গোপাল মজুমদার : বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ আরো অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ একে অন্যের সহযোগী হিসেবে বসবাস করে আসছে। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অঙ্গীকার। যদিও তা পুরোপুরি সম্ভব হয়েছে তা বলব না। তবে পৃথিবীর কোথাও তা পুরোপুরি সম্ভব হয়েছে বলেও আমার জানা নেই।
ইতিহাসের অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে আজকে আমরা বাঙালি জাতি, স্বাধীন জাতি। ইতিহাসের পাঠক বা বিশ্লেষক মাত্রেই জানবেন যে, ইতিহাস সবসময় আলোকিত হয় না, কখনো কখনো কলঙ্কিতও হয়। সেক্ষেত্রে আলোকিত ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতি, গোত্র, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি সকলের দ্বারা সম্মানিত হন; তবে কলঙ্কিত ইতিহাস সৃষ্টিকারী সকলের দ্বারা নিন্দিত ও ধীকৃত হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সফলতা ও ব্যর্থতার ইতিহাস এত বছর পর কমবেশি সবারই জানার কথা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক এটা পৃথিবীর সকল দেশ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মেনে নিয়েছে এবং স্বীকৃতি দিয়েছে।
কথা হলো বঙ্গবন্ধুর দোষ-ত্রæটি, লোভ-লালসা যদি কিছু থেকে থাকে তা প্রজন্মের কাছে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে একদিন প্রমাণিত হবে। কারো মনগড়া গল্প বা তত্ত¡ শুনিয়ে শান্তিকামী বাঙালির সুখের স্বর্গে নারকীয় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা মেনে নেয়া যায় না। তেমনি এক গল্প বা তত্তে¡র সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে ১৫ মার্চ ২০১৭ ‘দৈনিক ইনকিলাব’ পত্রিকায় প্রকাশিত মোস্তফা আনোয়ার খান-এর লেখা এবং ১ এপ্রিল ২০১৭ প্রকাশিত প্রবীণ সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক সঞ্জীব চৌধুরীর লেখা পড়ে। এই তত্তে¡র নাম দিয়েছি ‘কালিদাস তত্ত¡’। ডা. কালিদাস ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’ বইতে লিখেছেনÑ ‘শোনা যায় কলকাতার মহ-নিধন দাঙ্গায় মুজিব নিজ হাতে ছোরা নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেনÑ দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মুজিব ব্যক্তিগতভাবে সুরাবর্দির শিষ্য ছিলেন। সহজেই গুরু যে দাঙ্গা আরম্ভ করেছিলেন তাতে শিষ্য যোগ দেবে তা আর আশ্চর্য কি? তবে দাঙ্গায় হিন্দু খুন করার শিক্ষা মুজিব তাঁর গ্রাম থেকেই পেয়েছিলেন। কারণ আমাদের অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ বাঁধলে ছেরামকান্দি, ডেমরাডাঙা ও টুঙ্গিপাড়ার মুসলমানরাই মুসলমাদের নেতৃত্ব দিত।’ (পৃষ্ঠাÑ ৫৪, ৫৫, ৫৬)
ডা. কালিদাস বৈদ্য এই বইয়ের বিভিন্ন যায়গায় বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অশালীন ভাষা ব্যবহার করেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, তিনি চেয়েছেন অবিভক্ত পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বসতে। যা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতে বঙ্গবন্ধু ও জিয়া ইস্যুকে আরো ঘোলা করবে। ফলে কাঁদা ছোঁড়াছুড়ির মতো অবস্থা হতে পারে।
কোরআনের সূরা তওবার ৫ নং আয়াত, সূরা নিসার ৮৯ নং আয়াত, সূরা আনফালের ৩৯ নং আয়াত, সূরা মোহাম্মদ-এর ৪ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে তিনি আরো লিখেছেন যে, ‘৭১ সালে এদেশের মুসলমানরা আল্লার হুকুম হিসাবে এই আয়াতগুলো তামিল করতে গিয়ে ত্রিশ লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করেছে, হিন্দুদের বাড়িঘর লুণ্ঠনের পর তা জ্বালিয়ে দিয়েছে। হিন্দু নারীদের নির্যাতনের পর ধর্ষণ করেছে।’ ডা. বৈদ্য তার বইতে বোঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত একটা ‘ধর্মযুদ্ধ’। তাই ধর্মীয় নির্দেশ পালন করতেই যুদ্ধের সময় হিন্দুদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
তার এ বক্তব্য আমি বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি এবং হিন্দু হিসেবে মেনে নিতে পারলাম না। আমার মনে হয় আমার মতো আরো অনেকেই একে মেনে নিতে পারবেন না। বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থানে এক প্রেমময় স্বর্গ। যা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বাংলাদেশে বসবাসকারী মুসলমান ব্যতীত অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও আশা করি একমত হবেন যে, সকল ধর্মের মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায়ই আমাদের শান্তি আসবে; অন্যথায় নয়। রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তাই ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’য় তিনি বলেন : ‘আমরা হিন্দু মুসলমান, ধনীদরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্ত্রীলোক ও পুরুষ সকলেই বাঙালি বলিয়া যে এক বাংলার বেদনা অনুভব করিতে পারিয়াছি Ñআঘাতের কারণ দূর হইলেই ... সেই ঐক্যের চেতনা যদি দূর হইয়া যায়। তবে আমাদের মতো দুর্ভাগা আর কেহ নাই। এখন হইতে আমাদের ঐক্যকে নানা উপলক্ষে নানা আকারে স্বীকার করিতে হইবে।...
‘এই অভিপ্রায়টি মনে রাখিয়া দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব।’ সা¤প্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বলে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সেই ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন তাঁর লেখায় ও কাজে। বাংলাদেশে কোনো হিন্দু জাতীয়তা বাদী নেই। এদেশের কোনো হিন্দু ডা. বৈদ্যের সাথে একমত নয়। আমরা বাঙালি এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহবান জানাব, আমাদের গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বিবেচনা করে ডা. কালিদাস বৈদ্যের বই ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে অন্তরালের শেখ মুজিব’ সকল অনলাইন পোর্টাল থেকে উঠিয়ে নেয়া হোক এবং বাজেয়াপ্ত করা হোক। ডা. কালিদাস বৈদ্যের এ লেখা উদ্দেশ্যমূলক, তিনি শেখ মুজিবকে বিতর্কিত ও হেয় করতে চেয়েছেন। তার এ অসৎ উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হবে না তা বোঝার বা উপলব্ধি জ্ঞান হয়তো তার নেই। যদি থাকত তাহলে তিনি এভাবে লিখতেন না। তবে ডা. বৈদ্য শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুর মহত্ত¡¡কে ছোট করতে পারবেন না। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে।
ষ লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ভোলা জেলা সংসদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন