বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে

| প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তৈমূর আলম খন্দকার : সৃষ্টির সেরা মানুষ অনেক গুণাবলীর অধিকারী হলেও, এটা দ্রæব সত্য যে, মানব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রতিহিংসা পরায়ণ। গোটা বিশ্বেই প্রতিহিংসা চলছে; সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এতে পিছিয়ে নেই। পরিবার, সমাজ, রাজনীতি এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও প্রতিহিংসার চেহারা উন্মোচিত হয় বেদনাদায়কভাবে।
প্রতিপক্ষকে সহ্য করার ইতিহাস পৃথিবীর সৃষ্টি থেকেই নেই। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার চলে আসছে ক্রমাগত, জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে সভ্যতা ও বিজ্ঞানের উন্নয়ন হয়েছে সত্য; কিন্তু অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ শাসনের একটুও ব্যাপ্তয় ঘটেনি। যখন মানবতা ও গণতন্ত্র নামক শব্দ দুটি পরিস্ফুুটিত হয়নি তখনো সবল বা শাসক কর্তৃক দুর্বল বা প্রজা (বর্তমানে নাগরিক) শোষিত শাসিত হয়েছে; আধুনিক যুগেও তার পরিবর্তন হয়নি। বরং পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ছে মাত্র।
শাসন ব্যবস্থায় এক সময় আইনগতভাবেই বিষ পান; অগ্নিদন্ধ, গ্যাস, চেম্বারে বন্দি, বাঘের খাঁচায় বন্দি, শুলে চড়ানো, ফুটন্ত গরম পানিতে নিক্ষেপ, গলা কর্তন, যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে জব্দ করা হতো। কিন্তু সভ্যতার ক্রম বিকাশে আন্দোলনের মুখে সে ব্যবস্থার বিলুপ্তি হলেও বর্তমানে আইন ও আদালতকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে দমন করা হচ্ছে।
জমিদার বা রাজা বাদশাহরা লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জনগণকে শায়েস্তা করতো; বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিয়াল বাহিনীর ভ‚মিকায়। তারা শুধু লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে জনগণকে জব্দই করে না, বরং আইনকে ব্যবহার করে তাদেরকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে, আর আদালতের অসহায়ত্বের কারণেই আইনি ব্যবস্থা দিনে দিনে দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করছে। বাহিনীগুলো যে ভাষায় কথা বলে আদালত এর বাইরে যেতে পারছে না। কাগজে কলমে আদালতগুলো স্বাধীন হলেও তাদের অসহায়ত্ব কাটেনি। দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও বিচার বিভাগের সুবিধা মতো পোস্টিং, প্রমোশনের প্রভোলন রাষ্ট্রীয় কাঠামের হাতে বন্দি এবং এ কারণেও রাষ্ট্র নিজেই সন্ত্রাসী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে।
অপরাধীর বিচারের মাধ্যমে শাস্তি হবেÑ এটাই সভ্যতার দাবি। কিন্তু প্রতিপক্ষ হিসাবে কোনো ব্যক্তি নিগৃহীত হবে এটা সভ্যতা, ন্যায় বিচার ও গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কিন্তু বর্তমানে গণতন্ত্রকে রক্ষার নামে বিচার ব্যবস্থাকে কৌশলে ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে অগণিত মিথ্যা মোকদ্দমায় জড়িত করে একটার পর একটা রিমান্ডের নামে প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত করা হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র বা সমাজে যিনি প্রভাবশালী তিনিও প্রতিপক্ষকে নিগৃহীত করার জন্য রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছেন যেন তেনভাবে।
কারাবন্দিদের সুযোগ-সুবিধার নামে জেল কোড সংশোধন করা হয়েছে অনেক বার। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা যেভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে সেভাবে কারাবন্দিদের অধিকার বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাদের সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃতদাসের মতো। মূলত এটাই দৃশ্যমান যে, আইন-কানুন বা জেল কোডে যাই থাকুক না কেন করাবন্দিরা ন্যূনতম অধিকার প্রাপ্ত থেকে বঞ্চিত। জেলখানায় অনেক প্রবাদের মধ্যে যে প্রবাদটি বহুল আলোচিত তা হলো- “যার টাকা ও তদবির কারক আছে তাকে জেলে থাকতে হয় না।” এখন প্রশ্ন হলো যার টাকা বা তদবির কারক নাই তার অবস্থা কী হবে? এ হতভাগ্যদের অধিকার আদায়ে যদি এগিয়ে না আসা হয় তবে এটা কিসের সভ্যতা? দফায় দফায় দীর্ঘদিন জেলে থাকার কারণে কারাগারের অনেক ঘটনাই জানি তার জন্য শুধু রাষ্ট্র বা আইন বিভাগের অভিভাবক প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব এড়াতে পারবে না।
দীর্ঘমেয়াদি সাজা শেষ হওয়ার পরও রায়ে বিচারপতিদের স্বাক্ষর না হওয়ার কারণে অনেকেই সময়মত জেল থেকে বেরুতে পারছে নাÑ এর জবাব কোথায়? উচ্চ আদালতে মামলা শুনানি না হওয়ার কারণে দীর্ঘদিন যাবৎ বিনা বিচারে কারাগারে বন্দি রয়েছে এর অগণিত প্রমাণ রয়েছে যার রিপোর্ট পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে কারাগার যেন মানুষ বেচাকেনার হাট। যেখানে ২০ জন লোক থাকতে পারে সেখানে ৫ গুণ বন্দিকে গাদাগাদি করে রাখা হয়। চিকিৎসার নামে সকল রোগের জন্য প্যারাসিটামল দু’বেলা। স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সময়ও বাণিজ্য রয়েছে। খাদ্য সরবরাহ করা হয় অত্যন্ত নি¤œমানের। ফলে ব্যবসা এখন জমজমাট। যার টাকা আছে সে জেলখানায় গেইটে পি.সি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখলে তার (জমাকারী কারাবন্দীর) চাহিদা মোতাবেক (টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত) পণ্য/খাদ্য জেল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে। এ ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের দ্বিগুণ/তিনগুণ মুনাফা আদায়ের ব্যবস্থা হলেও বিষয়টি হতভাগ্যদের জন্য অনেক দুর্ভাগ্যজনক। কারণ যার টাকা রয়েছে সে যখন পি.সি.-এর মাধ্যমে মাখন রুটি খাবে তখন হতভাগ্যদের ঢোকগিলা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না।
গরিব, অসহায় বিচার প্রার্থীদের জন্য জেলা জজের নেতৃতাধীন আইন সহায়তা প্রদানের জন্য একটি কমিটি রয়েছে। কিন্তু এর ফল ভোগ করছেন সমাজের কত পারসেন্ট? এ ধরনের একটি কমিটি জাতীয়ভাবে চোখে দেখার মতো কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিটি কারাগারের জন্য জেল ভিজিটর রয়েছে যারা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ক্ষমতাসীনরা যেখানে বিরোধীদের কারাগারে নিক্ষেপ করে নিগৃহীত করে তখন রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত সরকার দলীয় ভিজিটররা নিগৃহীত বন্দির কোন উপকারে আসবে?
কারাগার হউক সংশোধনাগার। সেখানে এমন মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা হউক যেখান থেকে অপরাধী নিষ্পাপ হয়ে বেরিয়ে আসবেÑ সাথে থাকবে তার প্রশিক্ষণ ও কর্ম সংস্থানের নিশ্চয়তা। এ বিষয়গুলো রাষ্ট্রকে বিবেচনায় আনতে হবে। তবেই তাকে আলোর পথ দেখানো হবে।
এদেশে বিরোধীদলে থাকলে জেল খাটতে হয়। নিজ চোখে দেখেছি জেলে থাকলে কারা সংস্কারের দীপ্ত শপথ করা হয়। মন্ত্রী হলে বেমালুম ভুলে আরো কঠিন আইন প্রণয়ন করে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরসহ অনেক চলমান মন্ত্রীর সাথেই জেল খেটেছি। তখন তাদের চোখে মুখে কারাবন্দিদের অসহায়ত্বের প্রতি যতœবান দেখেছি। এখন দেখছি তারা উল্টো।
কারাগার-এ ‘জেল বার্ড’ নামে একটি কথা প্রচলন আছে। যারা চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি করে কারাগারে প্রতিনিয়তই আসতো তাদেরকে পুরাতন কয়েদিরা জেল বার্ড বা জেল পাখি বলে ডাকতো। কিন্তু দিন এখন পাল্টে গেছে। পূর্বে রাজনীতিক মামলায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হতো এবং সম্মানও ছিল আলাদা। এখন রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে পরে মামলা দেয়া হয়। তারপরও ন্যূনতম ৫টি মোকদ্দমায় গ্রেফতার না করলে সরকারি দলের সাধ আর পূরণ হয় না। তারপর বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রিমান্ড ও জামিনের পর জেল গেইট থেকে গ্রেফতারের বার্গেনিং তো আছেই। এ সব কারণে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইকৃত রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই জেল বার্ড বা জেল পাখিতে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক কারণেই গ্রেফতার হয়ে বার বার কারাগারে যেতে হয় এবং থাকতে হয় দীর্ঘদিন।
একজন রাজনৈতিক নেতা/কর্মী দীর্ঘদিন জেল খাটার পর পুনরায় যখন তাকে গ্রেফতার করা হয়- তখন কোন কর্তৃপক্ষ বা আদালত কোনই দিন জিজ্ঞাসা করেনি- ‘কেন বা কোন অপরাধে তাকে জেল গেইট থেকে গ্রেফতার করা হলো?’ এমনিভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত অনেক লম্বা হয়ে গেছে। তাদের হাত যখন সরকারের মাথার উপর থেকে সড়ে যাবে তখনই সরকারের পতন হবে- এটাই সর্বস্তরে এখন বদ্ধমূল ধারণা; যা জাতির জন্য অত্যন্ত কলঙ্কজনক।
কেউ অপরাধ করুক বা না করুক এটা এখন বিচার্য বিষয় নয়। পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাকে আসামি করছে- এটাই এখন বিচার্য বিষয়। পুলিশের সব কথাকে সত্য ধরেই আটককৃত ব্যক্তির কারাগারের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ হয়। প্রেক্ষাপটে মানুষ আজ নীরব হয়ে গেছে। প্রতিবাদের ভাষা ফুরিয়ে গেছে। প্রতিবাদ করলেই কোন বিপদ কাঁধে চেপে বসে এই ভেবে কেউ এখন কথা বলতে চায় না। মানুষ ভদ্রভাবে, শান্তশিষ্ট হয়ে অর্থাৎ কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই দেশে বসবাস করুক এটাই এখন সরকারের কাম্য। এ কারণেই নির্বাচন কমিশন, দুদকসহ যাদের নিকট প্রতিকার রয়েছে তারাও সরকারের ভাষাই কথা বলছে। প্রয়োজন কিছু নিরপেক্ষ কথা বলে যার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
এক সময় শাসক বা রাজাবাদশাদের ইচ্ছায়ই কারাগার পরিচালিত হতো। এতে কোনো ধরা বাধা নিয়ম ছিল না। যখন যা আদেশ হতো মর্জি মাফিক তাই পালিত হতো। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ ভারতের কারা মহা-পরিদর্শক উৎ. ঋ. ঔ. গড়ঁধঃ কারা আইন কোডিফাইড করার কাজ শুরু করেন যা তিনি শেষ করতে পারেননি। ১৮৬৭ সালে বেঙ্গল জেল মেনুয়েল প্রকাশিত হয়। ১৮৭৬ সালে তৎকালীন কারা মহা-পরিদর্শক ড. ঔ. ঐববষু জেল কোডের দ্বিতীয় সংকলনের কাজ শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে কারা আইনের সংশোধন হয়েছে। কারা আইনকে অধিকতর সময়োপযোগী করার জন্য ১৯১৯ সালে ইন্ডিয়ান জেল কমিটি গঠিত হয় যার সুপারিশের উপর ভিত্তি করে বেঙ্গল কারা মহা-পরিদর্শক জ. ঊ. ঋখঙডঊজউঊড খঃ. ঈড়ষ. ও.গ.ঝ. ৭ম সংকলন প্রকাশ করেন। কিন্তু কারা আইনের সমোপযোগী সংস্কার হয়নি। সরকার আসে, সরকার যায়। বিভিন্ন সময়ে সরকার কারা আইনকে সংশোধন করেছে। সর্বশেষ থিম হিসাবে কারাবন্দিদের জন্য যে সেøাগানটি ব্যবহার করছে তা হলোÑ “রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ।” কিন্তু কারাগারে কতজন আলোর পথ দেখেছে সেটাই এখন পর্যালোচনার বিষয়। আমরা আলোর পথ দেখতে চাই। কারণ রাষ্ট্রের জন্য প্রতিটি নাগরিকের জীবন ও সময় অনেক মূল্যবান। কারাজীবনে কর্মের মাধ্যমে কারাবন্দির জীবন আলোকিত হোকÑ এটাই জাতির কাম্য।
 লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন