফলে পাঠগারের ভূমিকা কোনোভাবে গৌণ হয়ে যায়নি। এ যেন হোমাগ্নির পাশে কেরোসিন শিখা। শুধুমাত্র আনন্দ বিতরনেই নয়; শুধু শিক্ষা প্রসারেই নয়, মানুষের মধ্যে সামাজিক চেতনার জাগরণে ও ঐক্যের প্রসারে পাঠগার এক বিশেষ ভূমিকা পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ। গ্রন্থ ও পাঠগারের সামগ্রিক ধূসর অতীত পেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে আমরা যে উজ্জ্বল উত্তরাধিকারের সন্ধান পাই, সে উত্তরাধিকার কাল, দেশ, মানব সমাজকে দিয়ে খ-িত করা যায় না। মানব জ্ঞানের সৃষ্টিগুলোকে উত্তরকালের জন্য সঞ্চয় করেছে মানুষ। সঞ্চয়ের এই বাহ্যিক রূপ এক একটা সোপানের মতো। এক একটি সোপানের উপর নির্ভর করে পরবর্তী সোপান নির্মিত হয়েছে। মানুষ একটির পর একটি যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থায়ী তথ্য প্রক্রিয়া আবিষ্কার ও সংরক্ষণ করতে চেয়েছে। প্রতিটি মাধ্যম ও প্রক্রিয়া সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক অসামান্য দিকচিহ্ন যা পাঠাগারই ধরে রাখে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারা বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে। পৃথিবীর প্রগতিশীল দেশগুলোতে গ্রন্থাগার আজকাল একটি অপরিহার্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত। জনসংযোগের যে ক’টি উপায় বর্তমানে সুপ্রচলিত তাদের মধ্যে পাঠাগার অন্যতম। প্রসঙ্গত প্রমথ চৌধুরীর উক্তি স্মরণ করা যায়, “সাহিত্যে চর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি, এদেশের লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল কলেজের চাইতে কিছু বেশি, আমার বিশ্বাস শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের উপর স্থান দেই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে সেচ্ছায় স্বাচ্ছন্দচিত্তে স্বশিক্ষিত হবার সুযোগ পায়; প্রতি লোক তার স্বীয় শক্তি রুচি অনুসারে নিজের মনকে, নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।”
আলোকিত মানুষ নিজেকে উপলব্ধি করতে জানেন। আর সে জন্য চাই পাঠাগার। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ আব্দুল হাই মন্তব্য করেন, ‘মানুষের শ্রেষ্ঠ পরিচয় তার জ্ঞানের সাধনায়, ভাবের আরাধনায় আর নিজেকে উপলব্ধির প্রয়াসে। প্রতি জাতির মানুষই এ সাধনায় নিজেকে সৃষ্টি করে চলেছে। নিত্য নতুন উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতায় নিজেকে বিচিত্রভাবে বিকশিত করে চলেছে। পাঠাগার মানুষের জ্ঞানের অক্ষয় ভা-ার স্বরূপচিত্ত বিকাশের শ্রেষ্ঠবিহার ক্ষেত্র।’
পাঠাগার আলোকিত করে তোলে মানুষকে। পাঠাগার মানুষকে তার আত্মিক অন্বেষনের পথ নির্দেশ করে যা ক্ষুধা-তৃষ্ণা; শ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই একান্ত জরুরি। আমাদের সমাজকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে, শিক্ষিত রাষ্ট্র পেতে হলে আমাদের চাই আলোকিত মানুষ। আর আলোকিত মানুষ পেতে চাই পাঠাগার। পাঠাগার মানুষের জ্ঞানের সব দুয়ার উন্মোচন করে মানবাত্মা করে তোলে প্রজ্জ্বলিত। পাঠাগার আমাদের চারপাশের রহস্যময় বিশ্বের দুয়ার খুলে দেয়। সমাজের মস্তিষ্ক ও জ্ঞানধার হলো পাঠাগার। তাই দীপ্ত, মেধা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে সুশীল সমাজ পাবার লক্ষ্যে সমাজের প্রতিটি স্তরে পৌঁছে দিতে হবে এই শ্লোগান-
“আলোকিত মানুষ চাই
আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য পাঠাগার চাই”।
লেখক : প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন