আহমেদ জামিল : কোরীয় উপদ্বীপের চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে অনেকের মধ্যে একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল এবং প্রশ্ন উদ্রেক হয়েছিল যে তাহলে কি দ্বিতীয় কোরীয় যুদ্ধ আসন্ন? চীন ও রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতার কারণে এবং পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে কেউ কেউ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার কথাও ব্যক্ত করেছিলেন। কেননা, ইতোমধ্যে কোরীয় পানি সীমায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস কার্ল ভিনসন অবস্থান করছে। উত্তর কোরিয়ার পানি সীমার বেশ কাছে পরমাণু সাবমেরিন ইউএসএস মিশিগান মোতায়েন করা হয়েছে। এই সাবমেরিনে ১৫৪টি ক্রুজ টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এতে ৬০ জন বিশেষ অভিযানের প্রশিক্ষিত সেনা ও মিনি সাবক্রু রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী থাড মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া এক আঘাতে মার্কিন রণতরী ডুবিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। পিয়ংইয়ং তার সমুদ্র উপকূলে জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে রেখেছে। সেই সাথে আক্রান্ত হলে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহাররের হুমকি দিয়েছে দেশটি। অবশ্য এই মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসন যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে এবং চীন ও রাশিয়ার প্রবল চাপে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে কূটনৈতিক পন্থায় সংকটের সমাধান করতে চাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। উল্লেখ্য, চীনকে মনে করা হয় বাদবাকী দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তবে ইদানীং অপর বৃহৎ শক্তি রাশিয়াও উত্তর কোরিয়ার মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত এপ্রিল মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বিরুদ্ধে আনিত একটি নিন্দা প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো প্রদান করেছিল। এদিকে গত ২৮ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে পূর্ণাঙ্গ সিনেট অর্থাৎ সিনেটের ১০০ জন সদস্যের সাথে নজিরবিহীন বৈঠকের পর আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে এসে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি পিয়ংইয়ং-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেট সভার অনেক সদস্য উত্তর কোরিয়ায় সামরিক হামলায় বিরোধিতা করেন। একে কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পিছুহটা বলেছেন। তবে যুদ্ধের আশঙ্কা এখনো বাতিল করছেন না অনেকেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, প্রথম কোরীয় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সংঘঠিত এই যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার এক লাখ ৭৮ হাজার ৪০৫ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল। উত্তর কোরিয়ার প্রাণ হারিয়েছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৩ জন নাগরিক। এই যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার এবং চীন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে অংশ নিয়েছিল। এই যুদ্ধে ৩৬ হাজার মার্কিনী এবং এক লাখ ৫২ হাজার চীনা নাগরিকও নিহত হন। নিহতদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং-এর এক সন্তানও ছিলেন। নতুন আরেকটি কোরীয় যুদ্ধ শুরু হলে তাতে সব পক্ষের ৫ কোটির মতো মানুষ নিহত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর সম্ভাব্য এই যুদ্ধ পরমাণু যুদ্ধে গড়ালে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ। উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের বিশাল অংশ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
এই ধ্বংসযজ্ঞ হতে মার্কিনীরাও রেহাই পাবে না। দক্ষিণ কোরিয়ার পুসাং, জাপানের ওকিনাওয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার মহাদেশের গুয়ামে বিশাল মার্কিন নৌঘাঁটি রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্রবাহী মাঝারি পাল্লার মিসাইল এসব ঘাঁটিতে আঘাত হেনে মার্কিন বাহিনীর প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে পারে। আর উত্তর কোরিয়া যদি সত্যি সত্যি পরমাণু ওয়ারহেড সংযোজনে সক্ষম হয় তাহলে তার ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-খÐে অর্থাৎ আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় আঘাত হানতে সক্ষম হবে। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়া মার্কিন মূল ভূ-খÐে আঘাতকারী প্রথম দেশ হতে চায়। যে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের এবং দুই মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি থেকে নিবৃত্ত করতে চাইছে।
তাছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থাড উত্তর কোরিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিরোধে সক্ষম নয় বলেও জানা গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এবং গবেষণা সংস্থাগুলো এখন উত্তর কোরিয়ার সামরিক সামর্থ্য ও সক্ষমতাকে খাটো করে দেখছেন না। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ভিত্তিক সামরিক গবেষণা সংস্থা ‘ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি’র প্রদেয় তথ্য মতে, আগে উত্তর কোরিয়ার হাতে পরমাণু বোমার সংখ্যা নিয়ে যে ধারণা করা হতো তার থেকে আরো বেশি পরমাণু বোমা উত্তর কোরিয়ার হাতে রয়েছে। বর্তমান সময়ে দেশটিতে অন্তত ৩০টি পরমাণু বোমা রয়েছে। এছাড়া তিন বছরে এ সংখ্যা দ্বিগুণ করার মতো উপাদানও মজুদ আছে। সংস্থাটির মতে, উত্তর কোরিয়া নতুন পরমাণু শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। অথচ, ১৯৯৯ সালে আমেরিকা মনে করতো পিয়ংইয়ং-এর হাতে একটি বা দুটি পরমাণু বোমা রয়েছে। আর ২০২০ সালের মধ্যে দেশটির পরমাণু বোমার সংখ্যা বেড়ে ১০টি হতে পারে বলে সে সময় ধারণা করা হয়েছিল।
অন্যদিকে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই কমিউনিস্ট দেশটির মজুত বিভিন্ন পাল্লা ও ক্ষমতার হাজারেরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ দূরত্বে আঘাত হানতে সক্ষম ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম পাঁচ বছর আগেই তৈরি করেছে উত্তর কোরিয়া। আগেই বলা হয়েছে, এই দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মার্কিন ভূ-খÐে আঘাত হানতে সক্ষম। ২০০৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে ৫টি বড় পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে উত্তর কোরিয়া। পিয়ংইয়ং-এর দাবি আরো ৬টি পরীক্ষা চালিয়েছে তারা, যা আধুনিক এবং লক্ষ্য বস্তুতে কার্যকরভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। উত্তর কোরিয়ার দাবি হলো, মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ও তার মিত্রদের সামরিক আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্যই সে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
পিয়ংইয়ং-এর কাছে স্বল্প, মাঝারি ও দূরপাল্লার পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র থাকায় অনেকেই দেশটিকে ‘দ্বিতীয় স্ট্রাইক পাওয়ার’ বলে থাকেন। উত্তর কোরিয়ার আরেকটি ভয়ংকর মারণাস্ত্র হলো তার শক্তিশালী রাসায়নিক অস্ত্র। সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রি শিনজো আবে দাবি করেছেন, উত্তর কোরিয়া জাপানের ওপর সারিন গ্যাস হামলা চালাতে পারে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, উত্তর কোরিয়ার সারিন ও ডিএক্সসহ দুই হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার মেট্রিকটন রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া রাসায়নিক অস্ত্রভাÐারের মজুত গড়ে তোলে। এছাড়াও উত্তর কোরিয়ার হাতে বিশাল সংখ্যক প্রচলিত অস্ত্র-শস্ত্রও রয়েছে।
এসব কারণেই ভাবা হচ্ছে যে, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন আমেরিকাকে ছাই করে দেবার যে হুমকি দিয়েছেন তাকে নিছক বাগাড়ম্বর বলে ভাবা ঠিক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস বা ছাই করে দিতে না পারলেও উত্তর কোরিয়া যে মার্কিন যুক্তরারষ্ট্রের গায়ে শক্তভাবে আঁচড় কাটতে সক্ষম তা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। যে কারণে অনেক মার্কিন সিনেটরদের মতো বহু মার্কিনী উত্তর কোরিয়ায় সামরিক হামলার বিরোধী। চরম পরিণতির কথা ভেবে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জনগণের বড় অংশও কোরীয় উপদ্বীপে নতুন আরেকটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে ভবিষ্যৎ সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন তার নিজ স্বার্থেই চায় না কোরীয় উপদ্বীপে আরেকটি যুদ্ধ বাঁধুক। কারণ এতে করে তার সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। যে কারণে চীন উত্তর কোরিয়াকে নতুন করে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা না চালানোর জন্য চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ং-এর মধ্যে সংলাপ শুরু করার এবং কূটনৈতিক পন্থায় সঙ্কট নিরসনের আহŸান জানিয়েছে। আর রাশিয়াও চায় না যে, উত্তর কোরিয়াকে পরাভূত করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব আবার প্রতিষ্ঠিত হোক। এ প্রেক্ষাটটে আপাতত কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের আশঙ্কা কম। তবে ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের ট্রাম্প কখন কী করে বসেন তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যে কারণে যুদ্ধের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনকে ইতোমধ্যে ‘স্মার্ট বয়’ সম্বোধন করে তার সাথে দেখা হওয়ারও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তবে কোন মতলব নিয়ে এ ধরনের কথা তিনি বলেছেন তা হয়তো সময়েই বলে দেবে।
য় লেখক : কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন