শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চোরাচালানে ডায়মন্ড ব্যবসা

| প্রকাশের সময় : ১৭ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করেই আনা হয় : শক্তিশালী সিন্ডিকেটের সদস্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে : দ্বিমুখী ব্যবসায় ডায়মন্ডের বিনিময়ে যায় হেরোইন


বিশেষ সংবাদদাতা : বৈধ নয়, ডায়মন্ড আসছে অবৈধভাবে চোরাচালানের মাধ্যমে। সেই ডায়মন্ডই গুলশান, বনানী, উত্তরা, বায়তুল মোকাররম মার্কেটসহ ঢাকার অভিজাত দোকানগুলোতে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে। কাস্টমস ট্যারিফ অনুযায়ী, ডায়মন্ড আমদানির চূড়ান্ত করভার হচ্ছে ১৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার ডায়মন্ড আমদানী করলে সরকারকে ১৫২ টাকা ৮২ পয়সা শুল্ক কর পরিশোধ করতে হয়। মূলত এই বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকি দিতে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে চোরাচালানের মাধ্যমে ডায়মন্ড আনা হয়। অনুসন্ধানে এই চোরাচালান সিন্ডিকেটের সদস্যদের নামও জানা গেছে। পর্দার আড়ালে থেকে তারা জমজমাট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর বনানীতে দুই তরুণীকে ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতার হওয়া সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক। এই ঘটনার পর শুল্ক গোয়েন্দারা আপন জুয়েলার্সের বেশ কয়েকটি শো-রুমে অভিযান চালিয়ে স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের অলঙ্কার জব্দ করেন। ডায়মন্ডের ব্যবসা নিয়ে সেই থেকে আলোচনা শুরু হয়েছে।     
কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈধভাবে আমদানি করা ডায়মন্ডের পরিমাণ খুবই সামান্য। এই সময়ের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে সামান্য পরিমাণ ডায়মন্ড আমদানী করেছে। এ তালিকায় আপন জুয়েলার্সের নাম নেই। অথচ ঢাকায় আপন জুয়েলার্সের মোট ৮টি শোরুমে রয়েছে বিপুল পরিমান ডায়মন্ডের অলঙ্কার। নারী-পুরুষের জন্য ডায়মন্ডের অলঙ্কার বিক্রি করে আপন জুয়েলার্স। বিভিন্ন ওজনের ডায়মন্ডে আংটি, লকেট, নাকফুল, কানের দুল, চুড়ি এবং ডায়মন্ডের সেট ও লকেট সেটের দাম সর্বনিন্ম ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০ লাখ টাকা। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আপন জুয়েলার্সের শোরুমে অভিযান চালিয়ে বৈধ কোনো কাগজপত্র তারা পাননি। তাতে তাদের ধারণা, অবৈধপথে ডায়মন্ডগুলো আনা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এক সময় মৌচাক মার্কেটে ‘আপন শাড়ি, নামে একটি কাপড়ের দোকান ছিল আপন জুয়েলার্সের মালিক সেলিমের। ভারত থেকে শাড়ি আনতে গিয়েই আপনের মালিক চেরাচালানীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এরপর শুরু করেন জুয়েলারী ব্যবসা। রাতারাতি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান সেলিম ও তার ভাই গুলজার।  
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীতে জুয়েলারী ব্যবসায়ীদের অনেকেই চোরাচালানীর মাধ্যমে স্বর্ণ, ডায়মন্ড ও রতœ পাথর আনছে। কর ফাঁকি দিয়ে আনা এসব পণ্যই বিক্রি করছে তারা চড়া দামে। এই সিন্ডিকেটের সাথে আন্তর্জাতিক চেরাকারবারিরাও জড়িত। এদের সিঙ্গাপুর, দুবাই, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, হংকং, সউদীআরব ও ভারতে রয়েছে আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেটের এজেন্ট। এজেন্টদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ ডায়মন্ড আসছে। সূত্র জানায়, ডায়মন্ডের একটা বড় অংশ আসে ভারত থেকে। ভারতের মুম্বাইয়ের রাহুল নামের এক চোরাচালানী বাংলাদেশে ডায়মন্ড সরবরাহ করে থাকেন। সূত্র জানায়, চোরাচালানীর বড় সিন্ডিকেটের সাথে গুলশানের রতœ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জড়িত। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এই সিন্ডিকেটকে ব্যবহার করে থাকে। এদেরই একজন বিহারী শাহাবুদ্দিন। তার মাধ্যমে অনেক জুয়েলারী ব্যবসায়ী রাতারাতি কোটিপতি হয়েছেন। এ ছাড়াও রজব আলী পাঠান, ফয়সাল, শরীফ, জাকিরসহ আরও কয়েকজন চোরাচালানী সহযোগি হয়ে কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, ডায়মন্ড বা স্বর্ণ চোরাচালানীরা দ্বিমুখি ব্যবসা করে বলে রাতারাতি কোটিপতি বনে যায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা চোরাই পথে আনে ডায়মন্ড বিনিময়ে পাঠায় হোরোইন। ২০১০ সালে চীনের গুয়াংজো বিমান বন্দরে ৪৩ কেজি হেরোইনসহ ধরা পড়েছিল গুলশানের চার ব্যবসায়ী। এদের একজন মহিলা। গ্রেফতারকৃতদের সহযোগী ও দলনেতা মাকসুদুল করিম রবু গুয়াংজো বিমান বন্দর থেকে পালিয়ে এখনও গুলশানেই বিচরণ করছেন। বাংলাদেশ মুক্তা ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
সূত্র জানায়, গুলশান ২নং সেকশনের ডিসিসি মার্কেটের রতœ ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি চিহ্নিত সিন্ডিকেট বহুদিন ধরেই চোরাচালানের সাথে জড়িত। ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চীনের গুয়াংজো বিমান বন্দরে ৪৩ কেজি হেরোইনসহ রবু সিন্ডিকেটের ৪ সদস্য ধরা পড়ে। ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ:) বিমান বন্দরে  কর্তব্যরত কাস্টমস ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের মোটা অংকের টাকায় ম্যানেজ করে রবুর নেতৃত্বে ৫ জন চোরাচালানী ২০১০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চীনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে। একটি লাগেজে তারা ৪৩ কেজি হেরোইন নিয়ে যায়। ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের গুয়াংজো বিমান বন্দরে নামার পর সেখানকার মাদক বিরোধী স্পেশাল টিম ও কাস্টমস কর্মকর্তারা সিরাজ নামে একজনকে সন্দেহ করে আটক করে। পরে তার লাগেজ তল্লাশী করে ৪২ কেজি ৮৪ গ্রাম হেরোইন উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় মোট চারজন গ্রেফতার হয়। এরা হলো, ইলিয়াস আহমেদ (৪১), পাসপোর্ট নং- সি১৮২৩৪৭৭, পিতা মরহুম আবু আহামদ, গ্রাম: দক্ষিণ সাতধা, ইউনিয়ন ও থানা:  ছাগলনাইয়্যা, জেলা : ফেনী। মোঃ সিরাজ (৪৭), পাসপোর্ট নং ই০৩৭৪১৮২, পিতা : মরহুম আলাউদ্দিন, সাং: চরছানপাড়া, ইউনিয়ন: কায়েতপাড়া, থানা: রূপগঞ্জ, জেলা : নারায়ণগঞ্জ। এস এম হারুন আল রশিদ (৪০), পাসপোর্ট নং  জেড০৫৩৮৮৬৫, পিতা : এস এম আক্কাস আলী, গ্রাম: চরছানপাড়া, ইউপি: কায়েতপাড়া, থানা : রূপগঞ্জ, জেলা: নারায়ণনগঞ্জ এবং মনিরা (১৯), পাসপোর্ট নং ই১২৩২২৮৮, পিতা: কাজী মসাহবুবুর রহমান, গ্রাম : খালিশপুর, প্লট: ২, ইউনিয়ন-ওয়ার্ড নং: ১০, থানা : খালিশপুর, জেলা : খুলনা মেট্রো।
২০১০ সালের পহেলা ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা-১ থেকে চীনের বেইজিং থেকে প্রাপ্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের পত্র (নং কনস-৬/৩৩/২০১১/বিজেএন) এর উদ্ধৃতি দিয়ে চীনে মাদক পাচারের অভিযোগে চার বাংলাদেশির গ্রেফতারের বিষয়টি তাদের পরিবার পরিজনকে জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে অনুরোধ জানানো হয়। ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এক চিঠিতে (স্মারক নং ১০৫১/টিম-১/এসসিও) ফেনী, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনার বিশেষ পুলিশ সুপারকে গ্রেফতারকৃতদের পরিবার পরিজনকে অবহিত করণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করে। ২০ অক্টোবর বেইজিংয়ের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ঢাকার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে জানানো হয়, চীনের গুয়াংজো বিমান বন্দরে মাদক পাচার করতে গিয়ে চার বাংলাদেশী গ্রেফতার হয়েছে।
সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত চার চোরাচালানীর মধ্যে ইলিয়াস আর জীবিত নেই। বাকী তিনজন সিরাজ, হারুন ও মনিরা আছে কারাগারে। গুলশান ডিসিসি মার্কেটের ব্যবসায়ী সিরাজের ছেলে জানান, ইতোমধ্যে তিনি চীনে গিয়ে তার বাবার সাথে দেখা করে এসেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে, স্বর্ণ বা ডায়মন্ড চোরাচালান করা হয় শুল্ক গোয়েন্দা ও কাস্টমসের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই। সেই কারণে অবৈধপথে আনা ডায়মন্ড প্রকাশ্যে বিক্রি হলেও শুল্ক গোয়েন্দাদের চোখে পড়ে না। তারা এগুলো দেখেও না দেখার ভান করে। শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের এ নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গুলশানের এক ব্যবসায়ী বলেন, এক সময় প্রায়ই অভিযান চালাতো শুল্ক গোয়েন্দারা। ৪/৫ বছর ধরে আর কোনো অভিযানের কথা শুনিনি। তাতে মনে হয়, চোরাচালানীরা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। প্রভাবশালীদের সাথে তারা সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। এজন্য কোটি কোটি টাকা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। ওই ব্যবসায়ী বলেন, শুধু আপন জুয়েলার্সকে ধরলে চলবে না। আরও যারা আছে তারা কি বৈধপথে ডায়মন্ড আনছে কি না তাও খতিয়ে দেখা দরকার। জানতে চাইলে কাস্টমসের এক কর্মকর্তা বলেন, আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তাদের শোরুমে অভিযান চালানো হয়েছে। বাকীগুলোতেও পর্যায়ক্রমে অভিযান চালানো হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
সফিক ১৭ মে, ২০১৭, ১১:৫২ এএম says : 0
সকল অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা হোক
Total Reply(0)
সুলতান আহমেদ ১৭ মে, ২০১৭, ১১:৫৩ এএম says : 0
দুর্নীতিবাজ কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন